সামাজিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যখনই কোনো বিঘ্নকারী শক্তি আঘাত করে, তখনই প্রভূত রূপান্তরের সুযোগ এসে যায়। করোনাকালে বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে যে ব্যবসাগুলো তাদের কার্যক্রম কমাতে বাধ্য হয়েছিল, তারা দ্রুত বুঝতে পেরেছিল যে তাদের উৎপাদনশীলতার একটি গ্রহণযোগ্য স্তর ফিরিয়ে আনতে ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
তার ফলস্বরূপ, যোগাযোগমূলক প্রযুক্তিগুলো অতিমারীর প্রথম থেকেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ডিজিটাল অবকাঠামোর গুরুত্বও তুলনামূলক অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যোগাযোগমূলক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা।
অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যবসাগুলোও ধীরে ধীরে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে এবং অতিমারী চলাকালীন কার্যকর থাকার উপায় নির্ধারণ করে নেয়। প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামোর অনুপস্থিতিতে যারা উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে ছিল, সেই সংস্থাগুলোও দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের পদক্ষেপ নেয়। যে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে ডিজিটাল রূপান্তরের যাত্রা শুরু করেছে, তারা এক কার্যকর স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিগটেক বা অতিবৃহৎ প্রযুক্তিশীল সংস্থাগুলোর সাফল্যে অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর সংস্থার মধ্যেও এক আশার সঞ্চার হয়েছে।
ডিজিটাল রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্থাগুলো বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে একটি হলো সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি। পিডব্লিউসি সম্পাদিত সম্প্রতি একটি সমীক্ষানুসারে পৃথিবীর বেশির ভাগ সংস্থার পরিচালকরা সাইবার আক্রমণের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এ সমীক্ষায় ১০০টি দেশের ৫ হাজার ৫০ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন।
প্রায় ছয় বছর আগে সংঘটিত এক সুবিশাল সাইবার হামলার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থাগুলোও তাদের সুরক্ষামূলক অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নিরাপত্তা মান গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পদ্ধতির নিরাপদ উপায় অবলম্বন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, অতিমারী-পরবর্তী সাইবার অপরাধীরা তাদের আক্রমণের কৌশলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা ক্ষেত্রে পেশাদার নিরাপত্তা প্রদানকারী এবং সাইবার অপরাধীরা আগামী বছরগুলোয় একে অন্যকে পরাস্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাবে। ব্যবসায়িক নেতাদের অবশ্যই এক দীর্ঘমেয়াদি সাইবার নিরাপত্তা পরিকল্পনা অবলম্বন করে ব্যবসা বৃদ্ধির পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
এটা লক্ষণীয়, অতিমারীর প্রভাবে প্রবীণ নাগরিকসহ অনেক সাধারণ মানুষ অপরিহার্য পরিষেবাগুলো গ্রহণে ডিজিটাল উপায় ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের ডিজিটাল সাক্ষরতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন ঘটিয়েছে। যদিও সাধারণ জনগণের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার আশানুরূপ বিকাশ হয়নি। এটি একটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ। ফলে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখন ডিজিটাল লেনদেনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে ক্রমবর্ধমান সাইবার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
এক্ষেত্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নেতাদের ডিজিটাল রূপান্তরের পথে এক দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পথ দেখাতে হবে। ব্যবসাকে গতিশীল করার জন্য তাদের কর্মী বাহিনীকে কেবল আধুনিক ডিজিটাল দক্ষতায় প্রশিক্ষিত ও পরিশীলিত করলেই হবে না, তাদের সাইবার নিরাপত্তার বিষয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে, তবেই সংস্থাগুলোর সার্বিকভাবে সাইবার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। সঙ্গে সঙ্গে সব গ্রাহক, বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাদের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
একই সঙ্গে সরকারকেও দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। নাগরিকসেবা প্রদানের ডিজিটাল পদ্ধতির প্রসার যখন দেশকে আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তখন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।
বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক ডিজিটাল রূপান্তরের দ্রুত অগ্রগতি তথ্যবিকৃতির ঝুঁকিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভুল তথ্যের বিস্তার ব্যবসার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। এ ক্রমবর্ধমান তথ্যনির্ভরতার যুগে ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমগুলো এবং আনুষঙ্গিক ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো দ্বারা তথ্যবিকৃতি অনেক ক্ষেত্রেই গুরুতর সংকট তৈরি করতে পারে। তথ্য প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের নাগরিকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে উন্নত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে অবিকৃত ও ব্যবহারযোগ্য তথ্যের জোগান পায়।
দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরকে জলবায়ুবান্ধব রূপান্তরে পরিণত করার দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে। ব্যবসা ক্ষেত্রের নেতাদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে তাদের ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনায় কার্বন ফুটপ্রিন্টের মতো জলবায়ুমূলক পরিমিতিগুলোর দিকে নজর রাখা হয় এবং তা কার্যকর রূপে সম্পাদন করা হয়।
পরিশেষে, দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলার দিকেও মনোযোগ দেয়া উচিত। অতিমারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যাত্রায় প্রযুক্তি-নেতৃত্বাধীন কৌশল এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসায়িক ও সরকারি সংস্থাগুলোর নেতাদের তাদের নিজ নিজ ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনা পরিচালনা করার সময় এ বিভাজন নিরসনের দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে।
[মতামত ব্যক্তিগত]
অরিজিৎ চক্রবর্ত্তী: প্রাইসওয়াটারহাউজকুপার্সের একজন পার্টনার