এএলআরডি ও বণিক বার্তা অনলাইন বৈঠক

প্রকৃতির ক্ষতি না করে হাওরের উন্নয়নে গুরুত্বারোপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিকভাবে। বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানাভাবে হাওরের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। অপরিকল্পিত অসমন্বিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি। এমন বাস্তবতায় হাওর এলাকার জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন সেসব বাস্তবায়ন করতে হবে প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে। প্রকৃতির ক্ষতি করে নয়; প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দিয়েই করতে হবে উন্নয়নকাজ। গতকাল অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) বণিক বার্তা আয়োজিত এক অনলাইন বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বক্তব্যে তিনি হাওর এলাকার মানুষের অতীত বর্তমান জীবনমান তুলে ধরে বলেন, এক সময় অভাব-অনটন হাওর অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী ছিল। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাত অসংখ্য মানুষ। হাওরের মানুষের গড় আয়ুও ছিল কম। আমরা কিন্তু সেগুলো থেকে এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছি। সেটা সম্ভব হয়েছে হাওর অঞ্চলে পরিকল্পিত উন্নয়নকাজের জন্য।

হাওরে স্থায়ী অবকাঠামোর বদলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে মাটির বাঁধ নির্মাণের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে মন্ত্রী আরো বলেন, পানিকে পানির মতো থাকতে দেয়া উচিত। এর মধ্যে কোটর বের করে আমাদের বাঁচতে হবে। প্রকৃতি পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে আমাদের ভালোভাবে থাকতে হবে। ইট-লোহার কাঠামোয় হাওরের প্রকৃতি বাঁচানো সম্ভব হবে না বলেও মত দেন তিনি।

বৈঠকের শুরুতে সূচনা বক্তব্যে বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, আমরা যারা খবরের মানুষ, তাদের বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় হাওরের বিষয়বস্তুর ওপর নজর রাখতে হয়। আকস্মিক বন্যার ব্যাপারটা আমরা সবাই জানি। বন্যা হাওর এলাকাকে তছনছ করে দেয়। বন্যাকবলিত মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যান তারা। হাওর অঞ্চলের বেশির ভাগটাই একফসলি জমি। এখানে উন্নতি করে আমরা যদি হাওর অঞ্চল থেকে শস্য উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে তা দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে। পুরো বাংলাদেশের যে ইকোসিস্টেম আছে, সেখানে হাওর অঞ্চলটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উন্নয়নের সুযোগ আছে। কৃষিপণ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে। অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন থেকে শুরু করে শিক্ষা, অন্যান্য সব বিষয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বৈষম্য আছে। এদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ হাওর জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাশুক মিয়া বলেন, হাওরের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য ২০১২ সালে হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এটা অনুসরণ করেই হাওরের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

আলোচনায় হাওর অঞ্চলের বাঁধ, জীববৈচিত্র্য, পর্যটন নিয়ে গবেষণা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ইরা নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। হাওর অঞ্চলের নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান বিআরডিএস সুনামগঞ্জের নির্বাহী পরিচালক জান্নাত মরিয়ম।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে মাছের বাসস্থান নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে উল্লেখ করে মাছ রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ইনামুল হক।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে শুধু যে বোরো মৌসুমের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা কিন্তু নয়, আমন মৌসুমের ফসলেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বাঁধ নির্মাণের বিদ্যমান ব্যবস্থায় অনেকগুলো ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন হাউসের নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী। এসব ত্রুটি সমাধানে প্রয়োজনে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব কৃষকের হাতে তুলে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, হাওরের পানি দ্রুত নামাতে হলে ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য একটা প্রকল্পের ডিপিপি আমরা করেছি। এর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার হাওর ড্রেজিংয়ের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, হাওরকে বাঁধ এবং ফসলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে মূল্যায়ন করাটা ঠিক হবে না। অঞ্চল কিন্তু বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের একটা বড় আঁধার, যা গোটা বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাওরের উন্নয়নে এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির চেয়ারম্যান নিজেরা করি সমন্বয়কারী খুশী কবির। তিনি বলেন, প্রকৃতি, মানুষ, ফসল, সম্পদএগুলোর মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, সেটা আমরা বুঝি। আমি মনে করি, সবকিছুরই একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এগুলো বজায় রেখেই আমাদের হাওর অঞ্চলের উন্নয়ন পরিকল্পনাটি করতে হবে।

বৈঠকে একটি করে হাওর অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ উন্নয়ন কার্যক্রমের ওপর দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ হাওর উন্নয়ন সংস্থা, সুনামগঞ্জের সভাপতি কাসমির রেজা এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন