বেশি পুড়ছে উত্তরাঞ্চল

৫ দিনের ব্যবধানে দেশ দ্বিতীয় দফায় তীব্র তাপপ্রবাহের মুখে

নিজস্ব প্রতিবেদক

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র তাপপ্রবাহ যে জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, সে সতর্কতা অনেক আগেই মিলেছিল। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। এর মধ্যে ১৯ মে শুরু হয় মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ, চলে ২৩ মে পর্যন্ত। বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হলে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু পাঁচদিন যেতে না যেতেই ২৯ মে থেকে আবার তাপপ্রবাহের মুখে পড়ে দেশ। মাঝারি ও তীব্র সেই প্রবাহটি আরো সপ্তাহখানেক স্থায়ী হতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। 

দিনের পর রাতেও অস্বস্তিকর আবহাওয়া। বৃষ্টির মাস জুনেও দহন থেকে রেহাই মিলছে না। প্রায় প্রতিদিনই রোদের তাপে পুড়ছে দেশ। মানুষের পাশাপাশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ধান, পাট, কলা, আম, লিচুসহ নানান ফসল। এদিকে পাঁচদিনের ব্যবধানে দুটি তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাকেই সামনে এনেছেন পরিবেশবিদরা। কার্বন নিঃসরণ না কমাতে পারলে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসতেই থাকবে বলে তাদের অভিমত। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রমতে, দেশের উত্তর জনপদে অব্যাহত রয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে গরম হাওয়ায় অস্বস্তিতে জনজীবন। অস্বাভাবিক এ আবহাওয়ায় প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এতে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। দিনাজপুরে গত রোববার তাপমাত্রার পারদ গিয়ে চড়ে ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। একই দিন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এও জানিয়েছেন, দিনাজপুরে গত ৬৫ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ১৯৫৮ সালের জুন মাসে এ জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। 

দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দিনাজপুরসহ এ অঞ্চলে গত ১০ দিন থেকে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। দিনাজপুরে রোববার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে গত ১ জুন এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পরদিন অর্থাৎ ২ জুন রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩ জুন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আজ (গতকাল) দিনাজপুরে তাপ কিছুটা কমে এসেছে, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’    

দাবদাহের সঙ্গে এ জনপদে বইছে তীব্র গরম হাওয়া। এটি ‘লু’ হাওয়া কিনা জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদরা জানান, সাধারণত মরুভূমির গরম বাতাসকে বলা হয় লু হাওয়া। তবে এ জনপদে যে গরম বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে এটিও সে হাওয়ার মতোই। 

আবহাওয়াবিদদের তথ্যানুযায়ী, কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা যদি ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮ ডিগ্রি থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয় যখন তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। আর অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয় ৪২ ডিগ্রি বা তার বেশি তাপমাত্রা বয়ে গেলে। দিনাজপুরে তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হওয়ায় এ অঞ্চলে এখন বিরাজ করছে তীব্র তাপপ্রবাহ। চলমান এ দাবদাহ আরো এক সপ্তাহের মতো অব্যাহত থাকতে পারে।

দেশে ঘন ঘন তাপপ্রবাহের কারণ জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশ পুরোটাই এখন উত্তপ্ত। যদি মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকত এবং যথাসময়ে মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হওয়া আরম্ভ করত, তাহলে ভারতীয় উপহাদেশ তথা দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, মেঘালয়, মিয়ানমার, অরুণাচল, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড এসব অঞ্চলের আকাশে সারি সারি মেঘ তৈরি হতো এবং থেমে থেমে বৃষ্টি হতো। যেহেতু সময়মতো সৌসুমি বায়ু আসছে না, সে কারণে বৃষ্টিপাতের অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে। বিদ্যমান তাপপ্রবাহের এটাই একমাত্র কারণ।’ 

এ আবহাওয়াবিদ আরো বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের আকাশ এখন একেবারেই মেঘমুক্ত। ফলে সূর্যের প্রখর আলো উদয় থেকে অস্ত পর্যন্ত আসতে থাকে। আমাদের এ অঞ্চল দিনের পর দিন বেশ উত্তপ্ত হয়। তাছাড়া বাতাস যদি জোরে প্রবাহিত হতো তাহলেও একটু ঠাণ্ডা লাগত। বাতাসের গতিবেগ কম কিন্তু জলীয়বাষ্পের পরিমাণ অনেক বেশি। দিনের এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কম। এসব কারণ এবং নিচের বাতাস ওপরে না যাওয়া এবং ওপরের ঠাণ্ডা বাতাস নিচে না নামাও একটা বড় কারণ তাপপ্রবাহের।’

তীব্র তাপপ্রবাহ ও পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ বা ‘লু’ হাওয়ার বিরূপ প্রভাব পড়েছে দিনাজপুরের লিচুবাগানে। শত শত বাগানের লিচু পুড়ে গাছেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। এতে লিচু ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকদের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। দিনাজপুরের বিরল, কাহারোল, বীরগঞ্জ, খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলার বিভিন্ন লিচুবাগান ঘুরে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা, বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ভরা মৌসুমে এ ধরনের দুর্যোগের চিত্র সামনে এসেছে।  

লিচুবাগান মালিক ও মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৩১ মে পর্যন্ত প্রতিটি গাছে লিচু ভালো ছিল। কিন্তু ১ জুন থেকে টানা চারদিন জেলায় তাপমাত্রা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে গরম বাতাস প্রবাহিত হয়। এতে গাছের পাকা ও আধপাকা লিচু গাছেই শুকিয়ে যাচ্ছে। লিচুর গায়ে ফোসকা বা পুড়ে যাওয়া দাগ হতে শুরু করেছে।

বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উপজেলায় ২ হাজার ৫৫৮ হেক্টর জমিতে লিচুবাগান আছে। দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে উপজেলার ৫০ ভাগ বোরিং থেকে পানি উঠছে না। বৃষ্টি না হওয়ার সুফল যেমন আমরা বোরো ধানে পেয়েছি, তেমনি এর বিপরীত চিত্র পাচ্ছি লিচুতে। প্রচণ্ড তাপে হাজার হাজার গাছের লিচু ফেটে ফোসকা পড়ে গেছে। বৃষ্টির মতো করে সন্ধ্যার পর প্রতিটি গাছে পানি স্প্রে করতে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’

তবে বর্তমানে মাঠে ফসল কম থাকায় গত এপ্রিলের তাপপ্রবাহের মতো মারাত্মক প্রভাব পড়ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মাঠে এখন সেভাবে ফসল নেই। বোরোসহ গুরুত্বপূর্ণ ফসল উঠে গেছে। তাপপ্রবাহের কারণে কিছু ফলের ক্ষতি হচ্ছে। যেসব লিচুতে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ছে সেগুলোর চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। ফসল বা বিভিন্ন ফল গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি প্রকৃতিকে নিয়েই। তাপপ্রবাহের কারণে হয়তো কিছুটা উৎপাদন কম হতে পারে। কিন্তু একেবারেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা নয়।’

অনবরত কার্বন নিঃসরণ ও বৃক্ষ নিধন না কমাতে পারলে সামনের দিনগুলো আরো দুর্যোগপ্রবণ হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান বৈরী আবহাওয়া তাপপ্রবাহ আসলে অনবরত কার্বন নিঃসরণ ও বৃক্ষ নিধনের ফল। শৈত্যপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, খরা এসব দুর্যোগ জলাবায়ুজনিত ক্ষতির দৃশ্যমান প্রভাব। তাই এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, এমন দুর্যোগ আরো আসবে এতে সন্দেহ নেই।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন