স্থানীয় রাজনীতি: স্বাধীনতাপরবর্তী পরিবর্তন

আলী ইমাম মজুমদার

শিরোনামে নিবন্ধের স্থানীয় রাজনীতি বলতে বাংলাদেশের মফস্বল অঞ্চলের রাজনৈতিক ধারাকে বোঝানো হয়েছে। এটা মূলত জাতীয় রাজনীতিরই সম্প্রসারিত রূপ। বলতে গেলে তৃণমূলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। এর বিস্তার গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর থানা (যা বর্তমানে উপজেলা) পর্যায়ে শাখা, স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ছিল। এমনকি ৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে তখনকার সর্বাধিক জনসমর্থিত দল আওয়ামী লীগের কিছু শাখা ছিল ইউনিয়ন পর্যায়েও। তবে গ্রাম পর্যায়ে কর্মী-সমর্থক থাকলেও সেখানে কোনো দলের সাংগঠনিক কাঠামো আছে এমনটা জানা যায় না। এমনকি ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়েও অনেক রাজনৈতিক দলের কাঠামোগত অবস্থান নেই। তার জন্যে এটা ধরে নেয়া চলে না যে একটা রাজনৈতিক শূন্যতার মাঝে আমাদের গ্রাম, ইউনিয়ন বা উপজেলাগুলো আছে। আমাদের দেশের লোক বরাবর রাজনীতি সচেতন। তাদের অনেকেই জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতির খবরাদি রাখেন। অংশীদার হয়ে যান অনেক আন্দোলন সংগ্রামের। যেমনটা হয়েছিলেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোয় স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন আসে বড় ধরনের। এর আগে ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যরা এবং ধনাঢ্য কিছু ব্যক্তি সাধারণত মুসলিম লীগ সমর্থক ছিলেন। যুদ্ধকালে তাদের কেউ কেউ গণদাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক এমনকি সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে যান। তবে বড় অংশেরই অবস্থান থাকে বিপরীতে কিংবা নিরপেক্ষ। স্বাধীনতার পর পর তারা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েন। ফলে সরকার তখনকার ইউনিয়ন কাউন্সিল বাতিল করে মনোনীত রিলিফ কমিটির মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত কাজ পরিচালনা করতে থাকে। এর ছাপ পড়ে থানা পর্যায়েও। এসব ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরাই সদস্য ছিলেন থানা পরিষদের। ফলে সেখানেও পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষণীয় হয়। উল্লেখ করা অসঙ্গত হবে না যে সে সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীরাই অনেক অসংগঠিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের ওপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করে চলছিলেন।

থানা পর্যায়ে ষাটের দশক পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল না। ষাটের দশকে এ পর্যায়ে আসে বড় ধরনের পরিবর্তন। থানা প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কেন্দ্র নামে তখনকার বিবেচনায় বিশাল অবকাঠামো নির্মিত হয় প্রতি থানায়। এর মাঝে অফিস, মিলনায়তন ছাড়াও থাকে বেশকিছু কর্মকর্তা, কর্মচারীর জন্যে বাসভবন। মূলত আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বেই গঠিত হয় থানা পরিষদ। একে কেন্দ্র করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও পল্লী পূর্ত কর্মসূচির আওতায় সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণ এবং পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্যে খাল কাটার হিড়িক পড়ে যায়। স্বাধীনতার পর এর কাঠামোয় পরিবর্তন এলেও কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। শুরুর দিকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ অগ্রাধিকার পেলেও অচিরেই গতি আসে পূর্ত কার্যক্রমে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে শুরু হওয়া পল্লী পূর্ত কর্মসূচি থানা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নৈতিক দিক দুর্বল করে ফেললেও গ্রামীণ অবকাঠামো প্রসারে রাখে বড় ভূমিকা। পরবর্তী সময় এ ধরনের রাস্তাঘাটই মূলত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে পাকা করা হয়। এ রাস্তাগুলো গ্রামীণ আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনছে বড় ধরনের। সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ গ্রামে বসবাস করেই এখন সুযোগ পাচ্ছে কৃষিবহির্ভূত পেশায় অংশ নেয়ার। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতের সুযোগ বাড়ায় লাভবান হচ্ছেন তারা। ফলে অধিকতর উৎপাদনের দিকে যাচ্ছেন। সমৃদ্ধ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

গ্রাম পর্যায়ে আমাদের কোনো সংগঠিত প্রতিষ্ঠান ছিল না। এখনো নেই। তবে ১৯৮০ সালের দিকে গ্রাম সরকার নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। এর গঠন পদ্ধতিও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। একজন থানা পর্যায়ের কর্মকর্তার উপস্থিতিতে গ্রামের প্রাপ্ত বয়স্ক জনগণ একত্রিত হয়ে আলোচনার মাধ্যমে গ্রাম সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকাংশে ভিন্নরূপ নিত। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বশীভূত করে যেনতেনভাবে তা গঠন করতেন বলে অভিযোগ ছিল। ইউনিয়ন পরিষদের কাছ থেকেই কিছু কাজ কেটে নিয়ে গ্রাম সরকারকে দেয়া হয়। এতে সন্তুষ্ট ছিল না ইউনিয়ন পরিষদও। রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট গ্রাম সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সাধারণ জনগণের মাঝে। এর গঠন নিয়ে চলমান ছিল দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও মামলা-মোকদ্দমা। ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটে গ্রাম সরকারের। ব্যবস্থাটি টিকে থাকলে কতটা অবদান রাখত এটা দেখার সুযোগ আমাদের ঘটেনি। তবে সাধারণত ধরে নেয়া হয় তখনকার শাসক তার বেসামরিক ক্ষমতাবলয়কে প্রসারিত করার জন্যে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলেন।

স্থানীয় রাজনীতিতে একটি চমক আসে ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর। সে বছরেই তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের নামে প্রশাসনিক থানাকে উপজেলা হিসেবে চিহ্নিত করেন। গঠন করেন উপজেলা পরিষদ। সরকারের বেশকিছু বিভাগকে সে পরিষদে করা হয় স্থানান্তরিত। থাকে কিছু সংরক্ষিত বিষয়ও। ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদের গঠন কাজ শেষ হয়ে যায় ১৯৮৩-এর মধ্যে। সরাসরি ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা আসেন ১৯৮৫ তে। এ ব্যবস্থাটিও ত্রুটিমুক্ত নয়। তখনকার প্রেসিডেন্টের বেসামরিক ক্ষমতাবলয়কে প্রসারিত করার একটি চেষ্টা বলেও ধরা হয়। তা সত্ত্বেও জনগণের দোরগোড়ায় এতগুলো সেবার সুযোগ প্রসারিত করা এবং তার কর্তৃত্বে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে বসানো একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বটে। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা তার অধীনে কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়। অবশ্য সমান্তরালভাবে তারা সংশ্লিষ্ট জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অধীনেও থাকেন। মূলত ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। উল্লেখ করা আবশ্যক এগুলো করার ফলে উপজেলাকেন্দ্রিক জনগণের জীবনযাত্রা, সেখানকার পরিবেশ ও আর্থসামাজিক অবস্থায় আসতে থাকে ইতিবাচক পরিবর্তন। অবশ্য সূচনাতে এসব পরিষদ ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্যে সাবেক থানা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাঠামোই হয় ব্যবহূত। উপজেলা পরিষদ ধীরে ধীরে চলছিল। সূচনাতে সব প্রতিষ্ঠানেরই তা হয়। তবে ১৯৯১-এ বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে সে কাঠামো ভেঙে দেয়। আবারো এর নেতৃত্ব হয়ে পড়ে জনপ্রতিনিধিত্বহীন। ২০০৮-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে উপজেলা পরিষদ গঠনের জন্যে জারি করা হয় একটি অধ্যাদেশ। এর আওতায় নির্বাচন হয় ২০০৯-এর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর। তবে সাবেক ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতগুলো আর উপজেলায় ফিরে যায়নি। অন্যদিকে অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করতে গিয়ে নতুন সরকার এখানে সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা ও তার উপদেশ মেনে চলা বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

মফস্বলকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা হলো। এগুলোর নির্বাচন মূলত ছিল অরাজনৈতিক। কোনো দল এসব নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দিত না। অবশ্য প্রার্থীদের কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন সংশ্লিষ্ট। ভোটাররাও সাধারণ প্রার্থীর দলগত অবস্থান রাখত না বিবেচনায়। প্রার্থীদের গুণাবলি, অতীত কার্যক্রম, ভোটারের সঙ্গে সম্পর্ক, আঞ্চলিক অবস্থান ইত্যাদি ভোটদানে নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হতো। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে কতিপয় প্রার্থী থাকতেন জোরালো রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে। তাদের সমর্থনে স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীরা দলগত সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতেন। তবে বিপরীত চিত্রটাই ছিল অনেক বেশি। ফলে অনেকটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গণ্য হতো এসব প্রতিষ্ঠান। অন্য বিষয় নিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধ থাকলেও দলীয় পরিচয় নিয়ে তা হতো না। তবে বর্তমান দশকে সরকার এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে হবে। তাই হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক রেষারেষি এখন পৌঁছেছে তৃণমূল পর্যায়ে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন কেন্দ্রীয়ভাবে দেয়া হয়। জেলা পর্যায় থেকে দেয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন। এসব মনোনয়ন লাভ অনেক ব্যয়সাধ্য বলে খোলামেলা আলোচনা হয়। সরকারি দল মনোনীত প্রার্থীরা ভোটারের সমর্থনের চেয়েও গুরুত্ব দেন স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থনের ওপর। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী বলে সে সমর্থন তারা মোটামুটি পেয়েও যান। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচনের যুগবাহিত ধারায় হয়েছে পরিবর্তন। দেশের ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণের ছাপ তৃণমূল পর্যায়ে। এভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের কম সংখ্যকই সবার লোক হয়ে কাজ করতে পারছেন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন হলেও সময়ান্তরে এর রূপ পরিবর্তন ঘটেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের শাখা-প্রশাখা চলে গেছে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে। এমনকি ছাত্র, যুব, শ্রমিক, নারী ইত্যাদি অঙ্গসংগঠনেরও। বলতে হয় এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ভবিষ্যৎ বলবে এর সুফল কতটুকু আর অসম্পূর্ণতাই বা কোথায়?


আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন