নতুন জীবিকার চাহিদা: আগামীর ভাবনা

মুস্তাফা কে মুজেরী

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বিদ্যমান পরিস্থিতিকে পেছনে ফেলে বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের ৪১তম এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জনে বাংলাদেশ অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বিশ্বদরবারে সমাদৃত।

বাংলাদেশের উন্নয়নের এ অর্জন কোনো সরলরৈখিক ব্যাখ্যা দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একটি নির্দিষ্ট কার্যক্রমের ছক দিয়েও এর ব্যাখ্যা বাস্তবসম্মত নয়। যেকোনো বৃহৎ পরিবর্তনের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নেরও বহুমাত্রিক কারণ বিদ্যমান। তবে একথা বলা যায় বাংলাদেশে অর্থনীতির অগ্রগতি চিরায়ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা থেকে অনেকটাই পৃথক। ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরে সামাজিক পরিবর্তন একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র পরিসরের উদ্ভাবনী ও সাশ্রয়ী সফলতার অসংখ্য উদাহরণ এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। যেমন সরকারি ও বেসরকারি আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষুদ্র অর্থায়ন মডেল, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নারীর ক্ষমতায়ন ও সামষ্টিক সামাজিক উন্নয়ন। এছাড়া নারী শ্রমিকনির্ভর রফতানি পোশাক খাত, শ্রমিক অভিগমন ও অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের মাধ্যমে মানবপুঁজির বিকাশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতা বৃদ্ধি পারিবারিক ও কমিউনিটি পর্যায়ে নারীর ভূমিকাকে আরো শক্তিশালী করেছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে সত্তরের দশকের ক্ষুদ্র ঋণ বিপ্লবের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে যেভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের উদ্যোগ সফলতা লাভ করে, তা থেকে বাংলাদেশ বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। ধীর অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং বিরূপ সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের প্রচলিত উন্নয়নের মানদণ্ডে ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশক ‘হারানো দশক’ হিসেবে বিবেচিত হলেও এ সময়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পর্যায়ে বেশকিছু সফলতা অর্জন করে। সরকারি ও বেসরকারি এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে একটা বৈপ্লবিক আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করা সম্ভব হয়। সরকারি প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তাবেষ্টনী, ক্ষুদ্র ঋণ এবং অন্যান্য সামাজিক রূপান্তর কার্যক্রম। বেসরকারি প্রচেষ্টার মাধ্যমে এনজিওগুলো ‘মাইক্রোক্রেডিট প্লাস প্লাস’ এবং অন্যান্য সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো কিছুটা হলেও মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এ মেলবন্ধন বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষুদ্র একক ছিল এবং এ মাইক্রো-ম্যাক্রো মেলবন্ধনই বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেলের নিজস্বতা, যা পরবর্তী বছরগুলোতে দ্রুত পরিবর্তনকে সম্ভবপর করে তুলেছিল।

এছাড়া ১৯৮০ দশকের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কাঠামোগত ও নীতি পর্যায়ের সংস্কারের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিও ক্ষুদ্র অর্থনীতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে উদ্যোগী হয়। ফলে দ্রুতগতিতে পরিবর্তন ও রূপান্তর সম্ভবপর হয়। প্রচলিত উন্নয়নের ধারণায় এ ধরনের সামষ্টিক ও ক্ষুদ্র অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ককে কদাচিৎ গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে উন্নয়নের ধারাই শুধু বাধাগ্রস্ত হয় তাই নয়, উন্নয়ন তৃণমূল ও গ্রামীণ অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত রূপান্তরেও দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারে না। এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য বিমোচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, যা সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের দরিদ্র, বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের অর্থ জোগানকারী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডকে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে এর সমালোচনা যে হয়নি, তা বলা যাবে না। দারিদ্র্য হ্রাসে ক্ষুদ্র ঋণ সম্ভবত একটি সাময়িক সমাধান এবং দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনায় এটি সর্বোত্তম সমাধান নাও দিতে পারে, বিশেষ করে যখন পরিবারগুলোর আবাদি জমির পরিমাণ নিতান্তই সীমিত।

বিগত বছরগুলোয় গ্রামীণ রূপান্তরে কৃষি খাত একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বর্তমান আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতির যে চাহিদা তা কিন্তু বেড়েছে, যা ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোগ দ্বারা পূরণ করা সম্ভব নয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি যেখানে ৪ শতাংশের নিচে ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে তা ৮ শতাংশের বেশিতে উপনীত হয়েছে। এ প্রবৃদ্ধি শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও সার্বিক উৎপাদনশীলতা উভয় ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বিনিয়োগ ও রফতানি খাত ও শিল্প খাতের উন্নয়নেরও পর্যাপ্ত ভূমিকা রয়েছে। এ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুতগতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে যেখানে জিডিপিতে কৃষির অবদান ৬০ শতাংশ ছিল, বর্তমানে তা ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পক্ষান্তরে একই সময়ে শিল্প খাতের ভূমিকা ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ শতাংশ। আর সেবা খাতের অবদান ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫ শতাংশ। তবে এত উন্নয়নের মাঝেও শহুরে ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানে রয়েছে বিশাল বৈষম্য। যদিও কৃষি খাত, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সর্বোপরি গ্রামীণ উন্নয়নে যত বিনিয়োগ হয়েছে, তা উল্লেখযোগ্যভাবে ছিল উন্নয়নমূলক ও গরিববান্ধব।

কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে গ্রামীণ বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হয়েছে। কৃষি খাতে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, কৃষির পাশাপাশি অন্যান্য অকৃষি কর্মকাণ্ডেরও দ্রুত প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজ ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। ইটের পাকা বাড়ি, বিদ্যুতের সংযোগ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, পাকা রাস্তা এখন আর নতুন কোনো দৃশ্য নয় যেকোনো গ্রামে। বিকাশ ও অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন টাকা লেনদেন হচ্ছে, অনেকে রেমিট্যান্সের টাকাও প্রেরণ করছে। গ্রামীণ পর্যায়ে নিয়োজিত ‘তথ্য আপা’ বাইসাইকেলে করে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, আইনি অধিকার, পণ্য বাজারজাত এবং নারীর ক্ষমতায়ন—এসব বিষয়ে পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে মহিলাদের সচেতন করে তুলছেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কৃষি খাতে বেশ দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১০ এ মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি বহুমুখী গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এ পরিবর্তনকে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে চীনের যে অর্থনৈতিক পরিবর্তন তার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কৃষি খাতে রাসায়নিকীকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ এর উন্নয়নকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করেছে। স্বাধীনতার পর সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল ধান ও গমের বীজ ব্যবহার করে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানো সম্ভব হয়েছে। ১৯৭০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছেন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে। পরবর্তী সময়ে কৃষি খাতে যান্ত্রিক সরঞ্জামের ওপর বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কৃষিকার্যের দক্ষতাকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। ফলে একই পরিমাণ জমিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ফসল ফলানো সম্ভব হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে গ্রামীণ কৃষকেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই বাজার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন। মোবাইল ফোনভিত্তিক বিভিন্ন সেবা, যেমন মোবাইল ব্যাংকিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও হেল্প লাইন গ্রামীণ জীবিকায় এনেছে নতুন মাত্রা এবং সৃষ্টি করেছে নতুন কর্মসংস্থান, যা গ্রামবাসী বিশেষত নারীদের জন্য জীবনকে করে তুলেছে অনেকটাই অর্থবহ। মাইক্রোফাইন্যান্স থেকে যথাযথ ফাইন্যান্সে রূপান্তর এবং ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো কর্তৃক গ্রামীণ এলাকায় মাইক্রো-এন্টারপ্রাইজ ঋণ প্রদানের ফলে পারিবারিক উপার্জন অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পর্কিত তথ্য ও সেবা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। নারী শিক্ষা কেবল নারীদের জন্য জীবিকা অর্জনের সুযোগ (যেমন তৈরি পোশাক খাত) সৃষ্টি করেনি, বরং লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণেও ভূমিকা রেখেছে। নারীদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাল্যবিবাহ রোধে এগুলো বেশ কার্যকর হয়েছে। নারী শিক্ষার কল্যাণে এবং সচেতনতামূলক তথ্যের সহজলভ্যতার কারণে নারীদের মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নারীদের গড় সন্তানের সংখ্যা কমেছে, যা পরিবারের অপুষ্টিজনিত সমস্যা হ্রাসে অনেকটা সহায়ক হয়েছে।

আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন—এ নীতিকে সামনে রেখে গ্রামীণ উন্নয়নের দিকে আরো বেশি দৃষ্টি দিতে হবে, যেন গ্রামীণ অর্থনীতিও বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের দ্রুতগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। জীবিকা অর্জনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। কৃষি খাতে এখনো আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়োজিত। স্বাভাবিকভাবেই, অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষি খাতে শ্রমশক্তির উৎপাদনশীলতা কম।

ভবিষ্যতে কৃষি খাত ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। অর্ধশতক ধরে কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও এখানে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অনেক সুযোগ রয়েছে। সামনের দিনগুলোতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির ভিত গড়ে দিতে পারে কৃষি খাত থেকে উপার্জন বৃদ্ধি। নগরায়ণ যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রয়োজন তত বাড়ছে। অন্যথায় কৃষি খাতে জড়িত নয় এমন জনসংখ্যার (যারা বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ) খাদ্য চাহিদা মেটানো দুষ্কর হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রক্ষণশীল নীতি এবং বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বৈরী সম্পর্ক (যেমন চীন ও আমেরিকা) বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাংলাদেশের জন্য একান্ত প্রয়োজন, যাতে বৈশ্বিক বৈরিতার প্রভাব আমাদের খাদ্য আমদানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও আমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। কৃষি খাতকে শক্তিশালী করলে তবেই সব প্রতিকূলতার মধ্যেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্র অক্ষত থাকবে।

প্রান্তিক কৃষক, যাদের কিনা আবাদি জমির পরিমাণ অপ্রতুল, তাদের ক্ষেত্রে শুধুই কৃষিকাজ দিয়ে পরিবারের খাদ্য ও অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানো আগামী দিনগুলোতে আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ক্ষেত-খামারে কৃষিকাজের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষ মত্স্য চাষ, গবাদিপশু পালন, পোলট্রি ফার্ম ও বনায়ন প্রভৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এছাড়া অনেকে এসবের পাশাপাশি ঝুঁকে পড়েছে অকৃষি কর্মকাণ্ডের দিকে যেমন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, নির্মাণকাজ ইত্যাদি। এসব কর্মকাণ্ড পারিবারিক আয় বৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তাই এসব প্রয়াসকে সঠিকভাবে সহায়তা করতে পারলে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ সফলতা আনা সম্ভব হবে।

গ্রামীণ সমাজে জীবিকার বিচিত্রতা আনয়নের প্রচেষ্টায় দুটি প্রধান নিয়ামক রয়েছে: ১. গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতিকূলতা যা গ্রামীণ জনগণ, বিশেষত দরিদ্রদের বিদ্যমান ক্ষেত-খামারভিত্তিক কৃষিকাজের পাশাপাশি অকৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করে (ডিসট্রেস পুশ ফ্যাক্টর) এবং ২. নতুন জীবিকার চাহিদা (ডিমান্ড পুল ফ্যাক্টর)। এ ধারণা ব্যাপকভাবে গৃহীত যে কৃষি খাতের সঙ্গে অকৃষি খাতের সম্মিলন দারিদ্র্য বিমোচনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। অকৃষি খাতের উন্নয়ন সার্বিকভাবে কৃষি খাতের উন্নয়নকেও সহায়তা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশে এ ধরনের জীবিকার সহমিশ্রণ গ্রামীণ সমাজকে আরো বেশি আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে এবং দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোকে স্থিতিশীল ও অভিযোজ্য করে তুলবে।

আগামী দিনগুলোতে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, খাদ্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ একমাত্র ধানের ক্ষেত্রে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্যান্য শস্যে এবং বেশকিছু খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে দেশীয় চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ এখনো আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের জনসংখ্যা হবে প্রায় ২০.২  কোটি, যা আমাদের বর্তমান জনসংখ্যা থেকে প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। তাই সীমিত জমি ও মূলধন কাজে লাগিয়ে দ্রুত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, আমাদের কৃষি খাত এখনো দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; যাদের কৃষিতে বিনিয়োগের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। নিকট ভবিষ্যতে এ অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ এবং অকৃষি খাতে শ্রমশক্তির চাহিদা এখনো অনেকটাই অপ্রতুল। তৃতীয়ত, বর্ধনশীল মাথাপিছু আয়, দ্রুত নগরায়ণ, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্রুত বিকাশ, জনতাত্ত্বিকতায় দ্রুত পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি, শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশ এবং কৃষি ও খাদ্য বাজারের বিশ্বায়ন—এসব কারণে ক্রেতাদের খাদ্য পছন্দক্রমেও অনেক পরিবর্তন আসছে। সবাই বিশেষ করে শহরের জনগোষ্ঠী এখন অধিক পুষ্টিকর ফলমূল, শাকসবজি, দুধ, ডিম, মাংস, মাছের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রুচির এ পরিবর্তনগুলো যে অদূর ভবিষ্যতে কমবে এমন নয়; তাই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ক্ষেত্রগুলোকেও দ্রুত বিকশিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

খাদ্যচাহিদার পরিবর্তন ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ কৃষিবাজার, অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। পচনশীল এসব খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভিন্নতর বাজার অবকাঠামো প্রয়োজন, ধান বা অন্যান্য অপচনশীল শস্যের থেকে যা অনেকটাই আলাদা। আমাদের দেশের কৃষিপণ্যের বাজার অনুন্নত, বিভাজিত ও অনেকটাই ত্রুটিপূর্ণ। কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণের অপ্রতুল সুবিধা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার জন্য উচ্চমানের খাদ্যদ্রব্যের বাজারের সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা সম্ভবপর হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন মধ্যস্থতাকারীদের ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও কৃষি ও কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার টেকসই অগ্রগতি আরো বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এসব প্রতিবন্ধকতাকে ঠিকমতো মোকাবেলা না করলে গ্রামীণ অর্থনীতির টেকসই, কার্যকর ও দ্রুত উন্নয়ন সম্ভবপর হবে না।

আগামী দিনগুলোতে টেকসই গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য দুটি প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে বৈচিত্র্যময় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তিগত উত্কর্ষ অর্জন। বাংলাদেশকে ভিশন ২০৪১ অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে গ্রামীণ রূপান্তরকে আরো বেগবান করতে হবে। যেজন্য পাঁচটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে: ১. দ্রুত সম্প্রসারণশীল শিল্প খাতসহ অন্যান্য বর্ধনশীল খাতের উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি; ২. গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো বেশি কার্যকর ও সম্প্রসারণ; ৩. সব খাতে উৎপাদনশীলতাকে প্রাধান্য দেয়া এবং সেবা খাতকে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হিসেবে বিকাশ সাধন; ৪. কৃষি খাতে অর্জিত প্রবৃদ্ধিকে ব্যবহার করে টেকসই গ্রামীণ তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো পরিবর্তন এবং দারিদ্র্য বিমোচন অর্জন এবং ৫. অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত পরিবর্তন ও উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা যাতে কর্মসংস্থানের বিঘ্ন সৃষ্টি না করে সেদিকে দৃষ্টি দেয়া।


মুস্তাফা কে মুজেরী: আইএনএমের নির্বাহী পরিচালক

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন