সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক

ব্যাংক চেয়ারম্যান পদ থেকে এসএম আমজাদ হোসেনের পদত্যাগ

হাছান আদনান

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান থেকে এসএম আমজাদ হোসেন পদত্যাগ করেছেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে টানা নয় বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তিনি এসবিএসি ব্যাংক পর্ষদের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে আমজাদ হোসেনের পদত্যাগ আগামী মাসে (অক্টোবর) অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) পর কার্যকর হবে। সময়ের মধ্যে এসবিএসি ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করেছেন এসএম আমজাদ হোসেন।

এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বণিক বার্তায় সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) বিভিন্ন সংস্থা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) ফাঁকি দেয়া শুল্ক আদায়ে তত্পর হয়ে উঠেছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে এসবিএসি ব্যাংকে পৃথক তিনটি চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এসব চিঠিতে এসএম আমজাদ হোসেনের অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যাংকঋণ লেনদেনের যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগ থেকেও সংঘটিত অনিয়মের বিষয়ে তথ্য চেয়ে এসবিএসি ব্যাংকে -মেইল পাঠানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তায় সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন: অনিয়মের ধারাপাত শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি এসবিএসি ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল অনানুষ্ঠানিকভাবে পর্ষদের সভা ডাকা হয়েছিল। তবে সে সভায় উপস্থিত থাকার বিষয়ে এসএম আমজাদ হোসেন অস্বীকৃতি জানান। গতকাল বিকালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ১৪ জন পরিচালক অংশ নেন। উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে শুধু এসএম আমজাদ হোসেন তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ জরুরি ওই সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।

জরুরি ওই সভায় অংশ নেয়া একাধিক পরিচালক বণিক বার্তাকে জানান, এসবিএসি ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ ব্যাংকের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা পর্ষদের জরুরি সভা ডাকার জন্য চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এসএম আমজাদ হোসেন সে আহ্বানে সাড়া দেননি। এজন্য চেয়ারম্যান তার স্ত্রীকে ছাড়াই জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। সভায় ১৪ জন উদ্যোক্তা পরিচালক ২৬ সেপ্টেম্বরের পর্ষদ সভায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ব্যাংকটির দুজন উদ্যোক্তা পরিচালক জানিয়েছেন, ২৬ সেপ্টেম্বরের পর্ষদ সভায় নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের পাশাপাশি এসএম আমজাদ হোসেনকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হবে। তিনি যদি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব হস্তান্তর করেন, সেটি তার জন্যও মঙ্গল। অন্যথায় ব্যাংকের সংঘবিধি সংঘ স্মারক অনুযায়ী আমজাদ হোসেনকে চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হবে।

আমজাদ হোসেনের পদত্যাগ করার বিষয়টি জানিয়ে এসবিএসি ব্যাংক পর্ষদের কাছে দেয়া পদত্যাগপত্রের কপি বণিক বার্তার হাতে রয়েছে। -মেইলের মাধ্যমে পদত্যাগপত্রটি পাঠিয়েছেন তিনি। ওই চিঠিতে আমজাদ হোসেন বলেন, কয়েক মাস ধরে তিনি শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। এজন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন। অবস্থায় তার পক্ষে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তিনি এসবিএসি ব্যাংক পর্ষদের চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করতে চান। তবে সেটি আগামী মাসে (অক্টোবর) অনুষ্ঠিত ব্যাংকের এজিএম সভার পর কার্যকর হবে। সময়ের মধ্যে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে চিঠিতে পর্ষদের প্রতি অনুরোধ করেছেন তিনি।

পদত্যাগপত্রে আমজাদ হোসেন উল্লেখ করেন, তিনি নতুন চেয়ারম্যানের কাছে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে প্রস্তুত রয়েছেন।

পদত্যাগপত্র প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে এসবিএসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেনচেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন যে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন, সেটি আমরা পেয়েছি। আইন অনুযায়ী বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এদিকে এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমজাদ হোসেনের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গতকাল সংস্থাটি থেকে এসবিএসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পৃথক তিনটি চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি চিঠিতে এসএম আমজাদ হোসেন তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কেওয়াইসিসহ যাবতীয় তথ্যের পাশাপাশি ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়। অন্য একটি চিঠিতে এসএম আমজাদ হোসেনের ব্যাংকঋণ সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। তৃতীয় চিঠিতে এসবিএসি ব্যাংক থেকে নেয়া ২৬০ কোটি টাকার ঋণসহ গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হয়েছে।

এসএম আমজাদ হোসেনের বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বণিক বার্তাকে বলেন, বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। শিগগিরই প্রতিবেদন দেয়া হবে। এর বেশি কিছু অনুসন্ধান পর্যায়ে বলার সুযোগ নেই।

সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য এসএম আমজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সময় তার সেলফোনের নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, এসএম আমজাদ হোসেন ২০১৩ সাল থেকে টানা নয় বছর এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নামে-বেনামে পরিবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকূলে নিজ ব্যাংক থেকেই তিনি ঋণ নিয়েছেন প্রায় ২৬০ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়ারও। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেয়া ঋণের প্রক্রিয়ায় ছাড়ও পেয়েছেন নজিরবিহীন। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ লঙ্ঘিত হয়েছে ব্যাংক-সংক্রান্ত যাবতীয় আইন রীতিনীতি। এতে সহায়তা করেছেন তারই নিয়োগ দেয়া অনুগত কিছু কর্মকর্তা। পরিশোধের সময় পেরোলেও অনিয়মের মাধ্যমে নেয়া ঋণের জন্য খেলাপি হিসেবে দেখানো হচ্ছে না তাকে। ব্যাংকের পর্ষদ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের জন্য বারবার তাগিদ দিলেও তাতে লাভ হয়নি। গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও উঠেছে আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে।

দেশের সরকারি-বেসরকারি অন্য চারটি ব্যাংকে আমজাদ হোসেনের ঋণ রয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এসব ঋণের আদায় পরিস্থিতিও সুবিধাজনক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ দুদকের তদন্তেও অনিয়মগুলোর কথা উঠে এসেছে।

আমজাদ হোসেন ব্যবসায়ী হিসেবেও দুর্নাম অর্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে হিমায়িত খাদ্য রফতানির কথা বলে বন্ডেড সুবিধায় কাগজ অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ২৫০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে এরই মধ্যে তার মালিকানাধীন লকপুর গ্রুপের চারটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে মোংলা কাস্টম হাউজ। আমজাদ হোসেনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ মুহূর্তে আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। ঋণ জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে গত বছর দুদক থেকে তার বিদেশযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছিল।

>>অনিয়মের ধারাপাত


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন