ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র

বেসরকারি আইপিপিতে বেশি দামের বিদ্যুৎ ফেনী লংকার কম ইউনাইটেড পাওয়ারের

আবু তাহের

চাহিদার ভিত্তিতে প্রতিদিনই ফার্নেস অয়েলচালিত (এইচএফও) বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এসব কেন্দ্রের বড় একটি অংশ রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ের স্বতন্ত্র উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) মালিকানায়। বেসরকারি আইপিপি  থেকে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বা ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ কিনতে বিপিডিবির খরচ পড়ছে সর্বোচ্চ ১৯ টাকা ৮৯ পয়সা থেকে সর্বনিম্ন ১২ টাকা ৮০ পয়সা।

বিপিডিবির এপ্রিলের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের এক তালিকা পর্যালোচনা দেখা যায়, বেসরকারি আইপিপিগুলোর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত ফেনী ১১৪ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির খরচ পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়েছে ১৯ টাকা ৮৯ পয়সা। এটি শ্রীলংকার আইপিপি খাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান লাকধানাবি লিমিটেডের সাবসিডিয়ারি ফেনী লংকা পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সবচেয়ে কম মূল্যে মিলছে চট্টগ্রামে ইউনাইটেড গ্রুপ পরিচালিত আনোয়ারা ৩০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টে। কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়েছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা।

সাধারণত দৈনিক চাহিদার ভিত্তিতে বিপিডিবি পিক লোডের পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনে। বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি হিসাবের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ব্যয়, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসাব করা হয়। এর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার দাম নির্ধারণ করে বিপিডিবি। 

বিপিডিবির এপ্রিলে ফার্নেস অয়েলচালিত বেশির ভাগ আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় খরচ হয়েছে ১৩-১৬ টাকার মতো। যদিও বছর শেষে গড় হিসাবে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ১৪-১৫ টাকার মতো খরচ পড়ছে সংস্থাটির। 

আইপিপি খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ নির্ভর করে জ্বালানি আমদানি ব্যয় এবং বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণের ওপর। আইপিপিগুলো নিজেরা জ্বালানি আমদানি করলে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম পড়ে ৬৫-৭০ টাকার মতো (৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ)। তবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছ থেকে ফার্নেস অয়েল কিনতে লাগে লিটারপ্রতি ৮৫ টাকা। বেশি দামে ক্রয়কৃত জ্বালানির বিদ্যুৎ কিনলে বিপিডিবির খরচও পড়ে বেশি। মূলত ব্যয় বিবেচনায়ই ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কম কেনে বিপিডিবি।

জানতে চাইলে কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিআইপিপির সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ নির্ভর করে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনা ও জ্বালানি ব্যয়ের ওপর। বিপিডিবি কম বিদ্যুৎ কিনলে এবং জ্বালানির দাম বেশি পড়লে সেক্ষেত্রে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিজেলের বাইরে অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন খরচ বরাবরই বেশি। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আমদানীকৃত ফার্নেস অয়েলের ওপর সরকারের ট্যাক্স রয়েছে ৩৪ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ এ ট্যাক্স বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হলে বিদ্যুতের দামও বেশি পড়ে। 

দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যোক্তা সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপি) বলছে, জ্বালানি আমদানিতে শুল্কের তারতম্যের কারণেই এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় পড়ছে বেশি।  

বিআইপিপির সভাপতি ফয়সাল খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে এইচএফওর ওপর অন্যান্য জ্বালানির তুলনায় ট্যাক্স অনেক বেশি। এটি সমান হওয়া উচিত। তাহলে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে মেরিট ডিসপাচ অর্ডার অনুযায়ী এইচএফওভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অগ্রাধিকার পাবে।’

এইচএফও জ্বালানির ওপর ট্যাক্স কমাতে এরই মধ্যে আইপিপি খাতের উদ্যোক্তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে এইচএফওর ওপর রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স ২২ শতাংশ করার আহ্বান জানানো হয়।

বর্তমানে এইচএফও ছাড়া আমদানীকৃত এলএনজির ওপর এনবিআরের শুল্ক আরোপ করা রয়েছে ২২ শতাংশ। আর আমদানীকৃত কয়লার ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ।

বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর তালিকায় বর্তমানে এইচএফওভিত্তিক আইপিপির বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৩৭টি। এপ্রিলে এইচএফও কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ গড় হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়েছে গড়ে ১৪-১৫ টাকার মতো।

দেশে বর্তমানে এইচএফওচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ৬ হাজার ২৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন তালিকায় রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার (৪ হাজার ৩৭৭) মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যদিও আইপিপিগুলো বলছে, তাদের আওতাধীন ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে জ্বালানি তেলে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বিপিডিবি আড়াই হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিচ্ছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির উৎপাদনসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে সংকট রয়েছে। আইপিপিগুলোর বকেয়া পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। এ কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে চাহিদার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ নেয়া হচ্ছে।’

২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবি আইপিপি খাত থেকেই টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কিনছে। সংশ্লিষ্ট অর্থবছরে মোট ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে। আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ইউনিটপ্রতি খরচ পড়েছে ১১ টাকা ৫৫ পয়সা। আর এসব বিদ্যুৎ কেনার ৯৫ শতাংশ খরচ হয়েছে এইচএফওচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনায়।

বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনার তালিকায় যুক্ত হয়েছে আইপিপির সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রও। গত কয়েক বছরে তিন মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে ২০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বিপিডিবির এপ্রিলের বিদ্যুৎ কেনার প্রতিবেদন অনুযায়ী এখনো সৌর থেকে বিদ্যুৎ কিনতে কিলোওয়াটপ্রতি ১৪-২১ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিলে সৌরবিদ্যুৎ কিনতে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে নির্মিত তিন মেগাওয়াটের সোলার পাওয়ার প্লান্ট। কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির খরচ পড়ছে ২০ টাকা ৩০ পয়সা। আর সবচেয়ে কম খরচ পড়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া আট মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে খরচ হয়েছে ১৩ টাকা ৯১ পয়সা।

দেশের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত থাকা সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র গাইবান্ধা জেলায় নির্মিত ২০০ মেগাওয়াট তিস্তা সোলার পাওয়ার প্লান্ট। এপ্রিলে কেন্দ্রটির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৬ টাকা ৫ পয়সা।

বিপিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন তালিকায় আইপিপি খাতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চারটি। অতিপ্রয়োজন ছাড়া এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র না চালালেও বিপিডিবির হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ২৯ টাকা। মূলত প্যারামাউন্টের ডিজেলভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্র সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে নির্মিত। ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ বিদ্যুৎকেন্দ্র রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন