আমদানির মাধ্যমে কয়েক বছর ধরেই দেশে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যটির অস্থিতিশীল মূল্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সংকট তৈরি করেছে। ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গত জুনে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনা বন্ধ করেছে জ্বালানি বিভাগ। বিকল্প জ্বালানি উৎসের সংস্থান নিশ্চিত করতে না পারায় এককভাবে গ্যাসের ওপর চাপ আরো বেড়েছে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে চাহিদা মেটানোর সুযোগ না থাকায় আগামী দুই বছরে স্পট মার্কেট থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের এলএনজি আমদানি করতে হতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করেছে জ্বালানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক এমবার।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে তৈরি এক বিশ্লেষণে এমবার জানিয়েছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুিনর্ভরতা বাড়ানোর কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ, যে কারণে বিপুল অর্থে এলএনজি আমদানির বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই।
এমবার বলছে, চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের ৩০ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা ছিল। এর পরিমাণ ৪ দশমিক ১৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার (এমসিএম)। বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি বাড়বে না বা স্থিতিশীল হিসেবে ধরে নিলে স্পট মার্কেট থেকে ২০২২-২৪ সাল পর্যন্ত ১২ দশমিক ৪২ এমসিএম গ্যাস আমদানি করতে হবে জ্বালানি বিভাগকে।
জ্বালানির বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্লাটসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৩৫ ডলারে ওঠানামা করছে। এ হিসেবে আগামী দুই বছরে উল্লিখিত পরিমাণ এলএনজি কিনতে বাংলাদেশের ব্যয় হবে ১১ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১০৬ টাকা ধরে)।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর ৬২ শতাংশ আসছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এমবার জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে বিদ্যমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলো যথাসময়ে উৎপাদনে এলে এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে। ২০২২-২৪ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান (এমসিপিপি) সম্প্রসারণ করা গেলে অন্তত ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে বাংলাদেশের।
সংস্থাটির ভাষ্য, বিগত বছরগুলোতে স্থানীয় গ্যাসের জোগান স্বাভাবিক থাকায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ স্থানীয় গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে পেরেছিল। তবে মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখন আর সে পরিস্থিতি নেই।
বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এ দুটি দেশ থেকে এলএনজি আমদানি করছে। দুটি দেশের সঙ্গে বার্ষিক চার মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে মূল্য সাশ্রয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে আরো তিন মিলিয়ন টন এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে আমদানির পথ উন্মুক্ত রাখা হয়।
আমদানির মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ দেয়ার কথা পেট্রোবাংলার। তবে স্পট এলএনজি কেনা বন্ধ রাখায় দৈনিক সরবরাহ নেমে এসেছে ৪০ কোটি ঘনফুটের নিচে। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা থেকে শুরু করে আবাসিকেও এখন গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।
এমবার জানিয়েছে, স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় এ বাজার থেকে ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ। স্পট মার্কেটে এ অবস্থা আরো কয়েক বছর অব্যাহত থাকতে পারে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক গ্যাস সংকট ২০২৬ সালের আগে নিরসন হবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ‘ব্লুমবার্গ’।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ যে দুই বাজার থেকে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানি করে সে বাজার থেকে ২০২৫ সালের আগে সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ কয়েক দফা এলএনজি আমদানি বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেও ২০২৫ সালের আগে সরবরাহ বাড়াবেন না রফতানিকারকরা।
স্থানীয় গ্যাসের মজুদ কমার পরও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অতিনির্ভরতা এবং এর বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়া ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা অব্যবহূত থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপরই এককভাবে চাপ তৈরি হয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যের বরাত দিয়ে এমবার বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস জোগান দেয়া হয়েছে তার ২২ শতাংশ পূরণ করা হয়েছে এলএনজি আমদানি করে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ) বলছে, জ্বালানি বিভাগ ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববাজার থেকে যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেছে তার ৫৯ শতাংশ এসছে স্পট মার্কেট থেকে। উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানির কারণে এ খাতের ওপর আর্থিক চাপ বেড়েছে।
গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জিইএম) তথ্য বিশ্লেষণ করে এমবার বলছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ নতুন করে ৪ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে। ৮ হাজার ৮ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন অবস্থায় রয়েছে। অথচ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নতুন করে গ্যাস কিংবা কয়লা কোত্থেকে আসবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই।
জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ নতুন করে যেসব গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পাইপলাইনে রয়েছে সেগুলোর বিনিয়োগ, সক্ষমতা ও নীতিগত জটিলতা ছিল। এসব কারণে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন কমছে। এটি জানা সত্ত্বেও উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। অন্যদিকে এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেই চলেছি। অথচ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস কোত্থেকে আসবে সেগুলোর সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়নি। আসলে কাজগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ২০১১ সালে একটি কোম্পানি উৎপাদনে থাকা কূপ ও পরিত্যক্ত কূপ নিয়ে জরিপ পরিচালনা করেছিল। উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে সুপারিশও দিয়েছিল তারা। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি।’
যদিও জ্বালানি বিভাগ, এখন পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করবে কিনা সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু জানায়নি। তবে মূল্য সাশ্রয়ী না হওয়া পর্যন্ত জ্বালানি পণ্যটি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত এখনো বহাল রয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে জানান, আমাদের গ্যাসের চাহিদা যতটুকু সম্ভব স্থানীয় উৎস থেকে মেটানোর চেষ্টা করা হবে। এ লক্ষ্যে ৪৬টি কূপ খননের কাজ চলছে। এরই মধ্যে তিন-চারটি কূপ সংস্কার করে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় বাজারে সাশ্রয়ী মূল্য না এলে এলএনজি কেনার পরিকল্পনা আপাতত নেই।