উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনা

আনফিট ক্রেন পরিচালনায় ছিলেন চালকের সহকারী

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনার সময় ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী রাকিব। আর চালক আল আমিন বাইরে থেকে তার হেলপারকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। এছাড়া গার্ডার তোলার কাজে যে ক্রেনটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিরও ফিটনেস সনদ যাচাই করা হয়নি বছর। গতকাল কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব।

র‍্যাবের আইন গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লি. মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেন সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃত রুহুল আমিন এবং মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতারকৃত তুষার ক্রেনের ভাড়া দেয়া, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ; ক্রেনগুলোর ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে তুষার ২০১৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালনার লাইসেন্স ছাড়াই অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ক্রেনটির সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়।

র‍্যাব জানায়, ক্রেন চালানোর যে ভারী লাইসেন্স থাকার কথা চালকের সেটি ছিল না। হেলপার রাকিব তিন মাস ধরে প্রকল্পে কাজ করছেন। তার কোনো ধরনের লাইসেন্সই নেই। ক্রেন পরিচালনার সময় পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। খুবই অপ্রতুল ট্রাফিকম্যান ছিল বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, ওই ঘটনায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। পাশাপাশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহের শিক্ষাগত যোগ্যতাও সামান্য। মাত্র এইচএসসি পাস তিনি। ধরনের চাকরির অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো ছিল না কিংবা কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। লাইনম্যান হিসেবে যে দুজন কাজ করছিলেন তাদের একজন ১৭ দিন ধরে কাজ শুরু করেছেন। আরেকজন দু-তিন মাস হলো কাজ শুরু করেছেন। যাদের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার অনুমোদন নেই এমন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুজনকে নিয়োগ দিয়েছে। ক্রেন পরিচালনার সময়ও ছিল না কোনো সিগন্যালম্যান।

র‍্যাব জানায়, গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেট কারের ওপর নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হয়। ঘটনায় ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর র‍্যাব ক্রেন চালক সহকারী এবং নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাকর্মীসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ বাগেরহাট থেকে গ্রেফতার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায়, দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের অপারেটর মো. আল আমিন হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতির জন্য ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়া প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চয়নের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিকম্যান আফরোজ রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট অফিসার মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়।

র‍্যাবের আইন গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে ক্রেনের মূল অপারেটর মো. আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর দু-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। রাকিব তিন মাস আগে প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার ক্রেন চালনা করার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিনে আল আমিন রাকিব বেলা ২টা থেকে ক্রেন চালনা শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের জন্য ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর ছিটকে পড়ে দুর্ঘটনা হয়।

র‍্যাব জানায়, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট প্রাপ্ত হয়। গার্ডার বহনের ক্রেন ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর হেলপারসহ ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী গ্রেফতারকৃত ইফতেখার হেড অব অপারেশন মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা যোগ্যতা ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারী গার্ডার স্থাপনের কাজে শুরু করেছিলেন। এছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।

প্রকল্পের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিতদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন র্যাবের কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জুলফিকার সিজিজিসির বিআরটি প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২১ সালে যোগদান করেন। তিনি মূলত এসএসসি পাস। তাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার কোনো ধরনের বর্ণিত ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক দক্ষতা নেই। তিনি প্রকল্পের বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর এলাকা পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তিনি কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী স্থাপন, পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিয়োগ প্রদান করেননি। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ডিএমপি অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা ব্যতিরেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন