ক্ষুদ্র ঋণের বৃহৎ প্রভাব

মো. এনামুল হক

ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব নিয়ে মতভেদ, তর্কবিতর্ক, বিরোধ অতীতেও ছিল, বর্তমানেও তা চলমান আছে। যারা ক্ষুদ্র ঋণ দেয় আর যারা নেয় তাদের মধ্যে এর প্রভাব নিয়ে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা দ্বিমত না থাকলেও সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং কিছু রাজনৈতিক নেতা এ নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করেন। সে বিষয়ে মাঝে মাঝে লেখালেখি হতে দেখি। ক্ষুদ্র ঋণ কি আদৌ দারিদ্র্য নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখে? ক্ষুদ্র ঋণ কি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণের জালে আবদ্ধ করছে? ক্ষুদ্র ঋণের চড়া সুদের হার কি গরিবকে আরো গরিব করছে? ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা কি তার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ভিটেমাটি হারাচ্ছে? আমরা এ প্রশ্নগুলোর প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হই। তবে নিরপেক্ষ গবেষণা বলছে, দেশের আর্থসামাজিক ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে ক্ষুদ্র ঋণ।

দক্ষিণাঞ্চলের দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর ও আইলায় আর্থিক ক্ষতির পর পরিবারগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণের বড় অবদান দেখিয়েছে আইএনএম। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় উঠে এসেছে, ওই সময়ে প্রতিটি পরিবারের যে ক্ষতি হয়েছে তার প্রায় অর্ধেকই বসতবাড়ির ক্ষতি। তবে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কিছু মানুষ ক্ষতির কবল থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারলেও ক্ষুদ্র ঋণ যারা নেয়নি তাদের বেশির ভাগই ফিরতে পারেনি। সাধারণ দুর্যোগ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সম্পদ বিক্রি, অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণ, সঞ্চয় ব্যবহার, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান কিংবা মাইক্রোফাইনান্স প্রতিষ্ঠানের ঋণ। আর্থিক সেবার বাইরে বিরাট একটি অংশ এখনো রয়ে গেছে। তবে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানসমূহ ঋণ ও সঞ্চয়ের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে যেসব পরিবারে ক্ষুদ্র উদ্যোগ প্রকল্প আছে তাদের গড় আয় অন্যদের তুলনায় বেশি। এছাড়া তাদের জীবনযাত্রার মান অপেক্ষাকৃত উন্নত। ফলে সার্বিক ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণের একটি বড় প্রভাব রয়েছে।

২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে গ্রামে-গঞ্জের আনাচকানাচে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ৪৯৬টি ক্ষুদ্রঋণ দানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২১ হাজার ৪০টি শাখা স্থাপিত হয়েছে। এতে কর্মরত রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষিত কর্মী। সদস্য সংগঠিত করে ক্ষুদ্র আর্থিক সেবায় এনেছে প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ পরিবারকে। এদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ মহিলা। প্রতি বছর ঋণ বিতরণ হয় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার মতো। যার স্থিতি থাকে মাঠে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জন ধরলে এ অর্জন আরো ১০-১২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আদায়ের হার ৯৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে। এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত, জামানতবিহীন ঋণগ্রহীতাদের পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, দুর্নীতিমুক্ত ঋণ বিতরণ ও আদায় ব্যবস্থার ফলে আদায়ের এ উচ্চ হার বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে। সারা দেশে নিবন্ধন ও নিবন্ধনের বাইরে প্রায় আড়াই হাজারের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠান এ আর্থিক সেবা প্রদানে নিয়োজিত হলেও মূলত ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও আশা এ তিনটি বড় প্রতিষ্ঠানের মার্কেট শেয়ার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। তবে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান যারা জাতীয় পর্যায়ে কাজ করছে, সে প্রতিষ্ঠানগুলো হলো টিএমএসএস, ব্যুরো বাংলাদেশ, সাজেদা ফাউন্ডেশন, বীজ, এমএসএস, এসএসএস, শক্তি ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। এছাড়া আঞ্চলিক বেশকিছু ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বেশ ভূমিকা রেখে চলেছে।

ক্ষুদ্র ঋণ হচ্ছে কোনো ব্যক্তি অথবা কিছু দরিদ্র সদস্যকে সমিতিবদ্ধ করে জামানতবিহীন অল্প পরিমাণ মূলধন হাতে তুলে দেয়া, যা দ্বারা স্ব-কর্মসংস্থান বা কোনো না কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, সংসারের স্বাভাবিক আয়ের উেসর সঙ্গে বাড়তি আয় সৃষ্টি করে। মোটাদাগে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে জামানতবিহীন অল্প পুঁজি, দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে মহিলা হচ্ছে এর গ্রহীতা। ব্যক্তি বা সমিতি দুটোর মাধ্যমে লেনদেন হয়। সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ, আয় থেকে ঋণের দায় পরিশোধ, স্ব-কর্মসংস্থান বা মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি। নিয়মিত সাপ্তাহিক সভায় নির্দিষ্ট একটি স্থানে লেনদেন। সদস্য ও সদস্যদের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য ঋণ কর্মকর্তারা সদস্যদের বাড়িতে গিয়ে সেবা নিশ্চিত করে। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে কী হচ্ছে সেটি বিশ্লেষণের জন্য কয়েকটি সূচকের উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে সেটি দেখা দরকার। প্রথমত দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণ বড় ধরনের কার্যকর ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকের মান উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের অবদান অনস্বীকার্য।

ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় তিন-চার দশক আগে শুধু কিছু ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে এর পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তাই এখন এটাকে বলা হয় ক্ষুদ্র আর্থিক সেবা যা ঋণের পাশাপাশি সঞ্চয়, মানি ট্রান্সফার, জীবন বীমা এসবকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে এর কর্মপরিধির অনেক বিস্তৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সাধারণত অনেকে মনে করে, ক্ষুদ্র ঋণে ৫-১০ হাজার টাকা একটা পরিবারকে দিয়ে থাকে। সময় ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সদস্যদের বিনিয়োগ সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি ও গ্রাজুয়েশন হওয়ার ফলে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে থেকে একটা বড় অংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। যারা ১০-২০ লাখ টাকা নিয়ে বিভিন্ন উদ্ভাবনী প্রকল্পে বিনিয়োগ করে এবং অনেক মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

ক্ষুদ্র ঋণের শুরুটা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, তত্কালীন সময় পাকিস্তান একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (পিএআরডি) যা বর্তমানে বার্ড কুমিল্লা নামে অধিক পরিচিত। এটি প্রতিষ্ঠাতা ড. আক্তার হামিদ খানের দ্বারা সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে প্রান্তিক ও ভূমিহীন বর্গাচাষীদের ঋণ দেয়ার মাধ্যমে। তারপর গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশাসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণে এর পূর্ণতা পায়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দুস্থ মানুষকে সহায়তা করার তাড়নায় প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্র্যাক। প্রথমে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে শাল্লা-দিরাইয়ের সহায়-সম্বলহীন ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ায় ব্র্যাক। শুরুতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৭৪ সালে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করে ব্র্যাক।

১৯৭৬ সালের চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম দিয়ে বড় পরিবর্তনের সূত্রপাত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মানুষ দরিদ্রদের জামানতবিহীন ছোট ঋণ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রামের ৪২ জন নারীর জন্য সহস্বাক্ষর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই করলেন। ঋণ পেলেন নারীরা, যথাসময়ে সুদ ও আসল ফেরত পাওয়া গেল। দরিদ্ররাও যে ঋণের যোগ্য ও যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন, সে শিক্ষাই এর মধ্য দিয়ে নথিভুক্ত হলো। জোবরা গ্রামের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক্রমান্বয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল গ্রামীণ ব্যাংকসহ অসংখ্য সংগঠনের হাত ধরে। গত চার দশকে ক্ষুদ্র ঋণ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাপ্তি পেয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। জাতিসংঘ ২০০৬ সালকে ইয়ার অব মাইক্রোফাইন্যান্স পালন করে। ক্ষুদ্র ঋণের বদৌলতে বাংলাদেশের ঘরে আসে নোবেল। ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ২০০৬ সাল থেকে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা লাভের পর এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫৯টি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর আগে অনেক এনজিও/এমএফআই, সমাজকল্যাণ/ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বা এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো থেকে নিবন্ধন নিয়ে কাজ করত। তবে ২০০৬ সাল থেকে এমআরএর লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

মূলধনের অভ্যন্তরীণ উৎস বিদেশী অনুদান নয়: অনেকে একটা ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন যে এনজিও মানেই বিদেশীদের অনুদান ও সাহায্যপুষ্ট, এটা কিন্তু ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে মোটেই প্রযোজ্য নয়। কয়েকটি সোর্স থেকে অর্থায়ন হয় তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস যেমন সদস্যদের সঞ্চয় প্রায় ৪৩ শতাংশ, বাড়তি আয় বা উদ্বৃত্ত হতে প্রায় ৩১ শতাংশ অর্থের জোগান আসে। প্রাতিষ্ঠানিক উৎস ব্যাংক থেকে ১৯ শতাংশ, পিকেএসএফ ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ২ শতাংশ (সিডিএফ স্ট্যাটিস্টিকস-২০১৮-১৯)। বিদেশী অর্থায়ন বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়।

ক্ষুদ্র ঋণের বহুমাত্রিক প্রভাব: নিঃসন্দেহে এটা প্রমাণিত ক্ষুদ্র ঋণের বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বিআইডিএস এবং বিভিন্ন গবেষক যেমন স্টুয়ার্ড রাদারফোর্ড, ড. এসআর ওসমানী, ড. আতিউর রহমান, ড. সাজ্জাদ জহির, ড. বিনায়ক সেন, সিডিএফ, আইএনএম, ইনাফি, এফএনবি সবার গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে দরিদ্র নিরসন ও নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার বিস্তার, দৈনন্দিন জীবনমান, আবাসিক, স্যানিটেশনের ব্যাপক উন্নতি হয়। স্বাধীনতা-উত্তর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি ছিল হতদরিদ্র। বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠী নেমে এসেছে প্রায় ১৮ শতাংশের নিচে এবং হতদরিদ্র ১০ শতাংশের নিচে। দেশের দরিদ্র হ্রাস পাচ্ছে প্রতি বছর ১-২ শতাংশ হারে। অনেক গবেষণা থেকে জানা গেছে, এ হার নিম্নগামী হওয়ার পেছনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা ছিল অন্যতম। গত কয়েক বছরের পৃথক পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ কর্তৃক ২০০৬-০৭ সালে পরিচালিত একটি গবেষণাকর্মে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে যারা ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে তাদের মাত্র ৭ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পেরেছিল। অন্যদিকে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার একটি গবেষণায় তার পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে আইএনএমের ২০১৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা ১০ শতাংশ। ফলে সংখ্যাতাত্ত্বিক অবদানের পার্থক্য থাকলেও দেশের দারিদ্র্য কমাতে ক্ষুদ্র ঋণের একটি বড় অবদান রয়েছে। কেননা দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণের স্পিল ওভার ইফেক্ট বা অন্যান্য চলকের ওপর ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাবকে বিবেচনায় নিলে অবদানটি আরো বড় হবে। দারিদ্র্য বিমোচনে শুধু ক্ষুদ্র ঋণের সরাসরি প্রভাবকে বিবেচনায় আনা হয়েছে।

তাছাড়া সরকারের সময়োপযোগী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, তৈরি পোশাক খাত, বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সও বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনজিওদের টার্গেটভিত্তিক ও নির্দিষ্ট এলাকাকে লক্ষ্য করে বিশেষ কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রেখেছে। যেমন উত্তরবঙ্গের মঙ্গা, উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীভাঙা অঞ্চলের জন্য বিশেষ কিছু কর্মসূচি। এছাড়া বাসযোগ্য বাড়িঘর নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সামাজিক বনায়ন, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন এসব ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসুখ-বিসুখে আধুনিক চিকিৎসা ও চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব শুধু দারিদ্র্য বিমোচন সূচক দিয়ে মূল্যায়ন করলেই হবে না। সেটিকে দেখতে হবে আরো বহুমাত্রিকভাবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার প্রসার হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখের অধিক নারী সদস্য রয়েছে যারা এনজিওদের ঋণের সবচেয়ে বড় গ্রাহক, যারা প্রতি সপ্তাহে দলীয় সভায় অংশ নেয়, পণ্যসামগ্রী বেচাকেনায় বাজার ও শহরমুখী হয়। এদের অনেকেই এখন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য—জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মতামতের বিশেষ প্রাধান্য বেড়েছে। সুতরাং মহিলারা পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণের উপার্জিত আয়ের একটি অংশ গ্রহীতার সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ব্যয় করছে। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের। তাই শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের অনুপাত প্রায় সমান সমান। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা একাডেমিক ফলাফল ছেলেদের চেয়ে ভালো করছে। শিক্ষা প্রসারের সাফল্যে মেয়ে শিশুদের বাল্যবিবাহও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও সামাজিক ও অন্যান্য অনেক সূচকেই আমরা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বেশ অগ্রসরমান। দেশের ভালো ভাবমূর্তি তৈরিতে ক্ষুদ্র ঋণের বাংলাদেশের মডেলগুলো যেমন আশা, ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক অনেক ভূমিকা রেখেছে। পৃথিবীর সব প্রান্তেই এসব মডেলের অনুসরণে ক্ষুদ্র ঋণ বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশের বাইরে প্রায় ১৩টির অধিক দেশে ?‘আশা’ মডেল, ১০টিরও অধিক দেশে ব্র্যাকের মডেল সরাসরি গ্রিনফিল্ড হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল সারা বিশ্বের অনেক জায়গায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাইরের দেশগুলোয় শুধু ক্ষুদ্র ঋণের কাজের জন্য বাংলাদেশের কয়েকশ ক্ষুদ্র ঋণে বিশেষজ্ঞ কর্মী কাজ করছে, যারা বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে দেশের জন্য। নিউইয়র্কভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের সমীক্ষায় আশা বিশ্বের শীর্ষতম ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা নির্বাচিত হয়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০ ডিসেম্বর ২০০৭ সংখ্যায় বিশ্বের ৫০টি শীর্ষস্থানীয় ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার তালিকা প্রকাশ করে, যার মধ্যে আশা শীর্ষতম স্থান অধিকার করে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইন্টারন্যাশনাল মাইক্রোফাইন্যান্স এক্সচেঞ্জ বিশ্বের ৬৪১টি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কার্যক্রমের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এ তালিকা প্রস্তুত করে। আনন্দের বিষয় এ তালিকায় দ্বিতীয় হয়েছে ভারতের ‘বন্ধন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যা ‘আশা’ মডেলের হুবহু বাস্তবায়ন করছে।

ক্ষুদ্র ঋণের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ এখন মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ঋণগ্রহীতার ওভারলেপিং বা দ্বৈততার ফলে Over Indebtness, ক্ষুদ্র ঋণ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ক্রমান্বয়ে ট্রান্সফরমেশন, তহবিলের স্বল্পতা, ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং এবং সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ করোনার প্রভাব। প্রতি বছর বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে ঋণগ্রহীতা সদস্যদের চরম কষ্টের কারণ হয়। করোনাকালে প্রায় ছয় মাসের বেশি ঋণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সদস্যরা তাদের জমাকৃত সঞ্চয় প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছে। জীবন-জীবিকার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। কর্মসংস্থান ব্যাপক হারে কমেছে। এতে আশঙ্কা করা হচ্ছে দারিদ্র্যসীমার হার ২০-৩০ শতাংশে পৌঁছতে পারে। বাল্যবিবাহ ও সামাজিক অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অংকের টাকা আদায়ের সম্ভাবনা কম, যা মন্দ বা শ্রেণীকৃত ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। তাই এ ক্ষতি পুষিয়ে আনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিআইবির আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রকল্পভিত্তিক জীবন ও ফসল বীমা পদ্ধতি চালু ও বাস্তবভিত্তিক মানানসই পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। করোনার জন্য প্রণোদনা বিতরণে লাইসেন্সকৃত ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্তকরণ ও ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক যে ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে দেয়ার জন্য চাহিদানুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান সরকার থেকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ঋণের পথিকৃৎ হলেও সারা বিশ্বে তা মালিকানা ফর প্রফিট এনবিএফসি হিসেবে কাজ করছে কিন্তু বাংলাদেশে এখনো নট ফর প্রফিটের ভিত্তিতে চলছে। নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে।

এছাড়া ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা পরিমাপের জন্য সূচক নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাদের ঋণের মাধ্যমে কে কীভাবে লাভবান হচ্ছে কিংবা সমাজের পরিবর্তন আনতে তার মূল্যায়ন বাড়াতে প্রয়োজন আরো সুদূরপ্রসারী গবেষণা। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা বিশ্লেষণের জন্য একটি সামগ্রিক গবেষণা প্রয়োজন। আবার ক্ষুদ্র ঋণের পরিমাণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সংস্কার প্রয়োজন কিনা সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে।


মো. এনামুল হক: সাবেক চেয়ারম্যান, ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (সিডিএফ)

সদস্য, পরিচালনা পর্ষদ, আশা ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, আশা ইন্টারন্যাশনাল


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন