পেট্রোবাংলার অধীনে দেশে গ্যাস বিতরণের কাজ করে ছয়টি কোম্পানি। এখন পর্যন্ত এ কোম্পানিগুলোর অনাদায়ী বকেয়ার পরিমাণ ৯ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। যুগের পর যুগ ধরে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের বিল অনাদায়ী হয়ে এ পর্বতসম বকেয়ায় রূপ নিয়েছে। আবার এ বিল আদায়ে নেই কোনো নির্দিষ্ট আইনি কাঠামো। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি উঠে আসে। আলোচনা শেষে বকেয়া আদায় বাড়ানোর জন্য কঠোর হতে সুপারিশ করে কমিটি।
গ্যাস বিল বাবদ বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় গত বছরের অক্টোবরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠিতে বলা হয়, পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস না থাকায় সরকার উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সরবরাহ করছে। কিন্তু গ্রাহক যথাসময়ে গ্যাস বিল পরিশোধ না করার কারণে বকেয়ার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। অথচ সরকারকে নগদ উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।
জ্বালানি বিভাগের চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতাধীন দপ্তর, সংস্থা ও কোম্পানির কাছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর বিল বকেয়া রয়েছে ৩ হাজার ৩৮ কোটি ৪৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আর শিল্প মন্ত্রণালয়ে এ বকেয়ার পরিমাণ ২১০ কোটি ৭১ লাখ টাকা। গ্যাস বিলের এ বিপুল অর্থ বকেয়া থাকায় গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর তারল্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। গ্যাস বিল বাবদ বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য জ্বালানি বিভাগ থেকে এখন পর্যন্ত ৪২টি মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট বিভাগ, দপ্তর ও কমিশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে বকেয়া আদায়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চে বকেয়া গ্যাস বিল আদায়ে এবং অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও পাইপলাইন অপসারণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (অপারেশন)। কমিটিতে আরো ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও আইজিপির প্রতিনিধি। কমিটি প্রতি মাসে নিয়মিত সভা করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। গ্যাস বিলের বকেয়া আদায় এবং অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করার জন্য দুটি মনিটরিং কমিটিও গঠন করা হয়।
দেশে গ্যাস উত্তোলন ও বিতরণে মোট ১১টি কোম্পানি নিয়োজিত। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করছে ছয়টি বিতরণ কোম্পানি। গৃহস্থালি পর্যায়ের পাশাপাশি এসব কোম্পানির গ্যাস বিল বকেয়া রাখা গ্রাহকের তালিকায় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ইটভাটা ও চা বাগানের মতো প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে মোট নয় শ্রেণীর গ্রাহকের কাছে বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে। বকেয়া পরিশোধে গ্রাহকরা কয়েক দফা সময় চাইলেও সে প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ফলে শিগগিরই এ বকেয়া আদায়ের পথ দেখছে না গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো।
সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ জানান, তিতাস গ্যাসে সরকারি পর্যায়ে বকেয়ার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও কিছু বকেয়া আছে। মামলাজনিত কারণেও কিছু বকেয়া আছে।
একই বৈঠকে কমিটির সদস্য সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, গ্যাস বিল যুগ যুগ ধরে অনাদায়ী থাকা সমীচীন নয়। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সভা করে কিছু ছাড় দিয়ে হলেও বকেয়া আদায় সম্পন্ন করা উচিত। অন্যথায় কোনো সংস্থার মাধ্যমে বকেয়া আদায়ের ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শও দেন তিনি। এ সময় আলোচনায় উঠে আসে বকেয়া আদায়ে নির্দিষ্ট কোনো আইনি কাঠামো না থাকার কথাও।
পেট্রোবাংলার অধীনে থাকা দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি হলো তিতাস। কোম্পানিটির দুর্নীতির উৎস নিয়ে দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালে করা এ প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতাস গ্যাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় গ্যাসের অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে। অবৈধভাবে বিভিন্ন কারখানায় গ্যাসের লোড নেয়া হয় এবং লোড বাড়ানো হয়। সেখানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, তিতাসে ৬ শতাংশ সিস্টেম লস হয় অবৈধ সংযোগের কারণে। ঢাকার আশপাশ এলাকাগুলোয়, বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য পাওয়া যায়। গৃহস্থালির চেয়ে শিল্পেই বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাইরের কিছু যোগসাজশে ঘুসের বিনিময়ে স্বাভাবিক সংযোগের পাশাপাশি চোরাই সংযোগ দেন। ফলে বেশ বড় অংকের অর্থ থেকে বঞ্চিত হয় তিতাস। পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা অনাদায়ী বকেয়া বিল তিতাসের জন্যও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।