সিপিডির জরিপ

অর্থ পাচারকে বড় চ্যালেঞ্জ বলছেন ৪৪% ব্যবসায়ী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল তুলে ধরে সিপিডি ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশের ব্যবসায় পরিবেশের উন্নতি হয়নি। উল্টো ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর ব্যবসা পরিচালনাসংক্রান্ত কোনো কোনো সূচকের অবনতি হয়েছে। কোনোটি স্থবির রয়েছে। ব্যবসায় উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল দুর্নীতি। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, দেশের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ পাচার। আর পাচার ঠেকানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন তারা। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদনে তথ্য উঠে এসেছে।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২২ শীর্ষক উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহযোগিতায় পরিচালিত হয় জরিপ। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক . খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সময় উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী পরিচালক . ফাহমিদা খাতুনসহ সংস্থাটির গবেষক কর্মীরা। সিপিডি জানায়, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ গাজীপুরের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বড় এসএমএই খাতের ৭৪টি কোম্পানির উদ্যোক্তাদের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি পরিচালিত হয়। এটি যদিও দেশের সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করে না।

২০২২ সালে ব্যবসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল দুর্নীতি এমন তথ্য জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ী মোটা দাগে দুর্নীতিকে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন। উচ্চহারের দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংক থেকে অর্থায়ন সমস্যা তিনটি চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের ব্যবসার ক্ষেত্রে। অর্থনীতিতে সনাতনী এসব সমস্যার সঙ্গে আরো কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়ে ব্যবসার পরিবেশকে জটিলতর করে চলেছে বলেও জানানো হয়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের কাছে মোটা দাগে যেটা মনে হয়েছে, ২০২১-২২ সময়ে বাংলাদেশের ব্যবসায় পরিবেশের আসলে উন্নতি হয়নি। বরং এক ধরনের অবনমন ঘটেছে। অবনমনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটা বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা, যেটা সবসময়ই থাকে। সে সমস্যা এখনো একটা বড় দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে আমাদের কাছে রয়ে গেছে। এর সঙ্গে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির দুর্বলতা অদক্ষ প্রশাসন জায়গাগুলো এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। পাশাপাশি নতুন যে চ্যালেঞ্জগুলো যুক্ত হয়েছে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা নীতিকাঠামোর অস্থিতিশীলতা ব্যবসার পরিবেশকে আরো বেশি জটিলতর করছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক বেশকিছু চ্যালেঞ্জ, প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, সামাজিক চ্যালেঞ্জ আর্থিক চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকিগুলোও কিন্তু আগামী দিনে ব্যবসার পরিবেশকে খুব মসৃণ রাখবে বলে মনে হচ্ছে না।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশকে এখনই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনকে মাথায় রেখে রূপান্তর উদ্যোগগুলো, ঝুঁকিগুলোকে মাথায় রেখে সাজানো দরকার বলে আমরা মনে করি। ঝুঁকিগুলোর ব্যাপারে পর্যাপ্ত ডিসকাউন্ট করে সেই অনুযায়ী আমাদের নীতি কৌশল এবং কার্যক্রমগুলো ঢেলে সাজানো দরকার। যেখানে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশগত ঝুঁকি এড়ানো এবং একই সঙ্গে গ্রিন ক্লিন গ্রোথের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া ধরনের কৌশল নেয়ার প্রয়োজন পড়বে। বর্তমানে যেসব নীতি কৌশল রয়েছে, এগুলো যখন পুনর্মূল্যায়ন, পুনর্বিন্যাস হবে তখন নতুন ধরনের জায়গাগুলো যেন সামনে ফুটে ওঠে। বছর যেহেতু নির্বাচনের বছর, রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়গুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার সাজাবে বলে আমাদের বড় প্রত্যাশা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের আধিপত্য বাড়ার বিষয়টিও গতকাল ফলাফল প্রকাশকালে জানিয়েছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বড়দের অনেক পথ রয়েছে। ছোটরা তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা বড়দের আধিপত্য রয়েছে।

প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়, ব্যবসায়ীরা আগামী দুই বছরের জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধারাবাহিক মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকঋণ, পণ্যমূল্য, সামাজিক ঝুঁকি জীবনযাপন ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, সংক্রমিত রোগ, ডিজিটাল অসমতা মানবসৃষ্ট পরিবেশ প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশ ঝুঁকির মতো বিষয়গুলো রয়েছে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং এসব বিষয়ে কীভাবে সমাধান করবে তার প্রতিশ্রুতি থাকার সুপারিশ করছি।

আর্থিক খাতের নতুন কোনো ভালো খবর নেই বলে ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন গোলাম মোয়াজ্জেম। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) নজরদারিতে (ওভার সি) দুর্বলতা দেখা গেছে বলেও জানিয়ে সিপিডি। আর্থিক খাতে পুরো সংস্কার প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিবেদনের মান নিয়ে প্রশ্ন, সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন বিও হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও সিপিডি মনে করে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক . ফাহমিদা খাতুন বলেন, সারা বিশ্ব এখন একটি অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ। যার মধ্যে খাদ্য জ্বালানি সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। যার ফলে বিশ্বের বড় বড় দেশ অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মন্দা ভাব থাকবে। এটা থেকে উত্তরণ হচ্ছে না। এসব কারণে বাংলাদেশের মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ ওইসব মূল্যস্ফীতির কারণে হাবুডুবু খাচ্ছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা এক ধরনের চাপে রয়েছেন।

. ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, ২০২২-এর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত যে জরিপকাজ হয়েছে, ওই সময়ের পরে আগস্ট, ডিসেম্বর জানুয়ারিতে বেশকিছু নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সময়ে বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, যার চাপ ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছবে। মুদ্রাস্ফীতির চাপ আরো বাড়বে। এর পাশাপাশি রফতানিকারক শিল্পগুলো উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে রফতানি সক্ষমতা কমে এলে বড় একটি প্রভাব পড়বে রফতানি খাতে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনিতেই কমার দিকে, সেখানে এমন সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন