তিন মাসেই রাজস্ব ঘাটতি ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি

রাজস্ব আহরণে গতি ফেরাতে হবে

বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। বেড়েই যাচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি। সে ঘাটতি পূরণের পরিপূরক রেমিট্যান্স আহরণেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাঁধে লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অস্বাভাবিক। অর্থবছর শেষে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে। তার কিছুটা আঁচ এরই মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এনবিআরের রাজস্ব আয়ে হাজার ৭৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকার মতো ঘাটতি রয়েছে। করের আওতা সম্প্রসারণ, করহার সুষম এবং প্রয়োজনীয় অটোমেশন সম্পন্ন করে মোট দেশজ উৎপাদনে করের অনুপাত বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য থাকলেও তা অর্জিত হয়নি। ফলে ব্যয় নির্বাহে সরকার ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি উন্নয়নে এনবিআরের প্রশাসনিক আইনি সংস্কার জরুরি। অর্থবছরের শুরুতেই রাজস্ব আহরণের ঘাটতি সতর্কবার্তা বৈকি। অবশিষ্ট সময়ে রাজস্ব আহরণে গতি আনতে এনবিআরকে দ্রুতই সক্রিয় হতে হবে।

ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানি কড়াকড়ি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কমে গিয়েছে পণ্য আমদানি। আর আমদানি কমায় শুল্ক আয় কমেছে। অন্যদিকে সব ধরনের পণ্যের দাম চড়া। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের ভোগব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরই প্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভ্যাট আহরণে। আয়কর আহরণও কমেছে। রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। বিশাল অংকের রাজস্ব আহরণে যে কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতিমালা, সংস্কার কিংবা সক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই। ভ্যাট আইন চালুর পরও সম্পূরক শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। সরকারি প্রকল্প থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আয় হয়। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পে উৎসে কর থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আসে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে প্রকল্প কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়ে। রাজধানী ঢাকা চট্টগ্রামেই দেশের ৬০-৬৫ শতাংশ করদাতার বাস। কিন্তু বহু জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়েছে। এসব এলাকায় সে তুলনায় তেমন নতুন করদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। হয়রানির ভয়ে কর দিতে আগ্রহী হন না সামর্থ্যবানরা। তারা মনে করেন, একবার করের জালে ঢুকে গেলে প্রতি বছরই কর দিতে হবে কিংবা আগের বছরের চেয়ে আয় কমে গেলে কর কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জালে জর্জরিত হতে হবে। এর সত্যতাও আছে। বিষয়টি গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ভিয়েতনাম কর আহরণ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে। যেমন ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইন যুগোপযোগী করে। ভিয়েতনাম ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পরপর তাদের আয়কর আইন রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। তা যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে দেড় যুগ ধরে। বাংলাদেশ ভারতের কর ব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে একটা বড় প্রশাসনিক পার্থক্য হলো, এনবিআর, পরোক্ষ প্রত্যক্ষ কর এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে। ভারতে তা নয়, সেখানে পরোক্ষ প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। ভারতে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরোক্ষ কর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন থ্রেসহোল্ড দেয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ একটা শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে, তেমনি রাজ্য পর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন এবং প্রয়োগের  সুযোগ। 

হিসাব সংরক্ষণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ভারতের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে, কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সব মিলিয়ে দেশগুলোয় একটা টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও সে সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশা হয়ে যায়। ভারত, ভিয়েতনাম মালয়েশিয়ায় ওই সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ সংহত একটা আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে। ভারতে পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরের মধ্যে মতামতের রশি টানাটানিতে শুল্ক আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জটিলতা ভারতে নেই, নেই মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়ায়, ভিয়েতনামের পরিস্থিতি আরো স্বচ্ছ সাবলীল। ভারতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আমদানি-রফতানি বিধির আলোকে শুল্ক-করাদি আরোপ করে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় শুল্কায়ন সিদ্ধান্ত দানকারী টায়ার বা লেয়ার অনেক কম। অধিকাংশ দেশে ট্যারিফ কমিশন শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে। বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে এনবিআরের যোগাযোগ নেই। গণশুনানি করে ট্যারিফ কমিশন, কিন্তু শুল্কারোপ করে এনবিআর। জটিলতা নিরসনে সংস্কারের কথা বলা হলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই।

এনবিআর বলছে, টিডিএসকে গুরুত্ব দিয়ে তারা এগোচ্ছে। টিডিএস বাড়লেই রাজস্ব আয় বাড়বে। নতুন কিছু প্রোগ্রাম ডেভেলপ করা হয়েছে, টিআরপি এবং অটোমেশন সিস্টেমের ওপর কাজ চলছে। অটোমেশনের কারণে রাজস্ব আহরণ বাড়বে বলেও এনবিআর মনে করছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এনবিআরের চেয়ারম্যান আরো কঠোর হওয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া করদাতাদের হয়রানি না করে তাদের কাছ থেকে সহজে কর আহরণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। মাসভিত্তিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ কর্মকৌশল নির্ধারণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাত বিশেষ করে এনবিআরের শুল্ক-কর আয় বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এনবিআর করের আওতা বাড়ানোসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা খুবই শ্লথ গতির। বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই কেবল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। রাজস্ব আয় বাড়ানো এর শর্ত। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দরকার করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। সেখানে রাজস্ব প্রদানে সেবা নিশ্চিত, অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইন-কানুন সময়োপযোগী করা গুরুত্ব পাবে। পরিকল্পনাজনিত সমস্যা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা। আছে দুর্নীতির অভিযোগও। এসব বিষয়ে সরকারকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।

করজাল বৃদ্ধি, কর সংগ্রহের গতি আনা, সব জেলা উপজেলায় রাজস্ব অফিস স্থাপন এবং কর জরিপ পরিচালনার জন্য প্রশাসনিক সংস্কারের বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ব্যাপক বাড়লেও ২০১১ সালের পর রাজস্ব প্রশাসনে আর কোনো সংস্কার হয়নি। জনবল অফিস সংখ্যা বৃদ্ধি তথা প্রশাসনিক সংস্কারে কয়েক বছর আগে প্রস্তাব প্রণীত হলেও প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের জন্য এখনো অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বিলম্বিত হচ্ছে, যা কাম্য নয়। বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। জিডিপির আকার বেড়েছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। অবস্থায় কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে সর্বনিম্ন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে সরকারকে আরো পারদর্শিতা দেখাতে হবে। এসডিজি বাস্তবায়নের স্বার্থে ২০২১ সালের মধ্যে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করার স্বপ্ন আলোর মুখ দেখেনি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও ২০৪১ সালের মধ্যে অনুপাত ২৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে। কিন্তু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ধীরগতিতে। এতে লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। আগামীতে কঠিন সময় আসছে। সামাজিক নিরাপত্তায় সরকারকে ব্যয় বাড়াতে হবে। অর্থ আহরণ করতে হলে রাজস্বের ওপরই জোর দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন