সময়ের ভাবনা

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন সম্ভাবনা পাট

মো. তানজিল হোসেন, মো. লিজন রানা, অংকন চন্দ্র দে

সোনার বাংলার সোনালি আঁশ পাট। আমাদের সোনালি আঁশের পেছনে রয়েছে এক সোনালি যুগ। ১৯০০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত পাট দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত। তারই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ শাসনের পর পাকিস্তানের শুরুতে দেশে প্রচুর পাটকল গড়ে ওঠে। একসময় আদমজী পাটকল ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাটকল। তখনকার সময়ে পাটই বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তবে আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের চালিকাশক্তি পাট শিল্প নানা কারণে পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে কৃত্রিম তন্তু, প্লাস্টিক আর পলিথিনের আধুনিক যুগে পাটের চাহিদা আবারো উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা মহামারীর সময়ে পরিবেশের বিষয়টি সামনে আসায় রাসায়নিক পণ্যের পরিবর্তে পাটের ব্যবহার বেড়ে যায় অভাবনীয়ভাবে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট পাটজাত পণ্য রফতানি করে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার আয় করে বাংলাদেশ। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩১ শতাংশ বেশি। মহামারীর মাঝেই পাট রফতানিতে নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপের ২৮টি দেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে, কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে পলিথিন ব্যবহারের ফলে শুধু মানুষই না প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা ইকোসিস্টেম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া পলিথিন অপচনশীল হওয়ায় তা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে, শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পোড়ালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করে, ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেকসই, পরিবেশবান্ধব সবুজ উন্নয়নের লক্ষ্যে পাট পণ্যের ওপর ঝুঁকে পড়ছে বিশ্ব।

বিশ্বদরবারে পাটের চাহিদা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি হয় সোনালি ব্যাগ। সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল সোনালি ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই যার চাহিদা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। পাট থেকে তৈরি হয় ভিসকস সুতা, যা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে পারলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের সুতার চাহিদা মেটানো সম্ভব। ফলে আমদানি ব্যয় কমবে। পাশাপাশি পাট থেকে তৈরি হয় বস্তা, ফ্যাব্রিক, হ্যান্ডব্যাগ, কার্পেট, শাড়ি, সোফা, শোপিসসহ শত শত রকমের পণ্য। পাটের পাতা থেকে ছাল-বাকল সবই ব্যবহার করা যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায় এক বিঘা জমির পাট থেকে ২৭ টন অক্সিজেন তৈরি হয়। পাট পাতা থেকে চা জাতীয় পানীয় তৈরির জন্য জার্মানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা, যা অত্যন্ত ভেষজ গুণসম্পন্ন এবং শিগগিরই তা বাজারজাত করার পরিকল্পনা করছে। পাটকাঠি পুড়িয়ে যে ছাই তৈরি হয় তা ব্যাটারি, ওষুধ, প্রসাধনীতে ব্যবহূত হয়। যখন বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের সোনালি সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে এবং পাট উৎপাদনকারী দেশগুলো সেই সুযোগ লুফে নিচ্ছে তখন আমরা শীর্ষ পাট উৎপাদনকারী দেশ হয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে অতটা লাভবান হতে পারছি না। যেখানে যশোরের আকিজ গ্রুপের পাট মিলসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বেসরকারি খাতের পাট মিলগুলো লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একের পর এক সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ার ঘোষণা সত্যিই হতাশাজনক। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে বিজেএমসির অব্যবস্থাপনা, সময়মতো পাট কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাব, নেতৃত্ব পরিকল্পনা প্রণয়নের অভাব, বৈশ্বিক বাজার দখলে কৌশলগত ত্রুটি, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, অদক্ষ প্রয়োজনের অধিক শ্রমিক নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় জড়িত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান গুনছে এবং সরকার পাটকলগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ায় পাটের বাজার সংকুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে পাট সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় মৌসুমের সময় কৃষকদের পাট বিক্রি করতে সমস্যা হচ্ছে আর সুযোগে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনছে এবং কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাছাড়া করোনা মহামারীর সময়ে পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায় পাটের রফতানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে পাটের দাম হ্রাস পায়। কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, এভাবে বিভিন্ন কারণে পাটের দাম কমে গেলে পাট চাষে পুনরায় কৃষকরা আগ্রহ হারাবেন। এতে পাট সংকটে পড়বে বেসরকারি পাটকলগুলোও। এতে করে শুধু পাটচাষী আর শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না বরং আমরা উন্নতির সোনালি সুযোগ হারিয়ে ফেলব। যুগের পাট শিল্প বিপ্লবের সোনালি ধারায় বাংলাদেশকে পুরোপুরিভাবে অংশীদার করতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় মিলে তদারক সংস্থা গঠন করতে হবে।

পাট শিল্পের কার্যক্রমগুলো একাধিক মন্ত্রণালরের সঙ্গে জড়িত, ফলে কাজের সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সরকার কর্তৃক সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পাট ক্রয় এবং পাট সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পাটের ওপর মাঠ পর্যায়ে গবেষণা চালাতে হবে। কৃষকের পাট চাষে উৎসাহ বাড়াতে প্রণোদনা দেয়া, পর্যাপ্ত গুণগত মানসম্পন্ন বীজ, কীটনাশক, সার, পাট পরিষ্কারের উপকরণ, পাট বীজ শুকানোর এবং সংরক্ষণের উপকরণ ইত্যাদি দিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাটচাষীদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাট পাটজাত পণ্য রফতানির ওপর শুল্কের হার কমাতে হবে এবং উৎপাদনকারীদের স্বল্প সুদে ঋণ অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা আরো বেশি পাট পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী হয়। তাছাড়া বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তা স্বল্প পরিসরে পাটের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে। তাদের মূলধন না থাকায় তারা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারছেন না। সরকার এসব উদ্যোক্তাকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে মূলধন বৃদ্ধিসহ সরাসরি ক্রেতার কাছে এসব পণ্য পৌঁছে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া পাটের বিভিন্ন রোগ যেমন শুকনো ক্ষতরোগ, কাণ্ডপচা রোগ, পাটের কালোপট্টি রোগ, পাটের মোজাইক রোগ ইত্যাদি রোগে পাটের উৎপাদন বহুলাংশে কমে যায়। কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এসব রোগ প্রতিরোধ প্রতিকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসহ কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের সরকার যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে পাটের সোনালি সুযোগ ধরে রাখার পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পোশাক শিল্পের মতো পাট শিল্পের মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

 

মো. তানজিল হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

মো. লিজন রানা অংকন চন্দ্র দে: শিক্ষার্থী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন