চার দশক পানির সঙ্গেই বাস ভবদহের লাখো মানুষের

বণিক বার্তা প্রতিনিধি, যশোর

ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এখনো আরো অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, তার পরও দুঃখ কাটছে না ভবদহ পারের মানুষের। চার দশক ধরে পানিবন্দি জীবন পার করছে তারা।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। এলাকার ৫২টি বিলের পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী হরি নদী দিয়ে। পলি পড়ে নদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়। বিল উপচে পানি ঢুকেছে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোয়। এরই মধ্যে অভয়নগর মনিরামপুর উপজেলার শতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মাছের ঘের, শিক্ষা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এখনো পানির নিচে। পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। ভেঙে পড়েছে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে এলাকার মানুষ।

মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা গ্রামের শংকর মণ্ডলের সাজানো গোছানো ঘর-গেরস্থালি ছিল, সবই এখন পানির নিচে। পরিবারের সদস্য হাঁস-মুরগি নিয়ে তিনি উঠেছেন উঁচু ইটের সড়কের ওপর। ভাগাভাগি করে নিয়েছেন শোয়ার জায়গা।

তার স্ত্রী বলেন, উঠোনে এখনো হাঁটুজল, ঘরের মধ্যে একহাত জল। ঘরে থাকা যাচ্ছে না। পরিবারের তিনজন সদস্যসহ হাঁস-মুরগি নিয়ে রাস্তার ওপর টিনের চালা দিয়ে সেখানে থাকছি। খুব কষ্টে আছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ভবদহ তত্সংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প নামে ৮০৮ কোটি টাকার যে প্রকল্প নিয়েছে, তার বড় অংশজুড়ে রয়েছে শুধু নদী-খাল খনন আর নানা অবকাঠামো নির্মাণ। তবে মুহূর্তে সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা দূর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাউবো। এজন্য পাউবো পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সাড়ে কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।

ভবদহ অঞ্চলের নদীগুলো মূলত জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত; অর্থাৎ সমুদ্রের মতো জোয়ারে পানি বাড়ে, ভাটায় কমে। ভাটায় সমুদ্রের পানি নিম্নাঞ্চলে পলি অবক্ষেপণ করে আবার ফিরে যায় সমুদ্রে। প্রক্রিয়ায় চলছে ভূমি গঠন। কিন্তু ভূ-গঠনকে আমলে না নিয়ে সবুজ বিপ্লবের নামে এলাকার নদীগুলোয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ষাটের দশকে যশোর খুলনা জেলার পাঁচটি উপজেলার সংযোগস্থল অভয়নগরের ভবদহে শ্রী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ভবদহ স্লুুইসগেট। সেই সঙ্গে থেমে যায় প্রাকৃতিক ভূমি গঠন প্রক্রিয়া। বিলে পলি আসা বন্ধ হয়ে যায়। পলি জমতে থাকে কেবল নদীর বুকে। ভেঙে পড়ে এলাকার ৫২টি বিলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, যশোরের কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, মুহূর্তে পানি সরানোর জন্য পাম্পসেট (সেচযন্ত্র) দিয়ে পানি সেচে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে সাড়ে কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দের পর এর কার্যক্রম শুরু করা হবে। এছাড়া ভবদহ তত্সংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন টেকসই পানি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রায় ৮০৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনে পাসের অপেক্ষায়।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, খনন করে নদী বাঁচানো যায় না। প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব। চার বছর ধরে কেবল নদী খনন করা হচ্ছে। এতে নদীর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। আর সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে ভবদহের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ অবাস্তব হাস্যকর। ভবদহ অঞ্চলকে বিরান হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা না করে বড় বড় প্রকল্প নেয়া হচ্ছে, নদী খননের নামে অর্থ লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জনগণের দাবি মেনে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ না করলে এলাকা জলাবদ্ধতামুক্ত এবং বিরান হওয়া থেকে রক্ষা পাবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন