অভিমত

কৃষি ও খাদ্যপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ

ড. আইকেএম মোক্তারুল ওয়াদুদ, মো. তানজিল হোসেন

বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ে খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) ফুড প্রাইস ইনডেক্স (এফপিআই) শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, করোনা মহামারীতে সৃষ্ট সংকটের কারণে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এফএও প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মাসে জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক দাঁড়িয়েছে ১২০ দশমিক শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে দেশীয় বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য অর্থনীতির যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সেই কারণগুলো হলো, খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ না করা।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অতীতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল পেঁয়াজ তরমুজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। তাছাড়া চালের মূল্য হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া রয়েছে মৌসুমে সবজির মূল্য, যেমন টমেটোর মূল্য ফেব্রুয়ারি মার্চে উত্তরবঙ্গে টাকা কেজিতে উৎপাদনকারীরা বিক্রি করতে পারেন না; অথচ ঢাকা, ময়মনসিংহ চট্টগ্রামে ২০ টাকা কেজিতে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হয়।

বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের জন্য প্রয়োজন খাদ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পরিকল্পনা, নীতি গ্রহণ বাস্তবায়ন। যেমন পেঁয়াজের মূল্য স্বাভাবিক রাখার জন্য আমাদের দেশের বার্ষিক চাহিদা উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। চাহিদা উৎপাদনের পার্থক্যের সমপরিমাণ আমদানি করতে হবে। আমরা সাধারণত আমদানির জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ভারত তার দেশীয় চাহিদা পূরণের জন্য তাদের দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে হঠাৎ করে বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ করে দেয়। সে সময় বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, পেঁয়াজ গত বছরে প্রতি কেজি প্রায় ৩০০ টাকা দামে বিক্রি হয়।

কৃষিপণ্যের হঠাৎ করে উৎপাদন বাড়ানো যায় না। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো সময়সাপেক্ষ বিষয়। কৃষকরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় পরের বছর পেঁয়াজ উৎপাদন করলে দেখা যায়, যখন বাংলাদেশে কৃষক উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারজাত করেন তখন সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। এতে দেশীয় বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কমে যায় এবং কৃষকরা পেঁয়াজের ভালো মূল্য পান না, ফলে তারা পরের বছর পেঁয়াজ উৎপাদনে আগ্রহী হন না। এতে দেশে চাহিদার পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয় না এবং ভারতের ওপর আমরা নির্ভরশীল থেকেই যাই। তাই দেশে পেঁয়াজ বাজারে ওঠার সময় ভারত থেকে আমদানি বন্ধ রাখতে সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে।

রোজার মধ্যে তরমুজের মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে প্রতিটি তরমুজ ২০ থেকে ৫০ টাকা দরে ক্রয় করে প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন, যার প্রতিটির মূল্য পড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এতে তরমুজের উৎপাদনকারী তরমুজের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না আর ভোক্তারা চড়া মূল্যে তরমুজ ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন। অর্থাৎ মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য উৎপাদক ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের উৎপাদক, ভোক্তা, অর্থনীতিবিদ, কৃষি অর্থনীতিবিদ নীতিনির্ধারকদের জন্য।

মৌসুমি সবজির ক্ষেত্রে দেখা যায় আঞ্চলিক মূল্যবৈষম্য। ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে উত্তরবঙ্গে যে সবজির (যেমন টমেটো, বাঁধাকপি) কেজিপ্রতি মূল্য টাকা; ঢাকা, ময়মনসিংহ চট্টগ্রামে তার কেজিপ্রতি মূল্য প্রায় ২০-২৫ টাকা। কৃষি খাদ্যপণ্যের আঞ্চলিক মূল্যবৈষম্য অস্বাভাবিক মূল্য নিয়ন্ত্রণ জনস্বার্থে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা নিম্ন আয়ের মানুষের আয় অত্যন্ত কম। এক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলে তাদের খাবার বাবদ আয়ের বড় অংশ ব্যয় হয় এবং অন্যান্য ব্যয়, যেমন বাড়িভাড়া, শিক্ষা চিকিৎসার খরচ বহন করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো দেশের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (এমপিসি) প্রায় শূন্য দশমিক ৮। অর্থাৎ দেশের মানুষ যা আয় করে, তার প্রায় ৮০ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে।

খাদ্যপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে মাল্টি ন্যাশনাল গ্রোসারি চেইন কোম্পানিগুলো, যেমন ওয়ালমার্ট, আলডি, কারফোরকে বাংলাদেশে কাজ করার জন্য নিয়ে আসতে হবে। এসব মাল্টিন্যাশনাল গ্রোসারি চেইন কোম্পানি ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে যে সুবিধাগুলো হবে তা হলো: () ন্যায্যমূল্যে তারা খাদ্য/কৃষিপণ্য বিক্রি করবে; () ফরমালিন কেমিক্যালমুক্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবে; () হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ভেজাল, কেমিক্যাল ফরমালিনযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন। ফলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে এবং সরকারের স্বাস্থ্য খাতে খরচ বহুগুণে বেড়ে গেছে।

সুতরাং খাদ্য/কৃষিপণ্যের আঞ্চলিক মূল্যবৈষম্য দূরীকরণ, খাদ্য কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ, গুণগত স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশে বহুজাতিক গ্রোসারি চেইন কোম্পানি, যেমন ওয়ালমার্ট, আলডি কারফোর মতো কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিলে জনগণ উপকৃত হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয় দেশে খাদ্যপণ্য কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ধারণাটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে পারে।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ করে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে অন্য আরেকটি পদ্ধতি হতে পারে ফারমার্স মার্কেট বা কৃষক বাজার। কৃষক উৎপাদিত পণ্য বাজারে আনবেন এবং সেখান থেকে ভোক্তারা পণ্য ক্রয় করবেন, উৎপাদনকারী ভোক্তার মাঝে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে না। ফলে উৎপাদনকারী কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং ভোক্তা ন্যায্যমূল্যে তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। এতে উৎপাদক ভোক্তা উভয়েই লাভবান হবেন। কিন্তু ধারণা দেশে কার্যকর করতে নানা অসুবিধা রয়েছে। যেমন যানবাহনের অভাব, কৃষক বাজারের অভাব, ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত ভালো রাস্তাঘাট যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব। সংকটগুলো দূরীকরণে সরকারকে তুলনামূলক কম ভাড়ায় কৃষকদের বাজার পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের জন্য যানবাহন সরবরাহ করতে হবে; রাস্তাঘাট কৃষক বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের তদারকিতে কৃষক বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি করতে হবে; যেখানে সরকারি কৃষকদের প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি থাকবে। তাহলে উৎপাদনকারী কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন, ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারবেন এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ হবে।

 

. আইকেএম মোক্তারুল ওয়াদুদ: সিনিয়র লেকচারার, অর্থনীতি বিভাগ

ডিকেন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া

মো. তানজিল হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কার্যনির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইডিআরও)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন