অভিমত

ইসরায়েলের চিরস্থায়ী জরুরি অবস্থা

আহমেদ দীন রুমি

১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভাইমার প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল মাত্র ১৪ বছর। অথচ এ স্বল্প সময়েই নানা ক্ষেত্রে যে আলোচনা ও সমালোচনার শুরুয়াত ঘটিয়েছে, তার সিলসিলা এখনো বিদ্যমান। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভাইমার সংবিধানের ৪৮ ধারা। ধারা অনুসারে যেকোনো জরুরি অবস্থায় প্রেসিডেন্ট কিংবা সরকারের জন্য বলপ্রয়োগে বৈধতা পায়। আর তাতে সম্মতি উৎপাদন করেন কার্ল স্মিটের মতো তাত্ত্বিকরা। ১৯২১ সালে ‘‌অন ডিকটেটরশিপ’ এবং ১৯২২ সালে ‘‌পলিটিক্যাল থিওলজি’ প্রকাশ করেন স্মিট। তার দাবি, সার্বভৌমত্ব হলো জরুরি অবস্থা জারি করতে পারার ক্ষমতা। অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব নিজে আইন প্রতিষ্ঠার অজুহাতে আইন ভাঙার ক্ষমতা রাখে। স্মিটের এ চিন্তাকে হাল আমলের ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেন ‘‌স্টেট অব অ্যাকসেপশন’ বইতে আলোচনা করেন আরো বড় পরিসরে। তিনি মনে করেন, জরুরি অবস্থার ছুতায় স্বার্থ হাসিল করে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো। নিরাপত্তার অজুহাতে ক্ষুণ্ন করে নাগরিকের রাজনৈতিক, নাগরিক ও মানবিক অধিকার। আইন দিয়েই মানুষকে আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত করার অদ্ভুত প্যারাডক্স এটি। আর প্যারাডক্সের সবচেয়ে সফল উদাহরণ ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন। 

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চিরন্তন জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে। নাগরিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে। নিজেদের সুবিধার জন্য ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনিদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছে। ১৯৪৮ সালের আগের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের কাছে দেশীয় ফিলিস্তিনি নাগরিক। ১৯৬৭ সালের পর অধিকৃত অঞ্চলের ফিলিস্তিনিরা কেবল অধিকৃত ভূমির প্রজা। জেরুজালেমে বসবাস করা ফিলিস্তিনিরা নেহাত ফিলিস্তিনি জনতা এবং বাকিরা ডায়াস্পোরা। এভাবে ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত চলছে ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূলের কৌশলী প্রক্রিয়া। শাসিতকে বিভাজিত এবং অপরায়ণ করে রাখার এ প্রক্রিয়া হিটলারের সময়কার জার্মানির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিকে ইঙ্গিত করেই ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপ্পে তার ‘‌এথনিং ক্লিনজিং অব প্যালেস্টাইন’ বইয়ে আলোচনা এগিয়েছেন। 

ইসরায়েল কয়েকটি পথ অনুসরণ করেছে তার সার্বভৌম ক্ষমতার প্রমাণে। অধিকৃত ফিলিস্তিনের শাসন, গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা কিংবা শরণার্থী ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তন ঠেকানো। শাসনদণ্ড উঠে আসছে জরুরি অবস্থা এবং জায়নিস্টদের নিরাপত্তার অজুহাতে। অধিকৃত ফিলিস্তিনের নাগরিকরা বসবাস করে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) এবং গোয়েন্দা সংস্থা শিনবেতের নজরদারিতে। ক্ষমতাসীনের প্রশাসনিক আধিপত্য তো রয়েছেই। ফিলিস্তিনিদের হামেশা মোকাবেলা করতে হয় তল্লাশি, গ্রেফতার, চেকপয়েন্ট, কারফিউ, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া, বন্দি, উচ্ছেদ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের। সব কিছুই ঘটছে জরুরি অবস্থার চাদরে।

দখলদারত্বের রাজনীতি কেবল জীবন নিয়েই সীমাবদ্ধ থকে না, মৃত্যু নিয়েও হয়। আর এ রাজনীতির সূত্র ইসরায়েলের নিজেকে ভিকটিম মনে করা দিয়ে, যেখানে উপজাত হিসেবে তৈরি হয়েছে অভিবাসী, ফিলিস্তিনি, অধিকৃত ফিলিস্তিনি, অ-ইউরোপীয় ইহুদির মতো নানা অভিধা। অবশ্য পেছনে তাদের ইতিহাস থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার প্রভাব অস্বীকার করার জো নেই। জাতিগত রক্ষণশীলতা ও ক্ষমতাচর্চার জন্যই ইসরায়েলি ভূগোলবিদ ওরেন ইফতাহেল এবং ঐতিহাসিক ইলান পাপ্পে সেখানকার বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থাকে এথনোক্রেসি বলে অভিমত দেন। 

বসনিয়ায় সার্ব সরকারের আমলে হত্যাকাণ্ড চালানো হয় নব্বইয়ের দশকে। পাপ্পে সার্ব সরকারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েলি শাসনের তুলনা করেন। এথনিক ক্লিনজিং হলো কোনো একটা গোষ্ঠীর মাধ্যমে পদ্ধতিগত উপায়ে অন্য কোনো গোষ্ঠীকে কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থেকে বের করে দেয়া। ফিলিস্তিনের কিছু অংশের সঙ্গে সেটা ইসরায়েল করেছে। বাকি অংশের জন্য ইসরায়েল মুখবারাত স্টেট বা পুলিশি রাষ্ট্র। সেটেলার কলোনিয়ালিজমের ক্ল্যাসিক উদাহরণ দেশটি। প্রথমত, জায়নিস্টরা বিভিন্ন জায়গার দখল নিয়েছে। তারপর সেখানকার আরব নামগুলোকে হিব্রু নামের মাধ্যমে বদলে দিয়েছে। আরব সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করেছে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মাধ্যমে। বদলে দিয়েছে বেদুইন আরব গ্রামগুলোর চেহারা। তাদের বাসাবাড়ি হাতিয়ে নিয়ে বসবাস করছে জায়নিস্ট পরিবার। 

আবার ফিরে আসা যাক কার্ল স্মিটের আলাপে। অর্থাৎ সার্বভৌম নিজে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং একই সঙ্গে নিজেকে আইনের বাইরে রাখে। জরুরি অবস্থার মানেই নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখা। যারা বিদ্যমান সরকারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, তারা সমূলে ধ্বংস হবে। কারণ সার্বভৌম নিজেকেই মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করায়। ফলে সব ধরনের বিরোধী মত দূর করাকে আবশ্যক মনে করে। সার্বভৌমকে প্রতিপক্ষের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকতে হবে। এ সুরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষের জীবন নেয়া পর্যন্ত বৈধ। নাৎসি বাহিনীর সময়ে সার্বভৌমের সুরক্ষা ধারণার পরিণতি হিসেবে ইহুদিদের কনসেনটেনট্রেশন ক্যাম্পে দেয়া হয়। তৈরি হয় অপরায়ণ প্রক্রিয়া। মাত্র এক শতাব্দীর ব্যবধান। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকা ইহুদিরা তাদের ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে নাৎসি বাহিনীরই প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ আফ্রিকান তাত্ত্বিক ডেভিড থিও গোল্ডবার্গের দাবি, ‘‌ইসরায়েল কেবল ফিলিস্তিনিদের সাধারণ জাতি হিসেবে দেখে না। দেখে ঘৃণ্য এবং দানবীয় জাতি হিসেবে।’ 

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েল জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে, যে বিধিবিধান ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা জারি করেছিল। তারপর বহু সংযোজন ঘটছে আইনে। ফিলিস্তিনিরা বঞ্চিত হয়েছে মাটি, চাকরি, সম্পদ এমনকি চলাফেরার স্বাধীনতা থেকে। ফিলিস্তিনের অন্তত ৭৭ শতাংশ ভূখণ্ডকে অধিকারে নিয়েছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকাকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে দেয়াল। মানুষ ও পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে চলে তল্লাশি। নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছে আকাশ, স্থল ও জলসীমাজুড়ে। ফলে ফিলিস্তিনি জীবনের জন্য কোনো ধরনের যদি এবং কিন্তু ছাড়াই ইসরায়েল বল প্রয়োগকারী শক্তি। তাদের ওপর যে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে, সে আইনে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রশ্ন করার অধিকার নেই। ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিধিত্ব করে হামাস কিংবা পিএলও, সেটা তাদের নির্বাচনে প্রমাণিত। অথচ তাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ যাদের রয়েছে, তারা প্রতিনিধিত্ব করে না। এই যে বৈপরীত্যপূর্ণ অদ্ভুত শাসন জারি করে রাখা, এটাই জরুরি অবস্থা। 

যদিও ইসরায়েল সরকারকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। তার পরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া যায় সরকার গণতান্ত্রিক। তাহলে ফিলিস্তিনিরা যাপন করে নামমাত্র জীবন (বেয়ার লাইফ)। জর্জিও আগামবেনের পরিভাষায় বেয়ার লাইফ বা নেকেড লাইফ হলো সেই জীবন, যেখানে মানুষকে সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কেবল জীবসত্ত্বা হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়। জরুরি অবস্থায় সার্বভৌম তার নাগরিকদের বেয়ার লাইফের দিকে ঠেলে দেয়। ফিলিস্তিনিরা বর্তমান সময়ে বেয়ার লাইফের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারা বাইরের আইন দিয়ে চালিত হলেও তাদের প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত। তাদের জীবনযাপনে ফিলিস্তিনিরা আইনহীনতার মধ্যে বসবাস করে না। ঘটনা বরং বিপরীত। তারা বসবাস করে সীমাহীন ক্ষমতাচর্চার অধীনে। 

যেকোনো সংঘাতের আবশ্যক উপাদান সহিংসতা। বর্তমান হামাস-ইসরায়েল সহিংসতা অন্তত সেটাই সামনে হাজির করে। এর ব্যাখ্যায় সাহায্য করতে পারেন রাজনৈতিক দার্শনিক ফ্রানৎস ফানোঁ। কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে আলাপে ফানোঁ এমন এক ব্যবস্থার কথা বলেন, যেখানে শাসিতকে অনস্তিত্বের পর্যায়ে ফেলা হয়। অর্থাৎ তারা যেন সমাজে ঠিক হাজিরও নন, আবার গরহাজিরও নন। আগামবেনের সে জরুরি অবস্থা এবং বেয়ার লাইফের মতো। ফলে নির্যাতিত জাতি অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব জানান দিতে চায় প্রতিরোধের মাধ্যমে। অর্থাৎ যেকোনো সহিংসতা কেবল উপরি আলামত। পেছনে বড় ধরনের কারণ লুক্কায়িত থাকে। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা স্থানীয়দের মধ্যে থাকবেই। আর তাই প্রতিরোধের ভাষা সহিংস হতে বাধ্য। কারণ এ সহিংসতার যাত্রা হয়েছে জুলুমকারীর হাত ধরে। ‘‌দ্য রেচেড অব দি আর্থ’ বইয়ে তিনি লিখেন, ‘‌ক্ষমতাসীনরা সব সময় দেখায় যে কেবল বল প্রয়োগের ভাষাই কার্যকর। তারা বল প্রয়োগ করতে থাকে। সেটেলারদের বল প্রয়োগের মাধ্যমেই এক সময় স্থানীয়রা রপ্ত করে নেয় সে ভাষা। তারাও সত্যায়ন করে, উপনিবেশবাদীরা বল প্রয়োগের ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা বোঝে না।’ (ফানোঁ ১৯৬৭, ১৫-১৬)

আহমেদ দীন রুমি: লেখক ও সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন