স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর একটি অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। ১২ দিনের সফর শেষে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেছেন চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অলিভিয়ার ডি শ্যুটার।
গতকাল রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় অলিভিয়ার ডি শ্যুটার উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশবিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদন মানবাধিকার কাউন্সিলে পেশ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘জনগণকে দরিদ্রতার মধ্যে রেখে একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না। বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো একটি রফতানি খাত দ্বারা চালিত, যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।’
সংবাদ সম্মেলনে অলিভিয়ার আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসনে সাফল্য দেখিয়েছে। সামগ্রিকভাবে আয়বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও সাধন করেছে। কিন্তু এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্য রয়ে গেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আয়বৈষম্য বেড়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃত অগ্রগতি অর্জন করলেও তাতে ভঙ্গুরতা রয়েছে।’
ডি শ্যুটার সরকারকে ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে আসন্ন উন্নীতকরণের সুযোগকে ব্যবহার করে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর তার নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যত উন্নীতকরণের পথে এগোচ্ছে, তত এটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স-প্রণোদনা প্রদান এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে।’
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, কর্মীদের শিক্ষিত করা ও প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সামাজিক সুরক্ষার উন্নতিতে সরকারকে আরো বেশি সময় ও সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। এ-জাতীয় উদ্যোগ শুধু বিনিয়োগকারীদেরই আকৃষ্ট করবে না, এটি বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি নতুন রূপরেখা তৈরি করবে, যা বৈষম্যমূলক রফতানি সুযোগের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দ্বারা চালিত হবে।’
বিশেষ প্রতিবেদক স্বাধীনভাবে কাজে বিশ্বাসী সুশীল সমাজের ওপর সরকারের এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ আইনের অধীনে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার প্রয়োগের কারণে আটক করা হয়েছে।’
ডি শ্যুটার সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো যৌক্তিক করার জন্য আহ্বান জানান। বিশেষ প্রতিবেদকের মিশনের অংশ হিসেবে কক্সবাজার সফর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডি শ্যুটার শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য জনাকীর্ণ দেশ বাংলাদেশ সরকারকে অভিবাদন জানানোর পাশাপাশি আশ্রয়শিবিরের বসবাস অনুপযোগী অবস্থার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রত্যাবাসনের শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের একটি স্বচ্ছন্দ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়েরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।’”
বিশেষ প্রতিবেদক জানান, এটি অনভিপ্রেত যে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাশিবিরে জরুরি মানবিক প্রয়োজন মোকাবেলায় ৮৭৬ মিলিয়ন ডলারের যৌথ পরিকল্পনার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক দাতারা এতই কম অবদান রেখেছেন যে চাহিদার মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ অর্থায়ন জোগাড় হয়েছে।
ডি শ্যুটার সতর্ক করেন, অপুষ্টি ও যথেষ্ট পুষ্টির অভাব বাড়বে, বিশেষ করে শিশুদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। তার ভাষায়, ‘পরিবারগুলো মরিয়া হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ সরকার যদি রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং মানবাধিকার আইন অনুযায়ী তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ করে দেয়, তাতে অন্তত তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।’