আলোকপাত

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ভরসা রাখতে হবে

ড. আর এম দেবনাথ

হঠাৎ করে দেশে/ব্যাংক খাতে এমন কী ঘটল বাংলাদেশ ব্যাংককে মাঠে নামতে হলো? বলতে হলো, ব্যাংকে টাকার অভাব নেই। রয়েছে প্রচুর তারল্য (লিকুইডিটি), যা দিয়ে গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাবে। বলতে হলো, দেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, সরকারি ব্যাংকগুলোও এখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলছে আমানতকারীদের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ অবস্থায় আছে। গত রোববারই কাগজে দেখলাম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের একটা বিজ্ঞপ্তি। এতে বলা হচ্ছে, তাদের গ্রাহকসংখ্যা সোয়া দুই কোটি। এদের আমানত হচ্ছে লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। বলা হয়েছে, এদের কোনো তারল্য সংকট নেই। বরং তারল্য উদ্বৃত্ত। তার মানে তাদের হাতে যে টাকা আছে তা গ্রাহকের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে। এরই মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি দেখেছি। অবশ্য কোনো বেসরকারি ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি দেখিনি। প্রশ্ন হলো, এসব বিজ্ঞপ্তি, আশ্বাসের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? কোনো ব্যাংকে গ্রাহক টাকা তুলতে গিয়ে কি টাকা তুলতে পারেননি? কোনো ব্যাংক টাকা তুলতে গেলে কি বলেছে, পরে আসুন, হাতে এখন টাকা নেই। না, এমন কোনো খবর অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যা চোখে পড়ে তা হচ্ছেব্যাড পাবলিসিটি বারবার খেলাপি ঋণের তথ্য/পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হচ্ছে, ব্যাংকের সব টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে, সব পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা, কিছু মিডিয়া এসব খবর দিচ্ছে। তবে কি তাদের এসব আতঙ্ক বাণীতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে? জানি না হতেও পারে। কথা ঠিক ব্যাংক ব্যবসা, ব্যাংকের পরিস্থিতি বিশেষ করে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আলোচনার জন্য খুবই জনপ্রিয় একটা বিষয়। খেলাপি ঋণের বিষয়ে যে যাই বলুক না কেন তা সবাই বিশ্বাস করতে চায়। এসব টাকা ফেরত আসবে না, এসব টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এই হচ্ছে লোকমনের ধারণা। এটা সমস্যার এক দিক। এর বিপরীতে আরেকটি দিক রয়েছে যা আলোচনায় আসে না। বিষয়টি হচ্ছে আমানত ঋণ ব্যবস্থাপনায়। কীভাবে ব্যাংক তা করে সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই কমএমনকি মধ্যবিত্তেরও যেমন আমানতআপনার/আমারক্যাশব্যাংক জমা দিলেই তা হয়ে যায় ডিপোজিট, যা ব্যাংকের লায়াবিলিটি বা দায়। ব্যাংক তা ফেরত দিতে চাহিবামাত্র বাধ্য। ব্যাংক ডিপোজিটের টাকা কী করে? যেহেতু আমানতের ওপর সুদ দিতে হয় তাই ব্যাংক আয় বাড়ানোর জন্য তা ঋণগ্রহীতাদের একটু বেশি সুদে ঋণ দেয়। সব টাকা কী দিয়ে দেয়! না ডিপোজিটরদের টাকার, আমার জানা মতে, মুহূর্তে ১৭-১৮ শতাংশ টাকা ব্যাংক হাতে রাখে। বাকি টাকা ঋণ হিসেবে দিয়ে দেয়। তার থেকে সুদ আসে এবং বিপরীতে আমানতের ওপর সুদ দেয় ব্যাংক। এখন অবস্থায় যদি সব আমানতকারী একযোগে দলবেঁধে একদিন সকাল বেলা ব্যাংকে গিয়ে বলে, আমাদের টাকা ফেরত দাও তাহলে কী দাঁড়াবে? এর উত্তর সোজা; কোনো ব্যাংক, বিশ্বের কোনো ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না, যদি না কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাস্ট রিসোর্ট হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে টাকা দিয়ে উদ্ধার করে। তবে ব্যাংক ব্যবসার মজা হচ্ছে মানুষ যত আমানত রাখে তত টাকা একসঙ্গে তোলে না। যদি সব টাকা সবাই তুলত তাহলে ব্যাংক ব্যাংক হতো না। তবু এখানে একটা রক্ষাকবচ করা ছিল কিছুদিন আগেও। মেয়াদি আমানত মেয়াদের পর ভাঙানো হবে এটা সাধারণভাবে জানা। কিন্তু সঞ্চয়ী আমানতের টাকা। এই কিছুদিন আগেও ব্যাংকে ব্যাংকে নিয়ম ছিল সঞ্চয়ী আমানত থেকে সপ্তাহে এক/দুই দিন টাকা তোলা যাবে এবং সর্বোচ্চ কত টাকা তা বলা থাকত। এর বেশি টাকা তুলতে হলে অগ্রিম নোটিস দিতে হতো যে আমি টাকা তুলব সর্বোচ্চ সীমার ঊর্ধ্বে। এতে ব্যাংক টাকা জোগাড় করে রাখতে পারত যাতে গ্রাহক ফেরত না যায়। এখন এত ব্যাংক হয়েছে, প্রতিযোগিতার কারণে বাজার অর্থনীতির চাপে এসব নিয়মচাঙ্গেউঠেছে। যে কেউ যত টাকা দরকার তা তুলতে পারে। কোনো শাখায় হঠাৎ টাকা উত্তোলন বেশি হতে পারে যে টাকা শাখায় নেই। এতে কোনো অসুবিধা নেই। মুহূর্তের মধ্যে শাখা প্রধান কার্যালয়ের সাহায্যে সে টাকা জোগাড় করে গ্রাহকদের দিয়ে দেয়। কেউ টাকার অভাবে ফেরত আসে তা শোনা যায় না। ব্যাংকের ক্রেডিট/বৈদেশিক কার্যক্রম সম্পর্কে নানা অভিযোগ শোনা যেতে পারে। কিন্তু টাকা তুলতে, টাকা জমা দিতে কারো কোনো অসুবিধা হয়েছে, ‘ঘুসদিতে হয়েছে বলে খবর পাওযা যায় না। এইটাইম স্টেটেডব্যবস্থায় ব্যাংক চলে, চলছে ৫০-৫২ বছর ধরে। কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংককে বন্ধ হতে দেয়নি।

অসুবিধা হয়েছে সাবেকবিসিসিআই’ (বর্তমান ইস্টার্ন ব্যাংক) ব্যাংক নিয়ে যা আন্তর্জাতিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অসুবিধা হয়েছেআল-বারাকা ব্যাংক’ (বর্তমান আইসিবি ইসলামিক) নিয়ে।ন্যাশনাল ক্রেডিটএবংবিসিআইনামীয় দুটি বিনিয়োগ কোম্পানির অসুবিধা হয়েছিল। অসুবিধা হয়েছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক (বিএসবি) এবংবিএসআরএসনিয়ে এবং অতি সাম্প্রতিককালে বড় অসুবিধা হয়েছিল বর্তমান পদ্মা ব্যাংকের পূর্বতন ব্যাংক নিয়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেছে। ব্যাংকগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্জন্ম দেয়া হয়েছে, নতুন ব্যাংক তৈরি করে দেয়া হয়েছে। আমানতকারীরা তাদের আমানত হারাননি। সবাই দেরিতে হলেও টাকা ফেরত পেয়েছেন। প্রেক্ষাপটেই বোধ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমান গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে বাজারে নেমেছে। সবাইকে আশ্বস্ত করছে, ব্যাংক বন্ধের কোনো আশঙ্কা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন গ্যারান্টি দেয় তখন আর সংকটের সম্ভাবনা থাকে না। কারণ ব্যাংকটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রক ব্যাংক যে সব ব্যাংকের তদারকি করে। কারণেই বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, হয়তো নতুন নামে চালু হয়েছে/রয়েছে। যেমন পদ্মা ব্যাংক। যদিও এটি বেসরকারি ব্যাংক তবু কিন্তু এর শেয়ার মালিকানায় সব সরকারি ব্যাংক। সাময়িক অসুবিধা হলেও এখন তা আর নেই। বস্তুত কথা হচ্ছে, কোনো সরকারই কোনো ব্যাংক রসাতলে যাক তা চাইতে পারে না। তাহলে আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হবে দেশ। বাজার অর্থনীতির ঠাকুরদা দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১০-১৫ বছর আগে আর্থিক বিপর্যয়ের সময়ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়নডলার দিয়ে সে দেশের ব্যাংকগুলোকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে। কই তারা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারত, ব্যাংক মরছে তো মরুক। না, তা তারা করেনি। এটাই সর্বত্র বিরাজমান নীতি যদি না কোনো দেশআত্মহত্যারপথ বেছে নেয়।

এই তো গেল আমানতের কথা। বড় প্রশ্ন, ব্যাংকের আমানতের সুরক্ষা ব্যাংকগুলো কীভাবে করে? এটা কোনো মুখের কথা নয়। আইন-বিধি করে আমানতের টাকার সুরক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। যেমন বর্তমানে আমাদের দেশে সুরক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কতগুলোটুল প্রথমত, ‘স্টেটুটরি লিকুইডিটি রেশিও’ (এসএলআর), সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও), ব্যাংকের আমানতের বীমা প্রকল্প, ব্যাংকের মালিকদের পুঁজি এবং সব শেষে রয়েছে খারাপ ঋণের বিপরীতে রক্ষিতপ্রভিশন বলা বাহুল্য ভালো ঋণের টাকা যেহেতু ফেরত পাওয়া যাবে কাজেই নিয়ে ভাবনা নেই।সিআরআরহিসেবে বর্তমানে আমার জানা মতে, ব্যাংকের আমানতের শতাংশ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকক্যাশজমা রাখতে হয়। বর্তমানে বোধ হয় ১৩ শতাংশ টাকা রাখতে হয় এসএলআর হিসেবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা আমানত থাকলে ১৩ টাকা রাখতে হবেএসএলআরহিসেবে।এসএলআরমানে তা থাকবে সরকারি বিল/বন্ডে। এর ফলে যখন ইচ্ছা তখন তা ভাঙিয়ে প্রয়োজনবোধে গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাবে। অধিকন্তু রয়েছেব্যাংক আমানত বীমাআইন। এর দ্বারা বর্তমানে লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীদের বীমাকৃত টাকা রয়েছে। কোনো ব্যাংক কোনো কারণে বন্ধ হলে, দেউলিয়া হলে ওই ব্যাংকের লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতকারীদের সমুদয় অর্থ অবিলম্বে ফেরত দেয়া হবে। এর জন্য প্রচুর টাকাবীমা ফান্ডেজমা আছে। জমা হচ্ছে প্রতি মাসে। এর মানে ধরা যাক একজন গ্রাহকের লাখ টাকা অ্যাকাউন্টে আছে। তিনি ব্যাংক বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে লাখ টাকা বীমা ফান্ড থেকে পেয়ে যাবেন। আমরা জানি, ব্যাংকের আমানতকারীদের বেশির ভাগই ছোট ছোট আমানতকারী। যতদূর জানি বীমার দ্বারা ব্যাংক খাতে ১৫-২০ শতাংশ আমানত সুরক্ষিত আছে। এরপর রয়েছে মালিকদের পুঁজি যা বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে হয় না। টাকাকে ক্যাপিটেল অ্যাডিকোয়েসি রেশিও বলা হয়। দুর্যোগে টাকাও ব্যবহার করা হবে আমানতকরীদের টাকা ফেরত দিতে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, খেলাপি ঋণ নিয়ে যার ওপর আলোচনার কোনো শেষ নেই। খেলাপি ঋণ মানে খারাপ ঋণ, যার টাকা ফেরত নাও পাওয়া যেতে পারে। এখানেই হচ্ছে মূল সমস্যা। বর্তমান হিসাবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ (ক্ল্যাসিফায়েড) ১০ শতাংশের মতো। কেউ কেউরিটেন অব লোনকে হিসাবে ধরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো বেশি বলতে চান।রিটেন অব লোনহচ্ছে খারাপ ঋণ, যা আদায় হবে না (ব্যাড ডেট) অথচ এর বিপরীতে শতভাগপ্রভিশনকরা আছে (মুনাফা থেকে টাকা কেটে হাতে রাখা হয়েছে) এবং প্রতিটির ক্ষেত্রে আদালতে মামলা আছে। রিটেন অব মানেদাবি শেষ নয়। ব্যাংকের দাবি অব্যাহত এবং তা বিচারাধীন। যে ১০ শতাংশ ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে খেলাপি যা তিন ভাগে ভাগ করা যথাসাব স্ট্যান্ডার্ড’, ‘ডাউটফুলএবং শেষেব্যাডএকটি স্তরে আলাদা আলাদা হারে (২০, ৫০ এবং ১০০ ভাগ); ‘প্রভিশনরাখার কঠোর বিধান আছে। অর্থাৎ খারাপ ঋণ যদি আদায় নাও হয় তাতে ব্যাংকের ক্ষতি নেই। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য টাকা গচ্ছিত আছে ব্যাংকেপ্রভিশনহিসাবে। সমস্তব্যাডে বিপরীতে বিভিন্ন স্তরে মামলা আছে। মামলার মাধ্যমে টাকা আদায় হলে সে টাকা আবারপ্রফিটেযোগ হবে। এসব হচ্ছে বিধি/নিয়ম। ব্যাংকের টাকা মেরে উধাও হওয়া যায়কিন্তু মামলা থেকে রেহাই নেই। সিভিল মামলা, তাই অসুবিধা।ক্রিমিনালমামলা হলে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নেয়া যেত। জানি না, কোনো দিন তা ক্রিমিনাল মামলাও হতে পারেআমার বিচারে তা হওয়া উচিত খেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করার জন্য। সমস্যাটা একটু বিস্তারিত আলোচনা করলাম, বিশেষ করে বোঝানোর জন্য কীভাবে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার আইনি এবং প্রায়োগিক ব্যবস্থা নেয়া আছে। এসব বিধিবিধান ঠিকমতো পালন করলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অতএব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ভরসা রাখতে হবে। তা না হলে সমূলে বিনাশ। যারা গুজব ছড়াবেন তাদেরও সর্বনাশ হবে। গুজব না ছড়িয়ে বরং খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের ধরে জেলে পোড়ার দাবি তুলুন।ঋণ আদালতনয়পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট (পিডিআর)’-এর মতো আইনে যাতে খেলাপিদের কোমরে দড়ি বাঁধা যায়, তার ব্যবস্থা করুন। সমস্যার সমাধান এখানেই। ঋণ খেলাপকেক্রিমিনাল অফেন্সহিসেবে গণ্য করুন। নরম নরম কথায় গরম সমস্যার সমাধান নেই।

 

. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন