আলোকপাত

বাংলাদেশের কৃষি: স্বয়ম্ভরতা রফতানি সামর্থ্য

ড. শামসুল আলম

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। সেবা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির  ৪০ দশমিক ৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, মানে কৃষি এখনো নিয়োগের বড় ক্ষেত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ-এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থা, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি), বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশের চরম দারিদ্র্য (২০১৯-২০ সালে ১০ শতাংশ) নিরসনে কৃষি উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইফপ্রির বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ধান, পাট, কাঁঠাল, আম, পেয়ারা, আলু, সবজি মাছ উৎপাদনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার বার্ষিক খাদ্যনিরাপত্তা পুষ্টি প্রতিবেদন ২০১৯ অনুযায়ী, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫০ বছরে দেশের প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন।

সোনার বাংলা: বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন

বাংলাকে সোনার বাংলায় পুনর্জাগরণের স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি তার লেখা বক্তব্য বিভিন্নভাবে সোনার বাংলার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, উল্লেখ করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেও তিনি কয়েক শতাব্দী আগের প্রকৃত সোনার বাংলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন। তিনি জানতেন একসময় বাংলা শৌর্যবীর্যে পরিপূর্ণ ছিল। গোলা ভরা ধান পুকুর ভরা মাছ’— প্রবাদ বাক্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাংলার সোনালি যুগের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কাহিনী। সে সময় এই বাংলা কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রসিদ্ধ ছিল। অঞ্চল থেকে মসলিন, রেশম, তুলা, মসলা রফতানি হতো। অঞ্চলে অনেক বিদেশী বণিকের আনাগোনা ছিল। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, টেকসই কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অতীত সোনালি গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে। তিনি একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সোনার বাংলার জন্য সোনার লোকের দরকার। বাংলাদেশ নির্যাতন, নিপীড়ন লুটপাটে জর্জরিত। সমস্যা সমাধান এবং সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনে জণগণকে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

কৃষির উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ১৯৭১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭৫ মিলিয়ন (ইউএনএফপিএ, ২০২০) সে সময় খাদ্য ঘাটতি ছিল ২৫-৩০ লাখ টন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কৃষির ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেন। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। তিনি সে কারণেই সবুজ বিপ্লবের আহ্বান করেছিলেন, যার স্লোগান ছিলকৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কৃষি শুধু জনগণের খাদ্য জোগাবে না, আগামী দিনে অধিকাংশ মানুষের আয়ের উৎসও হয়ে থাকবে।

সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যকরী পরিকল্পনার গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রথিতযশা উন্নয়ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক দেশের গ্রামীণ উন্নয়নের মাধ্যমে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) ১৯৭৩ সালের জুলাই বাস্তবায়ন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশের অনিবার্য রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়ে অর্থনীতির পুনর্গঠন উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা। পরিকল্পনার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং জনগণের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় আয় নিশ্চিত করা। অবকাঠামো পুনর্গঠনের পাশাপাশি পরিকল্পনায় তিনি কৃষি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। প্রথম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা কৃষি খাতে বরাদ্দ দেন। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন স্বনির্ভর অর্থনীতির অন্যতম পূর্বশর্ত হলো উন্নত কৃষি। সে কারণে প্রথম বার্ষিক পরিকল্পনা কর্মসূচির বড় অংশ কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়।

কৃষকরা যাতে অধিক ফলন ফলাতে পারেন সেজন্য তিনি মানসম্পন্ন বীজ, সার, কীটনাশক সেচ সুবিধার ব্যবস্থা করেন। কৃষি সমৃদ্ধি উন্নতির জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন পুনর্গঠন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মত্স্য উন্নয়ন করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দেয়

বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করা। একসময়ের আমেরিকার কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক কথিত তলাবিহীন ঝুড়ি আজ উপচে পড়া ঝুড়িতে রূপ নিয়েছে। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ আজ রফতানিকারকে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার জন্য দুবার ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে উত্তীর্ণ হয়। বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ এখন মাতৃমৃত্যুহার শিশুমৃত্যুহার কমানো, প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাবারে গুণগত মান বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কৃষি রূপান্তরের ফলে এসব সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর কৃষিনীতির পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে কৃষি খাতের উন্নয়ন কৃষকদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১, চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, বাংলাদেশ -দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা দলিলের আলোকে সরকার কৃষির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে আধুনিক বিরূপতা সহনশীল জাতের উদ্ভাবন, ফসলের নতুন ধরনের উদ্ভাবন, পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি আবিষ্কার, ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ এলাকার সম্প্রসারণ, সমন্বিত পতঙ্গ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনুসরণ, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, ট্রান্সজেনিক শস্য উৎপাদন ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে লবণাক্ত সহনশীল স্বল্প ব্যাপ্তির শস্য জাত এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটি বিশাল উপকূলীয় এলাকায় ধান চাষাবাদের পরিধি প্রসারিত করেছে। সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, সেচ যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা বৃদ্ধি, কৃষি সম্প্রসারণ, ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা, কৃষি উপকরণের ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধাদি নিশ্চিত করা, সব কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যাপ্রবণ এলাকায় এক বা দুই ফসলি জমি চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ফসলের নিবিড়তা ২১৬ শতাংশ, যা ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১৬০ শতাংশ।

সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণের কারণে জীবিকা কৃষি ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বৈরী প্রকৃতির প্রভাবে ক্রমহ্রাসমান চাষযোগ্য জমি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, লবণাক্ততার বিপরীতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম।

চাষযোগ্য জমির অল্প অংশ সবজি উৎপাদনে ব্যবহার হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন ২০ দশমিক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবজির উচ্চফলনশীল জাত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সাফল্য এসেছে। কৃষি তথ্যসেবার হিসাবে, বর্তমানে দেশে ১৫৬টি প্রচলিত অপ্রচলিত সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৩৫টি হলো প্রধান সবজি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১১৮টি দেশে ৫০ জাতের সবজি রফতানি করছে।

কৃষকরা প্রমাণ করেছেন যে তারা অসাধারণ অদম্য স্পৃহা দেখাতে পারেন। দুই দশক আগেও আম কাঁঠাল ছিল দেশের প্রধান ফল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতেবর্তমানে দেশে ৭২ জাতের ফল চাষাবাদ করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ১৫৭ হাজার হেক্টর জমিতে মিলিয়ন টন ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। যার মধ্যে আম, কলা, কাঁঠালের পরিমাণ মোট উৎপাদনের ৬৩ শতাংশ (বিবিএস ২০১৮) কৃষকরা নতুন ফল উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে খেজুর, বরই, মাল্টা, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি, বাউকুল, আপেলকুল, ডুমুরসহ আন্যান্য ফল। এমনকি আপেলও আমাদের দেশের মাটিতে চাষ হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ১৫ বছর ধরে আমাদের দেশে ১১ দশমিক শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলচাষীদের পাশাপাশি সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে।

মত্স্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার দশমিক ৭৪ শতাংশ। জিডিপিতে খাতের অবদান দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং মোট কৃষি জিডিপিতে তা ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। মাছ মাছজাতীয় পণ্যের রফতানির পরিমাণ মোট রফতানি আয়ের দশমিক ৩৯ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে মত্স্য খাতের অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশবান্ধব নতুন মত্স্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন প্রচারের মাধ্যমে সরকার টেকসই মত্স্য ব্যবস্থাপনার জন্য ফলাফলভিত্তিক বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকারের মত্স্যবান্ধব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে মাছ উৎপাদন ২০১৯-২০ অর্থবছরে দশমিক মিলিয়ন টন পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মোট উৎপাদন (. মিলিয়ন টন) থেকে ২৭ শতাংশ বেশি। বার্ষিক মত্স্য দরদামের স্থিতিশীলতাই বলে দেয় মত্স্য চাষে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কোন কোন মাছ দেশে উদ্বৃত্ত উৎপাদন হচ্ছে।

খাদ্য কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৬০ গ্রামের বিপরীতে ভোগ ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম। মাছ মাছজাতীয় পণ্য বাংলাদেশের অন্যতম রফতানি পণ্য। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএসএ, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের মাছ মাছজাতীয় পণ্য রফতানি হচ্ছে। বর্তমানে ১০৫টি মত্স্য প্রক্রিয়াজাত প্লান্টকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭৩টি ইউরোপীয় ইউনিয়নে রফতানির জন্য অনুমোদিত। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ হিমায়িত তাজা মাছ রফতানি করে ৪৭৭ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। আসলে মত্স্য প্রক্রিয়ান্বিত মত্স্য রফতানি আরো ব্যাপক বাড়তে হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যদিও পশু পালন উপখাতে জিডিপির ভাগ কম, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষের প্রয়োজন মেটাতে এর বিশাল অবদান রয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রাণিজ আমিষ যেমন দুধ, মাংস (গরু, খাসি, মুরগি) এবং ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিম ব্রয়লার মুরগির বার্ষিক গড় দরদাম তেমন বাড়ছে না, যা এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উৎপাদনের ইঙ্গিতবাহী।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন

বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। পর্যন্ত লবণাক্ততা, খরা, প্লাবনসহিষ্ণু এবং জিঙ্কসমৃদ্ধ ১৩৪টি উচ্চফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এত ধরনের ধান চাষের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিবিড় সবজি চাষাবাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ কোটি ৫৯ লাখ হাজার টন সবজি উৎপাদন করেছে এবং তৃতীয় অবস্থান অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ পাট রফতানিতে প্রথম উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজিতে প্রতি হেক্টরে ফলন বৃদ্ধিতে প্রথম, শস্য জাতের উন্নয়নে প্রথম, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চা উৎপাদনে তৃতীয়, কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ। খাদ্য কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০ অনুসারে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং মাছ চাষে পঞ্চম। গত ১০ বছরে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয়।

কৃষিপণ্য খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের উন্নয়ন

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। বাংলাদেশ সেই কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রক্রিয়াজাত শিল্পে উৎপাদিত শস্যজাতীয় খাদ্য, হিমায়িত সবজি, ফল, আলুজাতীয় খাদ্য, ভেষজ খাদ্য, চিনিজাতীয় খাদ্য, মধু, মাছ অপ্রচলিত মাছজাতীয় খাদ্য, পোলট্রি দুধজাতীয় খাদ্য রফতানি করে। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে ৫০০-এর অধিক ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা জড়িত। তার মধ্যে ১০০-এর মতো কোম্পানি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সরকার কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিলিয়ন ডলার কৃষিপণ্য রফতানির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। আসলে দেশের কৃষিজমির আয়তনের তুলনায় কৃষিজাত রফতানির আয় তুলনামূলকভাবে এখনো নগণ্য। ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটারের দেশ নেদারল্যান্ডসের কৃষি কৃষিজাত পণ্য থেকে বার্ষিক আয় প্রায় ১২০ বিলিয়ন ইউরো।

ইউএসএ, ইউএই, চীন, কুয়েত, কানাডা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ভারত মালদ্বীপে মাংস প্রাণিজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৬ দশমিক শূন্য কোটি টাকার ৬৬ দশমিক ৮৩ টন মাংস, ৫৭ দশমিক ৮৮ টন ষাঁড়ের স্টিক, ৯৮৯ দশমিক টন গরুর হাড়ের চিপস, ২০ দশমিক টন গবাদিপশুর লেজের চুল, ৬৪ দশমিক ৫৩ টন মিষ্টিজাতীয় পণ্য, (মিষ্টি, দই, রসমালাই), ১৪২ দশমিক ৪৪ টন হাঁসের পালক, ১২ দশমিক ৬০ টন প্রাণিজ খাদ্য, ৬৩ টন হাড় রফতানি করেছে।  এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ৭৪৩ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের ২৭৯ টন আম রফতানির বিপরীতে বাংলাদেশের প্রায় তিন গুণ ৭৯১ টন আম রফতানি হয়েছে।

দীর্ঘ সময় পর ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো পটোল, কাঁকরোলসহ অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য তাদের বাজার খুলে দেয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ১১৮টি দেশে ৫০ ধরনের সবজি রফতানি করে। এখন বাংলাদেশ প্রতি বছর ৫২টি দেশে শূন্য দশমিক শূন্য মিলিয়ন থেকে শূন্য দশমিক ১০ মিলিয়ন টন সবজি রফতানি করে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ সবজি রফতানি করে ইউএস ১৬৪ মিলিয়ন ডলার আয় করে। আমরা নানা জাতের কৃষিপণ্য রফতানি করলেও মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ এখনো কম।

কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

কৃষি খাতে অগ্রগতি চলমান প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহনশীল জাতের প্রয়োজনীয়তা কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ফলে খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবেলায় আরো অধিক উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন হবে। পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত উদ্যোগগুলো গ্রহণ করতে হবে:

বৈরী কৃষি বাস্তুসংস্থানকে উৎপাদনশীল টেকসই কৃষিচর্চার নিয়ন্ত্রণের মধ্য নিয়ে আসা; মাটির গুণাগুণ রক্ষার পাশাপাশি উৎপাদনশীল কৃষিজমিতে ফসল চাষের নিবিড়তা বৃদ্ধি করা; টেকসই পদ্ধতিতে নিবিড় কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি প্রচলন; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শস্য, মত্স্য প্রাণিজ উৎপাদন পদ্ধতির সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি; কৃষি উৎপাদন জীবিকার বহুমুখীকরণ এবং অকৃষি কর্মকাণ্ড কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি; -দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পানি সাশ্রয়ী সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আবহাওয়া পূর্বাভাস পদ্ধতি উন্নত করা।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সময়ে কৃষি খাতের কৌশল

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শস্য খাতের উন্নয়ন লক্ষ্য হলো  উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ফলন ব্যবধান সর্বনিম্ন করা; কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল করা; কৃষকদের মুনাফা নিরাপত্তার উন্নতি বিধান; জলবায়ুসহিষ্ণু উৎপাদনে শস্যপণ্য বহুমুখীকরণ; কৃষির সরবরাহ শৃঙ্খল শক্তিশালী করা; তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি করা; ক্ষুদ্র কৃষকদের ঋণ সুবিধাদি সহজীকরণ; উচ্চমানের গবেষণা বিতরণ সেবার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ; প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা অর্জন বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মাধ্যমে পুরো কৃষি খাতকে বৃহৎ খামারভিত্তিক প্রাণবন্ত বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করা। ক্ষুদ্রায়তন কৃষি থেকে আমাদের ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসতে হবে।

শেষ কথা

শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের আদর্শ মডেল। খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে বাংলাদেশ এখন খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। মাতৃ শিশুমৃত্যুহার কমানো, প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধি, গুণগত খাদ্য নিশ্চিতসহ সব মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জনসংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি, কৃষিজমি অর্ধেক কমে যাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখন প্রায় খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ২০৩১ সালে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে। সেজন্য যেকোনো মূল্যে আমাদের কৃষি খাতের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যক্তি খাতে সহায়তা দিয়ে কৃষিতে উৎপাদিকা রফতানি ব্যাপক বাড়াতে হবে। 

 

. শামসুল আলম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন