বাংলাদেশ রেলওয়ে

রাজনৈতিক বিবেচনায় স্টপেজ বাড়ছে কি আন্তঃনগর ট্রেনের

সুজিত সাহাI চট্টগ্রাম ব্যুরো

জামালপুরের কেন্দুয়া বাজার রেলওয়ে স্টেশন ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ রেলওয়ের আন্তঃনগর ট্রেনের স্টপেজ বা যাত্রাবিরতি বাড়ছে প্রতিনিয়তই। এক্ষেত্রে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্যিক ট্রেন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের অনুরোধ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চাপ ও রাজনৈতিক বিবেচনা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ। আর এতে বিঘ্নিত হচ্ছে রেলওয়ের যাত্রীসেবা। ভ্রমণ সময় বৃদ্ধিসহ ক্রমশ বাড়ছে যাত্রী ভোগান্তি। 

রেলওয়ের তথ্যমতে, কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে রেলের অর্ধশতাধিক দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারী মানুষ আন্তঃনগর ট্রেনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু স্টপেজ সীমিত থাকায় ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাড়াতে রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালীরা নানামুখী চাপ প্রয়োগ করছে রেলওয়েকে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রেলের পূর্বাঞ্চলেই গত আট মাসে ছয়টি ট্রেনের নতুন যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছে। আরো দুটির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। যদিও ২০২০-২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে নয়টি ট্রেনের নতুন যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছিল। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর ডিও লেটারে কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনটি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার হরষপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতির অনুমোদন দেয়া হয় গত ১০ জানুয়ারি। সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী মারুফা আক্তার পপির ডিও লেটারে জুনে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন জামালপুরের পিয়ারপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতির অনুমোদন দেয়া হয়। এছাড়া গত ২৮ আগস্ট তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি অনুমোদন দেয় রেলওয়ে। এর মধ্যে জামালপুর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. খালেদুজ্জামান প্রদীপের ডিও লেটারে জামালপুর এক্সপ্রেসকে জামালপুর স্টেশনে, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-২) মো. তৌফিক ইমামের ডিও লেটারে অগ্নিবীণা ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছে কেন্দুয়া বাজার স্টেশনে। রাজনৈতিক নেতাদের ডিও লেটারে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনকে জাফরশাহী স্টেশনে যাত্রাবিরতির অনুমোদন মিলেছে। 

অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিজ নির্বাচনী এলাকাগুলোয় আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি আদায়ের মাধ্যমে স্থানীয় ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের বিভিন্ন দপ্তর আপত্তি জানালেও নানামুখী চাপে বিব্রত রেলের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো। 

রাজনৈতিক বিবেচনায় আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়ার বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। মূলত স্থানীয় জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে বিবেচনার মাধ্যমে স্টপেজ দেয়া হয়। অনেক সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সুপারিশ করলেও রেলওয়ে সবসময় অধিকসংখ্যক যাত্রীকে সেবার আওতায় নিয়ে আসা ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রয়োজনেই নতুন যাত্রাবিরতি দেয়।’

এদিকে ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সংসদ সদস্য হাফেজ মাওলানা রুহুল আমীন মাদানীর ডিও লেটারে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের বলাকা এক্সপ্রেস ও দেওয়ানগঞ্জ কমিউটারের আহম্মদবাড়ী রেল স্টেশনে যাত্রাবিরতি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২২ সালের ২২ আগস্ট রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বর্তমানে যুগ্ম সচিব) আ স ম আশরাফুল আলমের অনুরোধে অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস ট্রেনকে জামালপুরের নরুন্দি স্টেশনে, ২০২২ সালের ১ এপ্রিল ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মো. ফখরুল ইমামের অনুরোধে বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনকে আঠারবাড়ী স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয় রেলওয়ে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের বাড়তি যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছে মির্জাপুর স্টেশনে। বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনকেও দর্শনা ও চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে স্টপেজ দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। এর আগে ২০২২ সালে একই অঞ্চলে রংপুর এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনকে গাইবান্ধার নলডাঙা ও বগুড়ার তালোড়া স্টেশনে বাড়তি যাত্রাবিরতি দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

রেলের আন্তঃনগর ম্যানুয়াল অনুযায়ী, স্বল্প সময়ে দূর গন্তব্যে স্বচ্ছন্দ ভ্রমণ নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত একটি দ্রুতগতিসম্পন্ন বিশেষ শ্রেণীর ট্রেন আন্তঃনগর। এ কারণে ট্রেনগুলোয় বিরতির সংখ্যা যথাসম্ভব সীমিত থাকবে এবং গুরুত্বপূর্ণ বা জংশন ছাড়া অন্য কোনো স্টেশনে এ শ্রেণীর ট্রেনের যাত্রাবিরতি থাকবে না। আন্তঃনগর ট্রেনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতির ক্ষেত্রে এটিকেই সবচেয়ে বেশি টার্গেট করছেন স্টেশনসংলগ্ন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা। পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, রেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুরোধেও আন্তঃনগরসহ বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

রেলওয়ের বেসরকারি ট্রেন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআর ট্রেডিং ও মেসার্স টিএম ট্রেডিংয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সুরমা মেইল, নোয়াখালী এক্সপ্রেস ও কর্ণফুলী কমিউটার ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়া হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তালশহর স্টেশনে। রেলের সাবেক মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামানের ব্যক্তিগত চাহিদায় ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিজয় এক্সপ্রেসকে কিশোরগঞ্জের সরারচর স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়া হয়। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা সমিতির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবু তাহেরের প্রস্তাবে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনকে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি হাসানপুর স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়া হয়। 

রেলওয়ের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫২ অনুযায়ী, বর্তমানে অগ্নিবীণা ট্রেনের যাত্রাবিরতির সংখ্যা দুটি থেকে বেড়ে হয়েছে সাতটি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ রুটের বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতি বেড়ে হয়েছে ১০টি। ঢাকা-তারাকান্দি রুটের যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রাবিরতির সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে বেড়ে হয়েছে নয়টি। এভাবে স্বল্প দূরত্বের আন্তঃনগর ট্রেনেও অধিক যাত্রাবিরতির মাধ্যমে ভ্রমণ সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। 

দুটি নগরীর সঙ্গে সরাসরি ও দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে বিরতিহীনভাবে চলাচলকারী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়েতে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হয়। বর্তমানে আন্তঃনগর ট্রেনে ব্যাপক হারে যাত্রাবিরতি দেয়ায় রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ ও পরিবহন বিভাগের মাঠ পর্যায় থেকে আপত্তি জানানো হয় বলে জানা গেছে। রেলসংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত স্টপেজ দেয়ায় আন্তঃনগর ট্রেনের প্রতি যাত্রী আগ্রহ কমছে। সেই সঙ্গে রেলের জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি যাত্রী খাতের আয়ও কমে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ রয়েছে রেলের পরিবহন ও বাণিজ্যিক শাখা কর্মকর্তাদেরও। 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্টেশনে যাত্রাবিরতির জন্য একটি ৭০-৭৫ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেনের সর্বনিম্ন ১০ মিনিট সময় ব্যয় হয়। অর্থাৎ সর্বোচ্চ গতিতে থাকা ট্রেন নির্ধারিত দূরত্ব থেকে গতি কমিয়ে এরপর যাত্রাবিরতির কয়েক মিনিট পর ধীরগতিতে যাত্রা করে সর্বোচ্চ গতিবেগে পৌঁছতে এ সময় ব্যয় হয়। এতে ট্রেনগুলোর জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও একই রুটের অন্যান্য ট্রেনের গতি কমানো ও নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের সময় বাড়িয়ে দেবে। নতুন একটি স্টপেজের জন্য রেলওয়ের ব্যয়ও বেড়ে যায়। এতে সেবার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি রেলের পরিচালন ব্যয়েও প্রভাব পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণীর ট্রেন কমানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক ও বিশেষ বিবেচনায় দ্রুতগামী ট্রেনের যাত্রাবিরতি দেয়ার ফলে রেলওয়ের সেবার পরিমাণ কমে রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী অবশ্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কোনো আন্তঃনগর ট্রেনকে যাত্রাবিরতি দেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন অনুসারেই যাত্রাবিরতি দেয়া হয়। রাজনৈতিক নেতা কিংবা রেলপথসংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে আবেদন করলেও রেলওয়ে নিজস্ব স্বার্থ, রাজস্ব আয় ও যাত্রীসেবার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্টপেজ দেয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন