পুরোনো সাকিব, নতুন মুস্তাফিজ এবং অন্যান্য

হাসনাত শোয়েব

অনেক প্রশ্ন, সম্ভাবনা, শঙ্কা এবং আশার দোলাচল নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। প্রায় দশ মাসের বেশি সময় পর ক্রিকেটে ফেরা, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অনেকটা নতুন শুরুর মতোই। দীর্ঘ এই বিরতির মাঝে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরে এসেছেন সাকিব আল হাসানও। সিরিজ শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি পচাখ ছিল তারওপরই। এর বাইরে আলোচনায় ছিল আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের পয়েন্ট টেবিলও। সরাসরি বিশ্বকাপ খেলতে হলে থাকতে হবে এই তালিকায় সেরা সাতে। সবমিলিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়েই এ সিরিজ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। বলাবাহুল্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করার মাধ্যমে সেই মিশন সম্পন্ন হয়েছে। আছে বেশ কিছু প্রাপ্তিও, তবে অল্প কিছু দুঃশ্চিন্তা নেই তাও নয়। 

অপেক্ষাকৃত খর্ব শক্তির দল হলেও সিরিজের আগে থেকেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। স্কোয়াডে বেশ কিছু নতুন মুখ থাকায় সেই দল সম্পর্কে খুব ধারণাও বাংলাদেশের ছিল না। তাই প্রতিপক্ষ নিয়ে না ভেবে নিজেদের শক্তিতেই আস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ এবং সেই শক্তির ওপর ভর করেই মূলত সিরিজ জিতেছে তামিমবাহিনী। গোটা সিরিজের কোন পর্যায়েই প্রতিপক্ষকে নিজেদের ওপর চেপে বসতে দেয়নি বাংলাদেশ। আর সিরিজ জয়ের নায়ক হয়েছেন সাকিব আল হাসান।

সাকিবের রোলার কোস্টার ক্যারিয়ারের আরেকটি নতুন বাঁক ছিল এই সিরিজ। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর এটিই ছিল তার প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ। এর আগে বঙ্গবন্ধু টি২০ সিরিজে খেলেছিলেন তিনি। বল হাতে নৈপুণ্য দেখালেও ব্যাট হাতে সাকিব ছিলেন নিষ্প্রভ। অথচ বিশ্বকাপের মঞ্চে এই সাকিবের ব্যাটেই রানের ফোয়ারা ছুটেছে। বল হাতে ঘরোয়া টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স সাকিব ধরে রেখেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। কিন্তু ব্যাট হাতে ঠিক সাবলীল ছিলেন না তিনি। উইকেটে থিতু হতে সময় নিয়েছেন। রান বের করতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারপরও সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিন নম্বরে সাকিব। তারওপরে আছেন তামিম ইকবাল ও রভম্যান পাওয়েল। তিন ম্যাচে ৫৬ দশমিক ৫০ গড়ে সাকিব করেছেন ১১৩ রান। কিন্তু ৬৪ দশমিক ৯৪ স্ট্রাইক রেট সাকিবের সঙ্গে ঠিক মাননসই নয়। এরপরও আশার কথা সাকিব রান খরা কাটিয়েছেন, সঙ্গে ৩ ম্যাচে ৬ উইকেট তো আছেই। সবমিলিয়ে নিজের সেরা ছন্দে না থেকেও সিরিজ সেরা হয়েছেন তিনিই। তাই পুরোপুরি পুরোনো সাকিব না ফিরলেও, ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। সামনের সিরিজগুলোতে বিশ্বকাপের সেই বিধ্বংসী সাকিবকে দেখার আশা করাই যায়। 

বিশ্ব ক্রিকেটে আলোড়ন তুলে অভিষেক হয়েছিল মুস্তাফিজুর রহমানের। এরপর বেশ কিছু সময় মুস্তাফিজ ছিল উত্তর না জানা এক ধাঁধার নাম। যার কাটারে বিশ্ব সেরা ব্যাটসম্যানরাও অকাতরে উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পর আইপিলেরও মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফ্রাঞ্চাইজি লিগেও নিজের জাত চিনিয়েছেন মুস্তাফিজ। কিন্তু ক্রিকেট প্রযুক্তি এত দূর এগিয়েছে যে, মুস্তাফিজ নামক ধাঁধার উত্তর ঠিকই বের হয়ে আসে। এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, মুস্তাফিজ ইনসুইং করতে পারেন না। কেবল কাটার এবং আউট সুইং ডেলিভারিগুলোই তার সঙ্গী। ব্যাটসম্যানরা একরকম মুখস্থ করে ফেলে তাকে এবং নতুন বলেও কার্যকারিতা হারান তিনি। বিশ্বকাপে বেশ কিছু উইকেট পেলেও তা মোটেই মুস্তাফিজসুলভ ছিল না এবং ম্যাচের ফলকেও খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু এই সিরিজে দেখা গেল অন্য এক মুস্তাফিজকে। ইচ্ছে মতো ইনসুইং-আউটসুইং করেছেন। ব্যাটসম্যানদের দেখা গেছে বিভ্রান্ত হয়ে উইকেট দিয়ে আসতে। প্রতি ম্যাচেই নিয়ম করে শুরুতে দলকে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন মুস্তাফিজ। সে সঙ্গে প্রমাণ করলেন পরিশ্রম ও একাগ্রতা দিয়েই নিজের ক্ষমতাকে আরো প্রসারিত করা সম্ভব। 

এই সিরিজে দিয়ে অভিষেক হয়েছে পেসার হাসান মাহমুদেরও। প্রথম দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট। সম্ভাবনা জাগিয়েছেন দলে জায়গা করে নেয়ার। সামনের সিরিজগুলোতেও চোখ থাকবে সম্ভবনাময় এই পেসারের ওপর। এর বাইরে এই সিরিজের প্রাপ্তি তালিকায় সিনিয়র ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিকতাকেও রাখা যায়, রাখা যেতে পারে মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণি জাদুকেও।  

তবে এত অর্জনের পরও কিছু দুঃশ্চিন্তা আড়াল করা যাচ্ছে না। সেই দুঃশ্চিন্তার নাম লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত। লিটন দাসের দক্ষতা ও ক্লাস নিয়ে সন্দেহ আছে সামান্যই। কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে নিজের সামর্থ্যের যথার্থ অনুবাদ করতে পারছেন না তিনি। সিরিজের তিন ম্যাচেই ফিরেছেন ব্যর্থ হয়ে। কেবল ক্লাস ও নান্দনিকতা দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকা কঠিন। কারণ দিন শেষে স্কোর বোর্ডই শেষ কথা। যেখানে ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারলে ছিটকে পড়া অনিবার্য। কিন্তু লিটনের মতো সামর্থ্যবান কাউকে হারানো বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য দুর্ভাগ্যই হবে। তাই অনতিবিলম্বে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নয়তো নাঈম শেখ, সৌম্য সরকার, পারভেজ হোসেন ইমনরা ব্যাকআপ হিসেবে প্রস্তুত হয়েই আছেন। 

একই কথা নাজমুল হোসেন শান্তর জন্যও প্রযোজ্য। সাকিবের বদলে তিন নম্বরে নেমে নিজেকে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছিল তার সামনে। কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না। তিন ম্যাচে তার রান ২০, ১৭ ও ১। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোতে জায়গা ধরে রাখাও পড়ল হুমকির মুখে। তাই নিজের সেরাটা উজাড় করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। নয়তো অন্যরা তো আছেনই। 

লেখক: সংবাদকর্মী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন