ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনে মন্ত্রিসভার অনুমোদন

আইনটি সংসদে পাসের আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নেয়া হোক

ব্যাংক কোম্পানি আইন আরেক দফা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনও লাভ করেছে। নতুন প্রস্তাবনার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সম্পর্কিত ধারার অন্তর্ভুক্তি। খসড়ায় দুর্বল ব্যাংক কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পুনরুদ্ধার-সংক্রান্ত নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি পুনর্গঠন একত্রীকরণের বিধানও এতে রাখা হয়েছে। তবে হতাশার বিষয় হলো, আইনের সংশোধনের যে খসড়া প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে তাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের অনেক সুপারিশই আমলে নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনটি জাতীয় সংসদে পাসের আগে স্টেকহোল্ডার বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব সুশৃঙ্খলার ঘাটতি দূরীকরণের প্রেক্ষাপট থেকে সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধনীকে সাধুবাদ জানাতে হবে। কিন্তু আইনের সংশোধনীতে কিছু দুর্বলতা রয়েই যাচ্ছে, যা আইনের কার্যকর বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে কাদের চিহ্নিত করা হবে, তার সংজ্ঞা নির্ধারণে কিছু সীমবাদ্ধতা রয়েছে। এর পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা না হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (আরবিআই) ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা জারি করেছে এক দশক আগেই। আমরা ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেক শিক্ষা নিলেও বিষয়ে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। খেলাপি ঋণের বড় অংশই ইচ্ছাকৃত। আর ধরনের ঋণ আদায়ে চূড়ান্ত ব্যবস্থা মামলা করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবিক কারণেই বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে মামলাগুলোর ফয়সালা করা জরুরি। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম, বিচারকের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাই মামলাজট এড়াতে ধরনের আদালত বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

প্রস্তাবিত সংশোধনীতে শাস্তি বা জরিমানাসংক্রান্ত বিধানগুলো আরো কঠোরতর করা হয়েছে। কঠোর শাস্তি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সহায়তা করবে, তবে বিভিন্ন মানবাধিকার যেমন সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার অধিকার, স্ব-প্রতিরক্ষা স্ব-মত ব্যাখ্যার অধিকার যাতে লঙ্ঘন না হয়, বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং যেকোনো আনীত অভিযোগের শাস্তি প্রদানের আগে অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় বিধানগুলো কোর্টের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জযোগ্য হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান নীতি বজায় রেখে পূর্ববর্তী আইনের দুর্বলতা দূর করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের নতুন সংশোধনী ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা এবং -সংক্রান্ত কিছু বৃহৎ সমস্যা, একক শিল্পগোষ্ঠী বা পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ববর্তী ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর কিছু দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতের সাধারণ মানুষের আস্থা হ্রাস পুনরুদ্ধারে সাফল্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখুক, এটাই সবার প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে আইনের সফল প্রয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। এরই মধ্যে বিএবি এবিবিসহ অনেকেই সংশোধিত আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এগুলোও আমলে নেয়া প্রয়োজন।

গত ৩০ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ কাটাছেঁড়া হয়েছে সাতবার। এর মধ্যে এক পরিবার থেকে চারজন এবং টানা নয় বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে করা হয়েছিল সর্বশেষ সংশোধনী। এবার হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২১। সে সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিধিবিধানের বিরোধিতা করা হলেও তা আমলে নেয়া হয়নি, যার ফল যে ভালো হয়নি, তা গত কয়েক বছরে আরো স্পষ্ট হয়েছে। আইনে সংশোধনী আনা জটিল সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা টেকসই আর্থিক খাত প্রতিষ্ঠায় এবারের সংশোধনীটি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কভিডের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যাংকের ওপর। তার ওপর আবার উৎপাদনশীল খাত সংকুচিত হয়ে মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং নতুন করে খেলাপি ঋণ না বাড়ার চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে। আইনটিকে পূর্ণাঙ্গ আধুনিক রূপ দিতে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শও নেয়া প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইনটি প্রয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাছাড়া বিদ্যমান আইনের কোন সীমাবদ্ধতা দুর্বলতা ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে, সেটিও তাদের জানা। ফলে আইন সংশোধনের আগে তাদের মতামত গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে ব্যাংক পরিচালনা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মতামতও পর্যালোচনা করা আবশ্যক। কারণ তারা ভেতর থেকে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করছে। আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর আরো কয়েকটি ধাপ পার হয়ে জাতীয় সংসদে উঠবে এবং সংশ্লিষ্ট কমিটি সেটি যাচাই-বাছাই করে দেখবে বলে জানা যাচ্ছে। আমরা চাইব, আইনটি সংশোধনে আরো সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হবে, সে সুযোগও রয়েছে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির উজ্জ্বল চিত্র আমাদের উল্লসিত করলেও সব উচ্ছ্বাস থেমে যায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি সুশাসনের অভাব দেখলে। বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সচেতন এবং ওয়াকিবহাল। বিষয়টি সবাইকে বিব্রত করে। নিয়ে সরকারি বিভিন্ন মহলে এবং ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে অস্বস্তি রয়েছে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ব্যাংক খাতের বিদ্যমান দুর্বলতা দূর করতেই হবে। আইনের সংশোধন তার সূচনা মাত্র। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের পথে, উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন সামনে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি সব সূচক এখন ঊর্ধ্বমুখী। উন্নত বিশ্ব হতে হলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে তার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আর এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন সব স্টেকহোল্ডার বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন