রংপুরে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে কমেছে দুর্ভোগ

এস এম পিয়াল, রংপুর

রংপুর বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় প্রায়ই ঘটে মানব পাচারের ঘটনা। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী স্বজনরা মামলা করলে তা সাধারণ প্রচলিত আদালতেই নিষ্পত্তি হতো। এসব আদালতে অসংখ্য মামলা চলমান থাকায় বিচারপ্রার্থীদের রায়ের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতেন ভুক্তভোগীরা। তবে রংপুরে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বদলে গিয়েছে সেই পরিস্থিতি। আদালত চত্বরে বর্তমানে বিচারপ্রার্থীদের অসহায় ছোটাছুটিও তুলনামূলক অনেক কমেছে। স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় খুশি বিচারপ্রার্থীরা।

বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে দুই দফায় কিছুটা ব্যাহত হলেও শুরু থেকে প্রায় ২৬ মাসে ২৭টি মামলার মধ্যে ১৬টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ মাসে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ১১টি মামলা দুটি পিটিশন মামলাসহ মোট ১৩টি মামলা আছে। তবে বাকি মামলাও নির্দিষ্ট সময়ে নিষ্পত্তি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ট্রাইব্যুনাল-সংশ্লিষ্টরা।

রংপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের পঞ্চম তলায় অবস্থিত মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। শুরুতে প্রেষণে আনা কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত হলেও ওই বছরের ১২ নভেম্বর স্থায়ীভাবে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়।

মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মো. মুরাদ সরকার বলেন, ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের আগে জেলার বিভিন্ন থানায় দায়ের করা এবং ভিন্ন ভিন্ন আদালতে বিচারাধীন ২৭টি মানব পাচার মামলা ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালে মামলার জন্য পিটিশন দায়ের হয়েছে মোট ছয়টি। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২৭ মে, ১৩ জুন, অক্টোবর ১৩ অক্টোবর মোট চারটি দায়েরকৃত পিটিশন মানব পাচার আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ায় আদালতে খারিজ হয়ে যায়। তবে ২০২২ সালের এপ্রিল এবং মে মামলার জন্য দায়েরকৃত পিটিশন আদালতে গৃহীত হয়। এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলার নিষ্পত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ১৫টি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় সবাইকে খালাস দেয়া হয়। ২০২০ সালের ২৪ জুন মানব পাচার আইনের ১২/১৩ ধারায় করা মামলায় আসামি রতন মহন্ত মিরা ওরফে মিতু বেগমের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত হওয়ায় প্রথম আসামিকে এক বছর এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হাজার টাকা জরিমানা এবং দ্বিতীয় আসামিকে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হাজার টাকা জরিমানাসহ আরো এক মাসের কারাদণ্ড দেন তত্কালীন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নূর ইসলাম।

ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, বর্তমান বিচারক ইসরাত জাহান ২০২১ সালের ৩০ জুন ট্রাইব্যুনালে যোগদান করেন। তার যোগদানের পর থেকে ১১ মাসে ১২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) রংপুর ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট নাসিমা খানম বলেন, মানব পাচার আইনের ব্যাপকতা অনেক। মানব পাচারের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের প্রতারণা, যৌনকাজে নারী বা শিশুকে ব্যবহার, বল বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আটক বা নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, ঋণ আদায়ের উদ্দেশ্যে বন্দি, কোনো প্রকার শোষণ বা নিপীড়ন, জবরদস্তিমূলক শ্রম বা সেবা গ্রহণ, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতারণা মুক্তিপণ আদায়, ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করাএগুলোই মূলত মানব পাচার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। রংপুরে আগে বিভিন্ন আদালতে এসব অপরাধের মামলাগুলো দায়ের হতো। বর্তমানে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হওয়ায় এখন মামলাগুলো ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এতে স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, রংপুর বিভাগের সীমান্ত জেলাগুলোতে মানব পাচার অপরাধের প্রবণতা বেশি। কিন্তু সেখানে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল না থাকায় দ্রুত বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগীদের। তাই তিনি আশা করেন রংপুরে বিদ্যমান মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সাইবার ট্রাইব্যুনালের মতো বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

রংপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুল মালেক বলেন, সরকার বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বদ্ধপরিকর। বিদ্যমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কাজ করছে। মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুধু রংপুর জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়টি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারে।

মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (দায়রা জজ) ইসরাত জাহান বলেন, ট্রাইব্যুনালে তার যোগদান বেশি দিন হয়নি। এরই মধ্যে ১২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্যান্য মামলা নিষ্পত্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে লোকবলের সংকট নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন