প্রতিক্রিয়া

ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় এবারের কোটা আন্দোলন

এম এম আকাশ

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার দাবি যৌক্তিক করার জন্য বর্তমানে সারা দেশে বীরত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন চলে। এ আন্দোলন দ্রুত কল্পনাতীত গতিতে সাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা অর্জন করে। ছাত্ররা এরই মধ্যে রাষ্ট্র ও তার পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়ে অনেক আত্মত্যাগ ও সাহসী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমান সরকারের অপরিণামদর্শিতার জন্য আন্দোলনটি রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় এবং অকুতোভয় আবু সাঈদ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহমুদুল হাসান রিজভীসহ দুই শতাধিক প্রাণের বলিদান হয়। 

সব দিক থেকেই এ আন্দোলনে বিপুল শক্তি ও সক্ষমতা দেখিয়েছেন আসলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। তারাই এর নায়ক। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শাসক দলের সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিতাড়িত করেছেন, শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও তারা ঐক্যবদ্ধ চাপের মাধ্যমে বাধ্য করেছেন হলে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। অবশ্য রাষ্ট্র যখন সদলবলে বাহিনী নিয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তখন তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। হল ত্যাগ করে যার যার বাসায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সে সময় তাদের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু এর পরও এ ধরনের নির্দলীয় শক্তিশালী অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলন শাসক দল, বিরোধী দল, প্রগতিশীল শক্তি সবার জন্যই একটি অভিনব বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে। সেটা হচ্ছে যে, কোনো ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে শাসকদলীয় দুঃশাসন সেই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সদস্যরা বেশি দিন নিশ্চুপভাবে মেনে নেয় না। সব মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ছাত্রদের কোটা আন্দোলন ইতিহাসের একটি অনন্য শিক্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে সব রাজনৈতিক নেতার মনে দুঃস্বপ্ন বা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের মতো চিরজাগরূক থাকবে। 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে সব নাগরিকের ‘সুযোগের সমতা’। সমাজে সাম্য ও সমতা বিধান নিশ্চিত করাই প্রগতিশীলদের উদ্দেশ্য। ১৯৭২ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের দফা ৪-এ আছে: রাষ্ট্র সমাজে যারা অনগ্রসর তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে এবং সংবিধানের অন্য যেকোনো বিধান এক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারবে না। ইতিবাচক স্বীকৃতির এ বিধান সভ্য অনেক দেশে চালু রয়েছে যাতে অনগ্রসর গোষ্ঠীর সদস্যরা বৈষম্যের বাধা দূর করে আর দশজন মানুষের মতো সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে। রাষ্ট্র তাদের যদি বিশেষ সুবিধা দেয় তাহলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর একাধিক বার কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য দেয়া কোটা বৃদ্ধি করা হয়। কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা হোক বা উঠে যাক এ রকম কোনো আন্দোলন জাতীয়ভাবে বর্তমানে কেউই সমর্থন করেন না। কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে তবে তার ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা নয় বরং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তাকে হালনাগাদ এবং সময়োপযোগী করা যেতে পারে। চলমান ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্যও তাই।

প্রশ্ন হলো, কোটা আইন সংস্কার কেন চাই? ১৯৭২ সালে যখন কোটা পদ্ধতির আইনটি প্রণীত হয়েছিল তখন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা যেমন ছিল এখন তা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কাজেই আগের কোটা পদ্ধতি অবিকলভাবে বহাল রাখার সুযোগ নেই। যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে একটি বড় অংশই ছিল তরুণ ও ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা এবং অন্য যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তাদের অনেকেরই বাড়িঘর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরা পুড়িয়ে দেয়। লুটপাট চালায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে তারা অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। এ অবস্থায় তাদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে সমাজে টিকে থাকার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া কোটা সুবিধা বাড়ানো হয়। বর্তমানে হাইকোর্টের রায়ের পর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারিত আছে। অন্যান্য অনগ্রসর কোটা মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে বর্তমানে কোটা সুবিধার হার হচ্ছে ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে মাত্র ৪৪ শতাংশ পদে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। ৫৬ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত। স্বাধীনতা-পরবর্তী কয়েক বছর হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সুবিধা সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন ছিল। কারণ সেই সময় মুক্তিযোদ্ধারা সবেমাত্র যুদ্ধ করে ফিরেছেন। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। অনেকেই শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে তাদের পক্ষে আর শিক্ষাঙ্গনে যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারাটা আত্মনির্ভর হওয়ার একটি উপায় বা কৌশল হিসেবে তখন গণ্য করা হচ্ছিল। সেই সময় সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার যুক্তি ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মাধ্যমে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করতে সমর্থ হন। এখন তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আর অনগ্রসর বলা যাবে না। ৫৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানদেরও কোটা সুবিধা পাওয়াটা নিয়ে তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে প্রশ্ন উঠেছে। 

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা সুবিধা আছে তা কমানো যেতে পারে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেই তিনি সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবেন—এটা হতে পারে না। দেখতে হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাকে কোটা সুবিধা দেয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে তিনি প্রকৃতই সুবিধাবঞ্চিত কিনা। কোটা সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের দুর্নীতি না হয় তা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ যাতে কোটা সুবিধার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী আছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। এরা জাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। এদের পোষ্যরা যাতে কোনোভাবেই কোটা সুবিধা পেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, যারা মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। 

আদিবাসীরা কোটা সুবিধা পেতে পারেন। কারণ তারা মূল ধারার জনগণ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। কাজেই তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা দেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, চাকরি বা কর্মসংস্থান ছাড়া সহজে দারিদ্র্য বিমোচন তাদের জন্যও সম্ভব নয়। কাউকে কিছু আর্থিক বৃত্তি সহায়তা করার চেয়ে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হলে তার বেশি উপকার হবে। প্রতিবন্ধীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা পেতে পারেন। কারণ তারা সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত অবস্থায় কর্মহীন রয়েছেন। নারীরাও কোটা সুবিধা পেতে পারেন। তবে আগে নারীরা সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সুবিধাবঞ্চিত ছিলেন এখন তা নেই। নারীরা এখন পুরুষের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে দাপটের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। নারীরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। কাজেই নারীদের কোটা আগের চেয়ে কমানো যেতে পারে। 

আমরা যদি উন্নত দেশ হতে চাই তাহলে আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থাকেও উন্নত করতে হবে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে উচ্চ শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ জনবলের সমাবেশ ঘটাতে হবে। কোটা সুবিধা তাদের জন্য প্রযোজ্য হয় যারা প্রাথমিক যোগ্যতা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়েছেন। অর্থাৎ যারা পরীক্ষায় পাস করেছেন তাদের জন্য। যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন কোটা সুবিধা তাদের কোনো উপকারে আসে না। কাজেই যোগ্যতার একটি ন্যূনতম মাপকাঠি তো আমরা ধরেই নিচ্ছি। তারপর আসে কোটার প্রশ্ন। হয়তো চাকরির আবেদনকারীর মধ্যে যিনি অধিক যোগ্য তিনি কোটার কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় চাকরিটি পেলেন না। আর একজন তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কোটা সুবিধার কারণে চাকরিটা পেয়ে গেলেন। এক্ষেত্রে হয়তো আমরা মেরিট বা যোগ্যতাকে কম মূল্য দিলাম। তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী যদি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান তাহলে প্রশাসনের জন্য তা কিছু না কিছু ক্ষতির কারণ হতে পারে। যারা সমাজে পশ্চাৎপদ হয়ে আছেন এটা তাদের ব্যক্তিগত কোনো দোষ নয়। কারণ সমাজ তাদের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে পারেনি। তাই কোটার মাধ্যমে তাদের একটি সাময়িক সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। তাই বলে যেনতেনভাবে কোটা সুবিধার কারণে যদি অতিমাত্রায় অযোগ্য ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান সেটা কোনোভাবেই দেশের জন্য ভালো হবে না। কোটা সুবিধা থাকতে পারে। তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে কোটা সুবিধার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে মেধাশূন্য হয়ে না পড়ে। কত শতাংশ কোটা সুবিধা রাখলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। আদালতের হাতে এটা ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। বিশেষজ্ঞদের ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্সকে এটা নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। 

এম এম আকাশ: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন