কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে সবজি রফতানির ভূমিকা

নিতাই চন্দ্র রায়

গত এক যুগে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে ঘটে গেছে এক নীরব বিপ্লব। এই বিপ্লবের নায়ক গ্রামের অবহেলিত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। এক সময় সবজি চাষ সীমাবদ্ধ ছিল দেশের উত্তর-পশ্চিমের কিছু জেলা ও রাজধানী ঢাকার আশে পাশের অঞ্চলে। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। হাওড়  ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিচু এলাকায়ও ভাসমান বীজতলায় হচ্ছে সবজির চাষ। বসতবাড়ির পুষ্টি বাগান, গ্রামীণ রাস্তার ধারে এমনকি শহরের ছাদ বাগানেও সবজি চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সবজি চাষের এই নীরব বিপ্লবে বেসরকারি বীজ কোম্পানির সারা বছর চাষযোগ্য উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতগুলো বড় ভূমিকা পালন করে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশে সবজি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। বর্তমানে দেশটিতে বছরে ১ কোটি ৭২ লাখ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন হচ্ছে। দেশের ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষিপরিবার সবজি চাষের সাথে সম্পৃক্ত। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার স্যাটিসটিক্যাল ইয়ার বুক -২০১৩ অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে সবজি আবাদী জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে। বৃদ্ধির এহার শতকরা ৫ ভাগ। 

বর্তমানে বাংলাদেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। সঠিক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের অভাবে উৎপাদিত ফল ও সবজির প্রায় ৩১ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের ‘পোস্ট হারভেস্টে ম্যানেজমেন্ট অব ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবলস ফর ফুড সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স’ শীষক গষেণায় বলা হয়, জমি থেকে ফসল সংগ্রহের পর ভোক্তা পর্যন্ত পোঁছতে এই বিপুল পরিমাণ ফল ও সবজি নষ্ট হয়।  সবজির মধ্যে সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় টমেটো। উৎপাদিত টমেটোর শতকরা ৪২ শতাংশ নষ্ট হয় সংহোত্তর দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে। অন্যান্য সবজির মধ্যে ফুলকপি ২২, শসা ২৪ দশমিক ৩, বাঁধাকপি ২৫ ও শিম ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ নষ্ট হয়। 

মৌসুমের শুরুতে সবজির দাম বেশি থাকলেও  ভরা মৌসুমে কখনো কখনো সবজির দাম একেবারে কমে যায়। সবজি বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। অনেক সময় কৃষক তার কষ্টে উৎপাদিত সবজি রাগে-অভিমানে চাষ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। আবার কখনো  রাস্তায় ঢেলে প্রতিবাদ জানান। অনেক সময় আলু, বাঁধাকপি ও ফুলকপির মতো সবজি পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রদানের ক্ষেত্রে সবজি রফতানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশ সবজি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।সবজি রফতানির বড় সুবিধা হলো-তৈরি পোশাক শিল্পের মতো সবজি উৎপাদনের কাঁচা মাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না। রফতানি আয়ের সমুদয় অর্থই দেশে থেকে যায়। অন্যদিকে রপ্তানির জন্য উৎপাদিত সবজি হতে হয় নিরাপদ ও বিষমুক্ত।একারণে উৎপাদনকারীকে উত্তম কৃষি চর্চার নিয়মগুলো যথযথভাবে পালন করতে হয়।এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি বাজারের প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি থেকে  থেকে  কেজি প্রতি ৪-৫ টাকা বেশি দামে ক্রয় করেন রপ্তানিকারকেরা। ফলে কৃষক সবজির ন্যায্য মূল্য পান এবং উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তার লাভও হয় বেশি। 

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও ওমান । যেসব দেশে বাংলাভাষীরা বসবাস করছেন, সেসব দেশে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বেশি। দেশের রফতানিকৃত সবজির প্রায় ৬০ শতাংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ৪০ শতাংশ যায় ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে। সারা বিশ্বে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে আছেন প্রায় ৬০ লাখ। তাদের লক্ষ্য করেই মূলত এদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার সবজি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে  রফতানি করা হয়। তবে বাংলাদেশী ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার লোকজন এখন বাংলাদেশের সবজির ক্রেতা। রফাতনিকৃত সবজির মধ্যে রয়েছে আলু, বরবটি, শসা, চিচিঙ্গা, করলা, কাঁকরোল, টমেটো, কাঁচা পেঁপে, বেগুন, ঢেঁড়স, লাউ, কচুর লতি, মিষ্টি কুমড়া, লাল শাক, পুঁই শাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংশাক, কাঁচা মরিচ, করলা, পটল, শিমের বিচি, কাঁচা কলা, কচু শাক, কাঁঠালের বিচি ও ডাঁটা শাক প্রভৃতি। 

ভারত থেকে এক কেজি সবজি রফতানিতে বিমান ভাড়া বাবদ খরচ করতে হয় বাংলাদেশী মুদ্রায় ১০৫ থেকে ১১০ টাকা। আর বাংলাদেশ থেকে প্রতিকেজি সবজি রফতানিতে বিমান ভাড়া দিতে হয় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। এই ৫০ থেকে ৬০ টাকার ব্যবধান পুষিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের  রফতানিকারকদের পক্ষে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবজির অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর অর্ধেকও দেশের রফতানিকারকরা পাঠাতে পারেন না। এর প্রধান কারণ পরিবহন খরচ বেশি। আমাদের ভাড়া যদি প্রতিযোগী দেশগুলোর সমপরিমাণ হতো, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানের তিন গুণেরও বেশি সবজি রফতানি করা সম্ভব হতো।  

করোনাকালে কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশ থেকে আবারও শুরু হয় সবজি রপ্তানি। বছর শেষে ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাতে।এটা নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এক বিশাল অর্জন। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য আনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১৩ কোটি ডলারের শাকসবজি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে ১৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের। সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৬  শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে এ খাতে। এর আগের বছর  সবজি রফতানি হয়েছিল ১০ কোটি ডলারের। সে হিসাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৬৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এই রফতানি ২০১৯-২০ অর্থবছরেই শুধু কৃষি খাতের মধ্যেই সর্বোচ্চ নয়, বরং পুরো রপ্তানি খাতের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে বৈশ্বিক সবজি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭২দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ে চীন ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সবজি রফতানি করে শীর্ষস্থান দখল করে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান দখল করে নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও মেক্সিকো। দেশ চারটির রফতানির পরিমাণ যথাক্রমে যেখানে ১১ দশমকি ২, ৭ দশমিক ৫, ৬ দশমিক ৮ ও ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের রফতানি মাত্র ৭৭ মিলিয়ন ডলার।

রপ্তানিকারকদের সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি সংগ্রহ করে সেগুলো একত্র করা হয়। তারপর কোয়ারেন্টিন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করে রাজধানীর শ্যামপুর ওয়্যারহাউসে নিয়ে আসা হয়। কৃষি সম্প্রসারণের সংগনিরোধ বিভাগে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষে প্যাকিং করে সরাসরি বিমান বন্দরে পাঠানো হয়। তারপর আগে থেকে বুকিং দেওয়া যাত্রীবাহী বিমানের কার্গো হোলে তুলে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। করোনার কারণে যাত্রীবাহী বিমান চলাচল সীমিত হওয়ায় শাকসবজি রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। এছাড়া বন্যার কারণে কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ঘাটতি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশেই দাম বেশি। ফলে রফতানিতে এসছে এক ধরনের স্থবিরতা।তারপরও একবারে থেমে নেই সবজি রপ্তানি। বর্তমানে বধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পটোল, বেগুন, বরবটি, চিচিঙ্গা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা ,গাজর, লাউ, টমেটো ইত্যাদি পণ্যই বেশি রফতানি হচ্ছে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে রপ্তানি আরও অনেক বেশি হতো। বাংলাদেশ থেকে মূলত গ্রীষ্মকালীন সবজি জুলাই-আগষ্ট মাসে বেশি রফতানি হয়। এবার এই সময়টাতেই করোনা ও বন্যায় রফতানি একবারে কমে যায়। তবে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এই খাতে রপ্তানি বাজার আরও বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে সার্টিফিকেট দেয়, সেটার ওপর অনেক দেশেরই আস্তা নেই। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সবজি রপ্তানি হয়েছে ৬৪ লাখ ডলার, আগষ্টে তা বেড়ে হয়েছে ৭২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। এতে কভিডের কারণে ঘাটতির পরিমাণ  কিছুটা কমে আসে। চলতি বছরে সবজি রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ডলার।

কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ বিভাগ শুধু সবজিতে রোগবালই আছে কি না,  তা যাচাই করে তার ভিত্তিতে কোয়ারেন্টিন সার্টিফিকেট দেয়।কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যে মান পরীক্ষার সনদ চাওয়া হয় তার ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে চালু হয়নি। দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরির পরিকল্পনা করেছে সরকার। জানা যায়, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে সহযোগিতা করতে একটি বিশেষ ল্যাবরেটরি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই পরীক্ষাগারে পণ্যের মান পরীক্ষা করে সনদ দেওয়া হবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশি কৃষি ও খাদ্যপণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। তবে রপ্তানি বাজার বাড়াতে হলে সবজি উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন কম হলে দেশের বাজারে সবজির দাম বেড়ে যায়। তখন রপ্তানিকারকেরা লোকসানের ভয়ে সবজি রপ্তানি বন্ধ রাখেন। 

মধ্যপ্রাচ্যসহ  বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলিতে শাক-সবজির উৎপাদন খরচ বেশি। সে তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সবজি আমদানি করাটাই সুবিধাজনক। তাই বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের সবজি রফতানির সম্ভাবনা  উজ্জ্বল। এ কারণে বিদেশী বাজার চাহিদার সাথে সংগতি রেখে মানসম্মত বাংলাদেশী সবজির নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন উন্নত কৃষি চর্চা অনুসরণপূর্বক চুক্তিবদ্ধ কৃষকের মাধ্যমে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন। সেই সাথে দরকার সংগ্রহত্তোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ এবং উন্নতর গ্রেডিং, প্যাকেটজাতকরণ ও পরিবহন। এ ছাড়া বিদেশে সবজি রফতানির জন্য কার্গো বিমানে যথেষ্ট জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিমান ভাড়া প্রতিযোগী দেশগুলোর সমপর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। অপরদিকে বাংলাদেশি সবজির বাজার সম্প্রসারণে কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। শুধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীই নয়, উৎপাদনকারী কৃষক যাতে সবজির ন্যায্যমূল্য পান সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। যে এলাকায় যে সবজি ভাল হয়, তার ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিদিষ্ট সবজির  উৎপাদন এলাকাও গড়ে তোলতে হবে। বিষমুক্ত ও নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষক প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এসব ছাড়াও সবজি চাষিদের কাছে সহজ লভ্য করতে হবে জৈব সার, জৈব বালাইনাশক, ফেরোমোন ফাঁদ, হলুদ ফাঁদ ও আঠালো ফাঁদের মতো পরিবেশবান্ধব কৃষি উপকরণ।

লেখক: সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লি.
গোপালপুর, নাটোর

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন