তামিম, সাকিব, মুশফিকের চার, ছক্কা আর মুস্তাফিজ, রুবেল, সাইফ উদ্দিনের উইকেট শিকারে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গ্যালারি, এ ঢেউ পৌঁছে যায় সারা দেশে। টাইগারদের জয়ের দিনে ঢাকার শেরেবাংলা কিংবা চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম যেন হয়ে ওঠে এক টুকরো বাংলাদেশ। গ্যালারির গগনবিদারী আওয়াজ সমর্থকদের আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ, তেজোদ্দীপ্ত করে খেলোয়াড়দেরও। সমর্থকদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতেই কিনা ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়ে খেলেন টাইগাররা।
দীর্ঘ নয় মাস পর আজ প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। শেরেবাংলার সবুজ গালিচায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছে টাইগাররা। তবে কভিড-১৯ মহামারীতে বদলে যাওয়া বিশ্বে টাইগারদের এবারের লড়াইটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। চেনা মাঠ, চেনা ড্রেসিংরুম কিংবা চেনা পরিবেশে তারা খেলবেন অচেনা এক অনুভূতি আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ঘরের মাঠে খেলা হলেও অবিশ্বাস্য এক বাস্তবতায় এ প্রথম দর্শকের গর্জন শুনবে না টাইগাররা। তামিম, মুশফিকদের লড়াইটা তাই এবার নিজেদের সঙ্গেও।
কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি পালনের কারণে এবারের সিরিজে গ্যালারিতে দর্শকের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। শুধু ভিআইপি স্ট্যান্ডে অল্প কিছু আমন্ত্রিত অতিথি খেলা দেখার সুযোগ পাবেন বলে বণিক বার্তাকে জানালেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের টিকেটিং বিভাগের এক্সিকিউটিভ জুয়েল সরকার। অন্য সব সিরিজে টিকিট বিক্রি কিংবা বণ্টন নিয়ে তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়, কিন্তু এবার চিত্রটা অন্যরকম। টিকিট নিয়ে কোনো ব্যস্ততা কিংবা হাহাকার নেই। তিনি ধারণা দিলেন, গত মাসে অনুষ্ঠিত ঘরোয়া বঙ্গবন্ধু টি২০ কাপের মতোই অল্প কিছু দর্শক থাকবে গ্যালারিতে।
ভিআইপি গ্যালারির গুটিকয়েক দর্শকের হাততালি টাইগারদের আগের মতো কি সেভাবে উদ্দীপ্ত করতে পারবে? নিশ্চিতভাবেই এ সিরিজটাতে ‘দ্বাদশ’ খেলোয়াড় বিবেচিত দর্শকের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন না তামিমরা। ফলে অতটা ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’ এবার পাবে না স্বাগতিকরা।
আরো কয়েকটি কারণে এবারের সিরিজটা আলাদা। করোনার কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষ তারকাদের কেউই বাংলাদেশে আসেননি। মারকাটারি ক্রিকেটের জন্য ক্যারিবীয় তারকাদের প্রচুর ভক্ত বাংলাদেশে, বিশেষ করে আইপিএলসহ টি২০ লিগগুলোর কল্যাণে এখানে তাদের বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। নিয়মিত অধিনায়ক জেসন হোল্ডার আসেননি বলে ওয়ানডে ফরম্যাটে দুই বছর পর দলে ফেরা জেসন মোহাম্মদ আর টেস্টে ক্রেগ ব্র্যাথওয়েট নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
তারকাশূন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মিডল অর্ডার হার্ড হিটিং ব্যাটসম্যান রভম্যান পাওয়াল। এছাড়া অধিনায়ক জেসন, সহঅধিনায়ক সুনীল আমব্রিস আর রেইমন রেইফারের শুধু রয়েছে ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা। দলে একেবারেই নতুন মুখ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন নয়জন! বাংলাদেশ দলে এ ফরম্যাটে নতুন মুখ হিসেবে ডাক পেয়েছেন স্পিনার মাহাদী হাসান, পেসম্যান শরিফুল হাসান ও হাসান মাহমুদ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ২৮টি ওয়ানডে ও নয়টি টি২০ খেলার অভিজ্ঞতাপুষ্ট জেসন এ সিরিজে নেতৃত্ব পেয়েছেন, যদিও এ সিরিজে ভালো খেলে পরবর্তী সময়ে দলে জায়গা পাকা করতে চান! তার কথায়, দুই বছর হলো আমি দলের বাইরে। দলের নেতৃত্ব আমার কাঁধে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি চ্যালেঞ্জটা নিতে তৈরি। ভালো একটা সিরিজ খেলার দারুণ সুযোগ আমার জন্য এবং সেটি করতে পারলে যখন পূর্ণশক্তির দল ফিরে আসবে, তখন আমি নিজের জায়গা দাবি করতে পারব। ক্যারিবিয়ান দলের নেতৃত্ব বিরাট কিছু। অবশ্য এটা আমার জন্য বাড়তি কোনো চাপ তৈরি করবে না, কেননা আমি এটি করতে অভ্যস্ত। আমি শুধু সিরিজটা উপভোগ করতে চাই।
এর আগেও তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন: ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ওয়ানডে ও ২০১৮ সালে পাকিস্তান সফরে তিনটি টি২০ ম্যাচে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ছিলেন। আরেকবার পূর্ণাঙ্গ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেলেন জেসন, সুযোগটা আসলে করে দিল করোনা।
গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম কাণ্ডারি হয়ে ওঠা মাশরাফি বিন মর্তুজা ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের পরই নেতৃত্ব থেকে সরে গেছেন। ওই বছর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পান সাকিব আল হাসান। ফলে ওয়ানডে দলকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ এসে যায় তামিম ইকবালের সামনে। যদিও এ যাত্রায় তাকে আন্তর্জাতিক ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিতে দীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষা করতে হলো। অবশেষে সেই অপেক্ষার প্রহর ঘুচল। সাকিব ফেরায় পূর্ণশক্তির দল পেয়েছেন তামিম। তার পরও করোনায় বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে এ সিরিজটা তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের।
ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজটা নিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলনায়ক তামিম বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য সিরিজ জয়, তবে আপাতত ভাবনায় প্রথম ম্যাচ। সিরিজ জেতাটা আমাদের জন্য অবশ্যই জরুরি। কিন্তু আমার যেটা মনে হয়, কালকের (আজ) ম্যাচটায় ভালো শুরু বেশি জরুরি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় এক বছর পরে ফিরছি। আমরা যদি ভালো শুরু করতে পারি, এরপর সবই জেতার চেষ্টা করা যাবে। প্রথম ম্যাচটা নিয়েই আমাদের মনোযোগ।
মাশরাফি এখনো অবসর নেননি। যদিও নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়ায় আর দল থেকে বাদ পড়ায় অনেকেই তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি দেখছেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল পেস বোলারের অনুপস্থিতি আর তার উত্তরসূরি হিসেবে দলকে নেতৃত্বদানের চ্যালেঞ্জ নিয়ে তামিম বললেন, অবশ্যই এটি একটি অভাব। মাশরাফি ভাই দলের জন্য অনেক কিছু করেছেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আমার সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রতিপক্ষ দল নিয়ে তামিমের ভাষ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা বোলারদের বিষয়ে বললে তারা সবাই ভালো বোলার। তবে তাদের নিয়ে ভাবার চেয়ে আমরা নিজেদের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। প্রতিপক্ষ আসেই জেতার জন্য। যারাই মাঠে নামে নিজেদের সর্বোচ্চটা দেয়ার চেষ্টা করে। আমরা আমাদের দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভিজ্ঞ ফাস্ট বোলার কেমার রোচ প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করলেন এভাবে, তারা খুবই ভালো একটি দল। সাকিব ফিরেছে, এছাড়া তামিম, মুশফিকুর, মাহমুদউল্লাহ আছে দলে। তাদের বিপক্ষে অনেকবার খেলেছি, মানসিকভাবে তারা অনেক শক্ত দল। তবে আমরা নিজেদের নিয়েই ভাবতে চাই, আর চেষ্টা করব যতটা সম্ভব ভালো ক্রিকেট খেলতে।
দুই দল সর্বশেষ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছে ২০১৯ সালে। ১৯৯৯ থেকে ২০১৯: এ ২০ বছরে ৩৮ বারের মুখোমুখিতে ক্যারিবীয়রা ২১ জয়ে এগিয়ে রয়েছে, যদিও ১৫ ম্যাচ জিতে বাংলাদেশও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সর্বশেষ টানা পাঁচ ম্যাচে হারিয়েছে বাংলাদেশ, যা টাইগারদের তৃতীয় সেরা রেকর্ড। আজ জিতলে তারা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা ছয় জয়ের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবে, যা হয়েছিল ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে। টানা সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ডটা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ২০১৪ সাল থেকে আফ্রিকান দলটিকে টানা ১৬ ম্যাচে হারিয়েছে টাইগাররা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনা, করোনার পর জয়ের নতুন ‘হিসাব’ খোলার বিষয়টি ছাড়াও ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে এ সিরিজটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যারিবীয়দের জন্যও তা-ই।
ম্যাচটি শুরু হবে সকাল সাড়ে ১১টায়।
