ইয়ুথপলিসি ফোরাম বাজেট সংলাপ ২০২১

৫ জুন, ২০২১  ইয়ুথ পলিসি ফোরাম ও ইউএনডিপি এর যৌথ উদ্যোগে  আয়োজিত বাজেট সংলাপের ওয়েবিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে ছিলেন ইয়ুথ পলিসি ফোরামের অনারারি ফেলো  ড. মোহাম্মদ তারেক। ড. তারেক পেশাগত জীবনে দায়িত্ব পালন করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থসচিব হিসেবে। পাশাপাশি, তিনি বিশ্ব ব্যাংকের অল্টারনেটিভ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ গভার্নেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট (বিআইজিএম) এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন- ওয়াইপিএফ এর পলিসি এনভয় ও ফেলোগণ। প্রশ্ন-উত্তরভিত্তিক এই ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন ওয়াইপিএফ এর নির্বাহী পরিচালক আমের মোশতাক। 

 অনুরাধা বিশ্বাসঃ বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট তৈরির প্রক্রিয়া কেমন? বাজেটের মূল ভূমিকা কী? 

বাজেটের ভূমিকা হলো একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণ। যেখানে দারিদ্র, বৈষম্য থাকবে না। যেখানে আঞ্চলিক বৈষম্য কমে আসবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকবে। পাশাপাশি,  সামষ্টিক অর্থনীতির সাথে ব্যষ্টিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখা যেমন, জলাবদ্ধতা নিরসন কিংবা রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা বা আইলার ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষতিকে প্রশমন করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেটের ভূমিকা আছে।এই মূহুর্তে বাজেটের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেখানে ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। 

বাজেটের প্রথমে একটি কৌশলগত ধাপ অবলম্বন করা হয়। অর্থবছরের ২য় প্রান্তিক অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ধাপটি চলে যাকে বাজেট সার্কুলার ১ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই ধাপে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রিলিমিনারিইন্ডিকেটিভসিলিং দেওয়া হয়, যার ভিত্তিতে প্রতিটি মন্ত্রণালয় নিজস্ব বাজেট প্রস্তাব করে। কৌশলগত ধাপের ২য় ধাপ শুরু হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। এই সময় মন্ত্রণালয়গুলো অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের ভিত্তিতে একটি বিস্তারিত বাজেট দিয়ে থাকে। এই সময় ত্রি-পক্ষীয় আলোচনা চলে যেখানে অংশ নিয়ে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এই আলোচনার মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের সংস্থান নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে বাজেট সার্কুলার ২ জারি করা হয়। প্রথম ধাপে মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত বাজেট এবং ত্রি-পক্ষীয় আলোচনার মধ্যে সমন্বয় করে আরেকটি বাজেট প্রদান করে থাকে সকল মন্ত্রণালয়। এভাবে, মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে একটি খসড়া বাজেটের চিত্র ফুটে উঠে। এরপর, এটি বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের মাধ্যমে সংসদের অনুমোদনের জন্য উত্থাপিত হয়। দুটো বিল ও আইনের মাধ্যমে এটি অনুমোদিত হয়। ব্যয়খাতের জন্য এপ্রোপ্রিয়েশান বিল এবং রাজস্ব খাতের জন্য অর্থবিল উত্থাপনের মাধ্যমে বাজেট সংসদের অনুমোদন লাভ করে। সবশেষে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভের মাধ্যমে বাজেটের দ্বিতীয় ধাপটি শেষ হয়। সাংবিধানিকভাবে বাজেটের প্রস্তুতির দায়িত্ব অর্থমন্ত্রণালয়ের উপর থাকে। তৃতীয় ধাপে, বাজেট বাস্তবায়নের কাজটি প্রতিটি মন্ত্রণালয়কেই পালন করতে হয়। চতুর্থ ধাপে, বাজেট মুল্যায়ণ, নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা চলে। কৌশলগত ধাপ ও প্রস্তুতি ধাপে দুটো কমিটি দায়িত্ব পালন করে থাকে; একটি হলো কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল এবং বাজেট মনিটরিং এন্ড রিসোর্স কমিটি।  

নাজিব হায়দারঃ অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা হলো সম্পদের অপ্রতুলতা। বাজেট প্রণয়নের সময় অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের একটি দরকষাকষি চলে। এক্ষেত্রে হয়ত পূর্ববর্তী বছরের অর্থ বরাদ্দ, সেই অর্থের ব্যবহার ইত্যাদিকে মাপকাঠি হিসেবে নেওয়া হয়। তবে সুনিদির্ষ্টভাবে কিসের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়গুলো এই বরাদ্দ পেয়ে থাকে? 

রাজস্ব খাতের বিভিন্ন আয়গুলো নির্ধারণ করা হয় প্রথমে। কর, কর বহির্ভূত আয় এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে প্রাপ্ত আয় নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রণালয়গুলো যে বাজেট দেয় সেটি বিভিন্ন পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য আছে কিনা দেখা হয়। এরপর বরাদ্দ দেওয়া হয়। 

মাহির লাবিবঃ পূর্ববর্তী অনেক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বাজেট তাঁর মুল সময়সীমাকে অতিক্রম করে যায়। এটি হওয়ার কারণ এবং উত্তরোণের উপায় কী? 

এটিকে কস্ট ওভার রান বলে। শুধু ব্যয় বাড়লেই এমন হবে তা নয়, সময় বেশি লাগলেও কস্ট ওভার রান হতে পারে। যেসব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রকল্প সংখ্যা বেশি তাদের ব্যয় বেশি হয়ে থাকে, যেমন স্থানীয় সরকার বিভাগ বা প্রকৌশল বিভাগ। বিভিন্ন কারণে প্রকল্পগুলোর ব্যয় বা সময় বাড়তে পারে। দাতাভিত্তিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেক ধরণের সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যদিকে, ভূমি অধিগ্রহণের কারনে সময় বেশি লাগতে পারে, প্রকল্প পরিচালক বদলি হয়ে যাওয়া বা তাঁর দক্ষতা একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রকল্প চলাকালীন মামলা হতে পারে, তখন সময় বেশি প্রয়োজন হতে পারে। এই ধরণের ব্যয় বেশি হওয়ার ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই হয় এমন না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই হয়ে থাকে। টাইম ওভার রান বা কস্ট ওভার রান নির্ভর করে থাকে প্রকল্পের ব্যপ্তির উপরে যেটি আগে থেকে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব না। 

সামিন ইসলামঃ আমাদের দেশের জনসংখ্যা-কর অনুপাত অনেক কম, একই সাথে জিডিপি-কর এর অনুপাতও আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা কিভাবে কর আহরণ বৃদ্ধি করতে পারি? 

গত ৫০ বছরে আমাদের করভিত্তিক রাজস্ব আয় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় বাণিজ্যভিত্তিক কর ব্যবস্থা ছিলো প্রথম খাত যেটি এখন তিন নম্বরে এসেছে। প্রথম দুটি খাত হয়েছে আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। তবে আমার মতে, বাংলাদেশের বাজেটের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজস্ব আয় তথা কর ভিত্তিক আয় বৃদ্ধি করা। পৃথিবীর বহু দেশে করনীতি এবং কর আদায়ের কাজ করে থাকে দুটো আলাদা কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশে এটি একটি প্রতিষ্ঠানই করে থাকে। এই কর্মকাণ্ড আলাদা হওয়া উচিত বলে মনে করি।  কর আদায়কারী এবং কর প্রদানকারীর মধ্যে স্বাধীন সম্পর্ক থাকা উচিত যাতে কোনো ধরণের আঁতাত না হয়; প্রযুক্তির ব্যবহার এটি নিশ্চিত করতে পারবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি রেভিনিউ কমিশন গঠনের পক্ষে। কর খাতকে পুনর্গঠন করা জরুরি। না হলে উন্নয়ন কাজের সুফল আমরা আদায় করতে পারবো না। 

আরিবা আফ্রাহঃ আমরা জানি যে, একটা জাতীয় বাজেটের সফলতা তার বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে। আমরা কখন ও কীভাবে বুঝতে পারবো যে বাস্তবায়ন সফল হয়েছে? এই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে কিভাবে আরো জোরদার করা যায়? 

বাস্তবায়ন বোঝার জন্য ক্ষেত্রে বাজেট ভ্যারিয়েন্সকে মাপকাঠি হিসেবে নেওয়া হয়। বাজেট ইমপ্লিমেন্টেশান প্ল্যান (বিআইপি) প্রতি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু এইগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয় না। সম্পদের সঠিক বরাদ্দ দেওয়া এবং সেইগুলোর মূল্যায়ন, নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। পাশাপাশি আমি মনে করি, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব কর্মপরিধি পুনর্গঠন করা উচিত; এমনকি পরিকল্পনা কমিশনেরও। 

উম্মে সাইয়েদাঃ  কভিড মহামারি বাংলাদেশের প্রতিটি খাতকে আঘাত করেছে। মহামারি পরবর্তী সকল পুনর্গঠনের জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোন খাতসমূহকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত?

এবারের বাজেটে লক্ষ্য করেছি, সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দের তুলনামূলক হার বেড়েছে এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ কমেছে। বরাদ্দের ক্ষেত্রে এইরকমই হওয়া উচিত। বৃহৎ অর্থে সামাজিক অবকাঠামোতে বরাদ্দ বেশি হওয়া উচিত। 

আমের মোশতাকঃ স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা আছে, কিন্তু তারা কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখছে বাজেট বাস্তবায়নে? 

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মোবিলিটি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার বিভাগের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। পূর্বের তুলনায় বাংলাদেশের স্থানীয় প্রশাসনের মান কমেছে, দক্ষতা কমেছে। অথচ বরাদ্দের দিকে এটি প্রথমদিকেই আছে। উপজেলা পর্যায়কে আরো সুদৃঢ় করা উচিত। 

তাহাসিন তাসনিমঃ আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার খাতের অধিকাংশ বরাদ্দই অবসর ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতায় ব্যয় করা হয়। সানেমের একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে কভিডের সময়ে দেশে প্রায় ২.৫ কোটি জনসংখ্যা দারিদ্রের পর্যায়ে নেমে এসেছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সাহায্য ও  সামাজিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে, এবারের বাজেটের ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই। 

এবারের বাজেটের ভালো দিক হলো সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ বেড়েছে, যেটি অন্যবার বেশ কম থাকে। এছাড়া ইকোনোমিক এন্ড ক্লাইমেট শক খাতে আরো ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। 

শাফকাত শফিকঃ  বাংলাদেশের করক্ষেত্রে অংশগ্রহণ অনেক ছোট। এটি বৃদ্ধি করার জন্য আমরা দুটি পদক্ষেপ নিতে পারিঃ গ্রামীণ অঞ্চলে করনীতি অবলম্বন করা ও কালো টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে নিয়ে আসা।  বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণগ পরিশোধের ব্যবস্থাপনা কিভাবে করা হচ্ছে? মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে নির্ণয় করা হয়?  

বাংলাদেশের স্থানীয় পর্যায়ের ধনীব্যক্তিদের করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কালো টাকা বেশি পরিমাণে মূলধারার অর্থনীতিতে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঋণের পরিমাণ এখনও কম আছে, জিডিপির ৩০-৪০ শতাংশের মত। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরো কম। মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয়ের কাজ করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। 

সামিন ইসলামঃ বাংলাদেশকে কল্যাণ রাষ্ট্রহিসেবে তৈরি করা সম্ভব কী? 

নিকট ভবিষ্যতে এটি করা কঠিন। এখানে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একসাথে কাজ করতে হবে।   

 শাফকাত শফিকঃ অর্থ বিভাগের উপর অনেক চাপ থাকে কাজের। এটিকে কিভাবে পুনর্গঠন করা উচিত? 

অর্থ বিভাগের কাজগুলো অন্য কাউকে দেওয়া উচিত হবে না। বরং, করনীতি প্রণয়ণের কাজ নেওয়া উচিত, রাজস্ব বোর্ডের শুধু কর সংগ্রহের কাজ করা উচিত। 

আমের মোশতাকঃ  আমরা আজকের ওয়েবিনার থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম। 

ড. তারেককে ধন্যবাদ আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য।  


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন