আলোকপাত

এবারের কোটা আন্দোলন এবং একজন ভিসির কথা

আব্দুল বায়েস

ছবি : বণিক বার্তা ( ফাইল ছবি)

বাংলাদেশে গত ক’দিন যা ঘটে গেল তা যেন একটা দেশলাইয়ের কাঠির আগুন থেকে দাবানল এবং দাবানল থেকে বন উজাড় হওয়ার চিত্র। ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছিল বিদ্যমান বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে। কিছু যৌক্তিক কারণে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে—মোট চাকরির ২০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, জেলাভিত্তিক ৪০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী। তার মানে প্রতি পাঁচটি চাকরির চারটির উৎস ছিল বিভিন্ন কোটা। ব্যাপার হয়তো অবাক হওয়ার মতো কিন্তু সেই সময়ের বাস্তবতায় ওটাই ছিল সুচিন্তিত ও সুবিবেচিত নীতি। 

এমনি করে সরকারি চাকরিতে কোটাভিত্তিক নিয়োগ চলে প্রায় তিন দশক। ২০০৩ সালে নাকি এ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তবে তেমন তীব্র নয়। ২০১৩ সালে কোটা নিয়ে কয়েক সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন চলে। ২০১৮ সালে এসে কোটাবিরোধী আন্দোলন তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে কোটা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে একটা পরিপত্র জারি করেছিল। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট কোটা ব্যবস্থা আগের জায়গায় রেখে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করলে ২০২৪ সালে পরিস্থিতি প্রতিবাদমুখর এবং জটিলতর হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক সরকারি পদক্ষেপের ধীরলয়ে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়। এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে মাত্র ১০-১৫ দিনের মধ্যে সহিংসতায় বহু প্রাণহানি ঘটে, আসে কারফিউ, বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা, থমকে দাঁড়ায় অর্থনীতি। আন্দোলন, সহিংসতা এবং কারফিউর কবলে পড়ে গত এক সপ্তাহের বিশৃঙ্খলার দৈনিক আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। তবে এ হিসাবের মধ্যে নেই ডাটা সেন্টার, বিআরটিএ, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ওপর ধ্বংসযজ্ঞের আর্থিক হিসাব; নেই মানুষের মানসিক শক্তির ওপর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রভাব, বিপর্যস্ত সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার আর্থিক হিসাব-নিকাশ এবং দেশে-বিদেশে অন্যান্য বিরূপ প্রভাব। 

দুই. 

সদ্য ‘গত হওয়া’ আন্দোলনের শুরুতে কিংবা তারও আগে সরকার কেন হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করল না, তা অনেকের কাছে ১ মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। পুরনো ক্ষত জিইয়ে রাখলে যেমন পচন ধরতে পারে তেমনি পুরনো ন্যায়সংগত দাবির পক্ষের আন্দোলন চাপা দিতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা থাকে। বস্তুত তাই হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। আবার পরিস্থিতি কখনো এমনও দাঁড়ায় যে ফোঁড় দিয়ে শেষ রক্ষার ফুরসত পাওয়া যায় না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও তাদের শাসনামলে তেমন ভুল করেছিল; জনগণের ন্যায্য দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে হয়তো তাদের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। এর থেকে শিক্ষা একটাই, আর তা হলো এই যে প্রতিবাদকে শুধু শত্রু হিসেবে ভাবা সুবিবেচনার কাজ নয়, সে বন্ধুও বটে এ অর্থে যে অজান্তে হলেও ভুলগুলো আঙুল দিয়ে দেখায়।

তিন.

ছয় বছর পর ২০২৪ সালে এসে আবারো যখন সেই শাহবাগ হয়ে ওঠে তারুণ্যের প্রতিবাদী কণ্ঠ, তখন শুরুতে কেউ হয়তো ভাবত ‘হাতি-ঘোড়া গেল তল ভেড়া বলে কত জল’ কিন্তু পচা শামুকেও যে পা কাটে। কিংবা ষড়যন্ত্র-সন্ধানীরা ভাবত, এ আন্দোলন বুঝিবা মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করা কিংবা মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখার অপপ্রয়াস। বলা বাহুল্য, এ ধরনের যুক্তির ভিত খুবই দুর্বল। বর্তমান সরকার ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে হলে অন্য সবকিছুর মতো কোটা পদ্ধতিকে স্মার্ট করতে হবে—এটাই সময়ের দাবি। অর্থাৎ ন্যূনতম না হলেই নয় পর্যায়ে কোটা রেখে বাকিটা মেধাভিত্তিক করা উচিত। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? মেধা যাচাই করবে যে সংস্থা সেখানেও যে টাকা না দিলে মেধার স্বীকৃতি মেলে না—শর্ষের ভেতরই ভূত!

চার.

অবশেষে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট কোটা ব্যবস্থা সংস্কার সাধনে কিছু প্রস্তাব রাখেন, যা সরকার আমলে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব গেজেটে প্রজ্ঞাপিত করে প্রশংসিত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি চতুর্মাত্রিক চাপে পিষ্ট হতে থাকে আগের লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, তলানিতে রিজার্ভ এবং রাজস্ব ঘাটতির সঙ্গে সদ্য যুক্ত হওয়া প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি; তার ওপর সম্পদের ধ্বংসস্তূপের ক্ষতির অর্থায়ন সমস্যা ও বিদেশী বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাবসহ সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যার কথা বিস্তারিত নাইবা বলা হলো। মূল কথা, বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি এখন গভীর খাদের কিনারায়।

পাঁচ.

সম্প্রতি সৃষ্ট সংকট থেকে সব পক্ষেরই কিছু না কিছু শেখার আছে। বিশেষত সরকারকে বুঝতে হবে—এক. যেকোনো আন্দোলনের শুরুতেই আন্দোলনকারীদের কথা শুনতে হয়, কারণ সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। দুই. সরকারি ছাত্র সংগঠন দিয়ে ছাত্রদের ন্যায্য আন্দোলন কখনো বন্ধ করা যায় না, হয়তো কিছু সময়ের জন্য তা স্থগিত করা যায় মাত্র। সরকারি ছাত্র সংগঠনে কিংবা দলে অনুপ্রবেশকারী যখন সন্দেহের তালিকায় থাকে তখন আরো সতর্কতা অবলম্বনের দরকার এবং তিন. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড যখন ঘটছিল তখন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় থাকলে পরিস্থিতি অত ভয়াবহ নাও হতে পারত। প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় নিযুক্ত কর্ণধারদের গাফিলতিসহ এ দায় তাদের ওপরও বর্তায়। চার. এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির পূর্বাভাস সরকারের আগেভাগে পাওয়া উচিত ছিল। পাঁচ. সারা বিশ্বে এখন এক কঠিন সময় পার করছে বিধায় সমস্যা বা সংকট সমাধানে সরকারকে আরো সহনশীল এবং উদার মনোভাব পোষণ করে লাইনচ্যুত ট্রেনটিকে ট্র্যাকে আনতে হবে। 

আন্দোলনকারীদের জন্যও সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ পাঠদান করে। এক. যারা আন্দোলনে সমর্থন জানায় তাদের সবার উদ্দেশ্য এক হয় না এবং প্রত্যেকেই চায় কোমলমতি ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর ভর করে নিজের সুবিধা ঘরে তুলতে। তাতে যত প্রাণ যায় যাক স্বার্থান্বেষীদের কিছু যায়-আসে না। কথায় বলে, কারো যায় ঘর পোড়া, কেউ দেয় আলু পোড়া—অবস্থাটা তেমনি। ছাত্ররা যখন অহিংস আন্দোলনে রত, তখন স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্কৃতকারীরা একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে সরকারকে বিব্রত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল। অর্থাৎ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুই. যেহেতু আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের জন্ম হতে পারে, তাই যতটা সম্ভব সতর্ক অবস্থানে থেকে আন্দোলন পরিচালনা করা এবং সবশেষে আপাতত আন্দোলন স্থগিত করে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে, নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সরকারের সংবেদনশীল মনোভাবের কথা জানানো হয়েছে। এখন দাবি আদায়ের তালিকা বৃদ্ধি এ আন্দোলনের মহতী প্রয়াসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। 

এ আন্দোলন ও সহিংসতায় ইন্ধনদাতা দলগুলোর জন্যও শিক্ষণীয় বিষয় একটাই থাকছে, আর তা হলো বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, অহিংস ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বা মদদ জুগিয়ে একটা সরকারকে কিছু সময়ের জন্য বেকায়দায় ফেলা সহজ কিন্তু তাতে ক্ষমতার সিঁড়ির নাগাল দিল্লি দুরস্ত। একমাত্র অহিংস আন্দোলন ক্ষমতার পরিবর্তন আনতে পারে বিলম্বে হলেও। অন্তত অতীতের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। 

ছয়.

সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করব, সরকার ও বিরোধী দল এবং বিশেষ করে আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ নিজ নিজ অবস্থানে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। চলমান ছাত্র আন্দোলন সমর্থনযোগ্য ছিল সন্দেহ নেই কিন্তু তার পাশাপাশি যে ধ্বংসলীলা সংঘটিত হলো তা কাম্য ছিল না। উচিত হবে অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সুরক্ষা দেয়া এবং শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের সহাবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল কেবল তারাই যেন দ্রুত আইনের আওতায় আসে, নিরীহ মানুষ যেন হেস্তনেস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখাও জরুরি। 

আশা করব আরো যে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রত্যেকেই সামনের দিকে পা বাড়াব। কিছু সৃষ্টি ধ্বংস করেছে দুষ্কৃতকারীরা, তবে এ ধ্বংসস্তূপের ছাই থেকেই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি—‘আমরা করব জয়’। 

সাত.

‘ইনলাইট অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে অক্টাভিও পাস বলছেন, ধীরে হলেও রাজনীতি কিংবা ব্যক্তি জীবনে সংকট সমাধানের সবচেয়ে নিশ্চিত পদক্ষেপ হচ্ছে সংলাপ। যত দ্রুত তা হবে তত ভালো। 

আমরা আর শুনতে চাই না পুত্রহারা মায়ের খেদোক্তি: ‘তোরা মোর ছাওয়াক। চাকরি না দিবু না দে কিন্তু মারলু ক্যানে?’

পাদটীকা: করোটিতে নচিকেতা তার গান নিয়ে উপস্থিত আছেনই ‘এক দিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে/বসতি আবার উঠবে গড়ে, আকাশ আলোয় উঠবে ভরে/জীর্ণ মতবাদ সব ইতিহাস হবে।’ 

আব্দুল বায়েস: সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন