দুর্যোগ ও শ্রমিক সংকটে ধান পড়ে আছে খেতে

সাইদ শাহীন

দেশে বছর বোরো মৌসুম শুরুর পর পরই দেখা দিয়েছে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বোরোর খেত। সেই সঙ্গে এবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে শ্রমিক সংকট। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে শ্রমিক সংকটে ধান কাটতে পারছেন না বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক। ফলে খেতেই পড়ে থাকছে ধান। ধান খেতে নষ্ট হওয়ার কারণে হেক্টরপ্রতি ফলন কমার শঙ্কা প্রকাশ করছেন কৃষকরা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, যেসব জেলায় শতকরা ২০ শতাংশের কম কৃষি শ্রমিক পরিবার রয়েছে, সেগুলো তীব্র সংকটময় পরিস্থিতিতে থাকে। মূলত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী, ঝালকাঠি জেলার কৃষকদের। শতকরা ২১-২৫ শতাংশের কম কৃষি শ্রমিক পরিবার রয়েছে এমন জেলাগুলোকে সংকটপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাওর অঞ্চল বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষক বোরো মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। এছাড়া হাওরের বাইরে সংকটপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে ফেনী, মুন্সীগঞ্জ পটুয়াখালী জেলা রয়েছে। এছাড়া শতকরা ২৬-৩০ শতাংশের কম কৃষি শ্রমিক পরিবার রয়েছে এমন জেলাগুলোকে মাঝারি সংকটের জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব জেলার মধ্যে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, বান্দরবান, কুমিল্লা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষক রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত অন্যান্য পেশার মানুষকে ধান কাটার কাজে নিয়োজিত করে বিকল্প আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক কৃষি শ্রমিক সংকট নিরসনে সেই অঞ্চলের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এলাকা উপযোগী বরাদ্দকৃত কম্বাইন হারভেস্টার রিপার সময়মতো কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁঁছতে হবে। সম্ভব হলে কম্বাইন হারভেস্টার রিপার এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিবহনের মাধ্যমে ধানকাটা কার্যক্রমে গতিশীলতা বাড়াতে হবে। এছাড়া সব এলাকায় শ্রমিক সংকট উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ন্যায্যতার ভিত্তিতে কৃষি যন্ত্র বিতরণ করতে হবে।

শ্রমিক সংকট থাকা জেলাগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য জেলার কৃষক পর্যাপ্ত শ্রমিক পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বণিক বার্তার প্রতিনিধিরা।

যশোর: ধান নিয়ে খুবই বিপদে আছেন বলে জানিয়েছেন যশোরের কৃষক। ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে শহরতলির পুলেরহাট মাঠের ধানের জমি। তলিয়ে যাওয়া মাঠ থেকে মুঠোবাঁধা ধান তোলার সময় কৃষক নজরুল শেখ আক্ষেপ করে বলেন, চাষীদের একের পর এক দুর্ভোগ লেগেই আছে। গত মৌসুমে মসুর লাগিয়েছিলাম দেড় বিঘা। বৃষ্টিতে তলিয়ে সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এবার তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করলাম, বৃষ্টির কারণে সব ধান বাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। শুকনা ধান তলিয়ে পচে যাচ্ছে। ধান, খড় সবই শেষ এবার। এখন সার-সেচ-চাষের টাকা কীভাবে শোধ করব তা ভেবে পাচ্ছি না। দুই চোখে এখন খালি অন্ধকার দেখি। সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান কৃষক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দীপঙ্কর দাশ বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় বোরো ধানের চাষ হয়েছে লাখ ৫৮ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে লাখ ৮৮ হাজার ১১৩ টন। গতকাল পর্যন্ত ৯০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। জেলায় মোট ৯৬৫ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর নিচু এলাকার হাজার ৩৩১ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বগুড়া: জেলায় ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে ফলন কমছে। এছাড়া অঞ্চলে রয়েছে শ্রমিক সংকট। বাম্পার ফলন ঘরে তোলার কথা থাকলেও অশনির কারণে ঝড়ো বাতাস টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উঠতি বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অশনির বৃষ্টিপাতে পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে জমির পাকা বোরো ধান। সেই সঙ্গে ধান কাটা শ্রমিক সংকট থাকায় সময়মতো ধান কাটতেও পারছেন না বোরা চাষীরা। এখনো প্রায় ২৫  শতাংশ জমির ধান কাটা বাকি রয়েছে।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কৃষক গোলাম রব্বানী বলেন, এমনিতেই বৈরী আবহাওয়া। তারপর শ্রমিক সংকট। সেই সঙ্গে ধানের বর্তমান বাজারদর কৃষকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচজন শ্রমিক দিয়ে এক বিঘা জমির ধান কাটাতে খরচ হচ্ছে থেকে হাজার টাকা। ধান পেকে যাওয়ার পরও এক সপ্তাহ কাটার কাজ শুরু করা

যায়নি। শ্রমিক না পাওয়ার কারণে দেরিতে ধান কাটতে হচ্ছে। এর সঙ্গে বৃষ্টি থাকায় ধান কাটার শ্রমিকরাও বেশি পারিশ্রমিক দাবি করছেন। ধানের যে ফলন হয়েছে তাতে চাষের খরচ, শ্রমিক খরচ মিটিয়ে খুব একটা আয় হবে না। বরং কেউ কেউ লোকসানে পড়বেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নওগাঁ: জেলায় চলতি মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ধানের বাম্পার ফলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন চাষীরা। এরই মধ্যে যখন মাঠে সোনালি ধানের শীষ কেবল পরিপক্ব হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই শুরু হয় দফায় দফায় ঝড়-বৃষ্টি। প্রতিটি মাঠে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় হেলে পড়ে ধান গাছ। দ্রুত ফসল কেটে ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠেন চাষীরা। তবে বাইরের জেলা থেকে কৃষি শ্রমিক না আসায় এবার চরম বিপাকে পড়তে হয় তাদের।

বিষয়ে নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ী) উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বণিক বার্তাকে বলেন, দফায় দফায় ঝড়-বৃষ্টিতে এবার আমাদের অনেক মাঠের ফসল ক্ষতির মুখে পড়েছে। ধান পাকলেও শুরু থেকেই শ্রমিকের তীব্র সংকট ছিল। দীর্ঘদিন পাকা ধান পানিতে ডুবে থাকলেও শ্রমিকের অভাবে অনেক কৃষকই সময়মতো ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। এতে বেশকিছু জমির ধানে চারা গজিয়ে নষ্ট হয়েছে। এখনো বৈরী আবহাওয়া চলছে। তাই ক্ষতির পরিমাণ কমাতে দ্রুত ফসল কেটে ঘরে তুলতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে কিছু কৃষি শ্রমিক এসেছেন। এরই মধ্যে জেলার সব মাঠের ৭৫ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মাঠের সব ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছি।

জয়পুরহাট: জেলায় ধান কাটা শ্রমিক সংকট এখনো কাটেনি। জেলায় গড় ৩০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। বাকি রয়েছে ৭০ ভাগ। গত দুই সপ্তাহ আগের ঝড়ে এবং ঘন ঘন বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে থাকায় ধান কাটার জন্য বাড়তি টাকা দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় জেলা থেকে জয়পুরহাটে আগত শ্রমিকরা প্রথম ধাপের ধান কেটে নিজ এলাকায় চলে যাওয়ায় আবারো নতুন করে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এবার ঝড়ের কারণে ধানের ফলনও কম হচ্ছে। বিঘাপ্রতি চার-পাঁচ মণ ফলন কম হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষক।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় হারভেস্টার মেশিন থাকলেও জমিতে পানি থাকার কারণে সব জমিতে মেশিন ব্যবহার করে ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে না। জেলার কালাই, ক্ষেতলাল আক্কেলপুর উপজেলায় আলু উৎপাদন হওয়ায় এসব জমির ধান দেরিতে রোপণ করা হয়। ফলে এসব এলাকায় এখনো ধান কাটা সেভাবে শুরুই হয়নি।

দিনাজপুর: শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত দিনাজপুরের হিলিতে মাঠের ধান পেকে গেলেও শ্রমিক সংকটের কারণে সেই ধান এখনো ঘরে তুলতে পারেননি অনেক কৃষক। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টিপাত শ্রমিকদের বাড়তি মজুরির সংকট। ফলে জমি থেকে ধান কাটা-মাড়াই শেষে উল্টো লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। বৃষ্টির আগে ধান কাটা শ্রমিকের মজুরি একটু কম থাকলেও এখন তা আরো বেড়ে গেছে। শুধু জমি থেকে ধান কেটে সড়কে তুলে দিতেই শ্রমিকরা বিঘাপ্রতি হাজার টাকা মজুরি দাবি করছেন। তার সঙ্গে রয়েছে পরিবহন খরচ হাজার টাকা। ফলে মুনাফার বদলে লোকসান কীভাবে কমানো যায়, সেটির দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষক।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছর দেশে সার, বীজ বা কীটনাশক নিয়ে কৃষককে তেমন সংকটে পড়তে হয়নি। সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাই বহাল ছিল। ফলে ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু শেষবেলায় এসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর শ্রমিক সংকট তৈরি হওয়ায় বোরো ফলন তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন কৃষক। আবার হাওরে আগাম বন্যার পূর্বাভাস থাকায় সেখানে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়েছে, যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। হাওরের মতো দেশের অন্য অঞ্চলগুলোকেও গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেন তারা।

 

প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন করেছেন বণিক বার্তার যশোর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট দিনাজপুর প্রতিনিধি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন