চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার

ছোট ভুলে বড় ক্ষতি

সুজিত সাহা,চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার। এর ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ছবি: আজীম অনন

চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর ও দক্ষিণ অংশকে সংযোগ করেছে দেওয়ানহাট সেতু। অর্ধশত বছরের পুরনো জরাজীর্ণ এ যোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়াতে হবে সেতুর উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য। তবে সেতুর মুখে থাকা ফ্লাইওভার ও পাশ দিয়ে যাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কারণে সেটা সম্ভব নয়। সেতুটি নির্মাণ নিয়ে তাই দেখা দিয়েছে বড় ধরনের জটিলতা। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকার করণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর যানজট নিরসনে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় দেওয়ানহাট ফ্লাইওভারটি। এটি দিয়ে যান চলাচল শুরু হয় ২০১৩ সালে। ধনিয়ালা পাড়া থেকে মনসুরাবাদ উভয় মুখে দুই লেনের এ উড়ালপথের ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আবার দেওয়ানহাট মোড়ের সঙ্গেই সংযুক্ত ৫০ বছরের অধিক পুরনো রেলওয়ে ওভারপাস বা দেওয়ানহাট ব্রিজ।  

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, আগে টাইগারপাস থেকে দেওয়ানহাটে যাওয়ার জন্য একটি সড়ক ছিল। কিন্তু ট্রেন চলাচলের কারণে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ায় ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে ১ হাজার ২২০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণ করা হয়। রেলওয়ের অর্থায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে দেওয়ানহাট সেতু নির্মাণ হলেও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। প্রতিদিন এ সেতু দিয়ে অন্তত ৭৫ হাজার ছোট-বড় যান চলাচল করে। তবে দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় সেতুটির পিলারগুলোয় এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে। কিছু অংশ ডেবেও গেছে। 

নির্মাণকালে দেওয়ানহাট ব্রিজের উচ্চতা ছিল ছয় মিটার। যদিও রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ সম্প্রতি এর উচ্চতা পরিমাপ করে ৫ দশমিক ৬ মিটার পেয়েছে। সেতুটির কিছু অংশ ডেবে যাওয়ায় উচ্চতা কমে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। জরাজীর্ণ এ সেতু দিয়ে এখন যান চলাচলও ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি রেলওয়ের ব্রড গেজ ট্রেন কিংবা দ্বিতল ট্রেনের উচ্চতার সঙ্গে বর্তমান দেওয়ানহাট সেতুর উচ্চতা সাংঘর্ষিক হওয়ায় দ্রুতই এর স্থলে নতুন সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেয়া হয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে।  

রেলওয়ের নিয়ম অনুসারে যেকোনো রেলপথের ওপর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা রাখতে হয় ন্যূনতম সাড়ে আট মিটার। ফলে নতুন করে নির্মাণ করতে হলে দেওয়ানহাট সেতুটির বর্তমান উচ্চতা ৫ দশমিক ৬ মিটারের সঙ্গে আরো ২ দশমিক ৯ মিটার বাড়াতে হবে। তাতে সেতুর দৈর্ঘ্যও অনেক বেড়ে যাবে। সড়ক অবকাঠামো বাস্তবায়নকারী চট্টগ্রামের সরকারি সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, ধনিয়ালা পাড়া থেকে আসা ফ্লাইওভার এবং এর ওপর আড়াআড়িভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকায় দেওয়ানহাট সেতুটির দৈর্ঘ্য কোনোভাবেই বাড়ানোর সুযোগ নেই। আবার ফ্লাইওভারের নিচ দিয়েও এটি নির্মাণ সম্ভব নয়। ত্রিমুখী এ জটিলতার কারণে চট্টগ্রাম নগরীকে সংযোগকারী সেতুটি পুনর্নির্মাণ নিয়ে গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ হিসেবে গত বছর সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের চলমান প্রকল্পের অধীনে দেওয়ানহাট সেতুটি নির্মাণের জন্য সিডিএকে প্রস্তাব দেয় সিটি করপোরেশন। যদিও এতে আপত্তি জানায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে চসিকের পক্ষ থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অধীনে দেওয়ানহাট সেতু পুনর্নির্মাণের অনুরোধ করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হলেও সেটি অনুমোদন হয়নি। সিডিএর দায়িত্বে নতুন চেয়ারম্যান আসার পর দেওয়ানহাট সেতু নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রেলওয়ে সাড়ে আট মিটারের ঊর্ধ্বে সেতু নির্মাণের বাধ্যবাধকতা তুলে না নিলে দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানতে চাইলে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকায় নতুন করে দেওয়ানহাট সেতুটি নির্মাণ করা হলেও সাড়ে পাঁচ মিটারের বেশি উঁচু করা যাবে না। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে হলেও রেলওয়েকে এ বিষয়ে ছাড় দিতে হবে।’

এদিকে রেলওয়ে বলছে, নির্ধারিত উচ্চতায় টাইগারপাস ও দেওয়ানহাটের মধ্যে একটি নতুন সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু রেলের আইন ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগের উচ্চতায় কোনোভাবেই তা নির্মাণ করা যাবে না। আবার দেওয়ানহাট মোড়েই আড়াআড়িভাবে দুটি উড়ালপথ থাকায় দেওয়ানহাট সেতুর উচ্চতা ও দৈর্ঘ্য বাড়ানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সিডিএ ও সিটি করপোরেশনকে ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে সেতুটি পুনর্নির্মাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সড়কের গতিপথ পরিবর্তন কিংবা দেওয়ানহাট মোড়ের ধনিয়ালা পাড়া ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বলে মনে করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো অবস্থায়ই রেললাইনের ওপর নির্ধারিত উচ্চতার কমে সেতু নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হবে না। দেওয়ানহাট ব্রিজের বর্তমান উচ্চতার চেয়ে আরো প্রায় তিন মিটার উঁচু সেতু নির্মাণের নকশা করতে হবে সিডিএ কিংবা সিটি করপোরেশনকে। এক্ষেত্রে নির্মাণ পরিকল্পনার আগে রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয় ও অংশগ্রহণ জরুরি।’ 

চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানহাট থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে বলে রেলওয়েসংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তারা জানান, টাইগারপাসে এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও নকশা তৈরি করলেও রেলের অনুমোদন নেয়া হয়নি। শুধু শেষ মুহূর্তে এসে রেলের কাছে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। দেওয়ানহাটে ফ্লাইওভার নির্মাণ করায় পুরনো সেতুটি নতুন করে নির্মাণের ক্ষেত্রেও বড় সংকট তৈরি হবে। এক্ষেত্রে সেতুটি নতুন করে নির্মাণে চট্টগ্রামের সব সরকারি সংস্থার যৌথ সমন্বয় ছাড়া এ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তারা। 

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকার মতো চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও নাজুক হয়ে উঠছে। একের পর এক বড় অবকাঠামো নির্মাণ হলেও এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় নেই। দেওয়ানহাটের সেতুটি ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ করতে একাধিক অবকাঠামো ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না। দেওয়ানহাট, টাইগারপাস ও লালখান বাজারে যেভাবে একাধিক ফ্লাইওভারে ওঠানামার র‍্যাম্প রাখা হয়েছে তাতে মূল সড়কের যানবাহন চলাচলও চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।’


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন