সমাজ কাঠামোর রাজনৈতিক রূপান্তর

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের যেকোনো অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ডব্লিউডব্লিউ হান্টারের ‘এনালস অব রুরাল বেঙ্গল’ (স্মিথ এলডার অ্যান্ড কোম্পানি, লন্ডন, ১৮৯৭) একটি আকর গ্রন্থ। সমসাময়িক ইতিহাসে তথ্য, প্রমাণ ও পরিসংখ্যান দিয়ে ‘গ্রামীণ জীবন’ আর কোনো গ্রন্থ পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপিত নয়। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মুখার্জি (১৯৪২-৪৫) এবং একে নাজমুল করিম (১৯৫৬) এক্ষেত্রে পথিকৃতের কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর গ্রামীণ জীবন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও প্রকাশনা লক্ষ করা যায়। এসব গবেষণার মধ্যে নেতৃস্থানীয় হচ্ছেন হামজা আলাভী, জে পিটার বাট্রোসি, এরেঞ্জ ইয়েনেকা/ইওসফান ব্যুরদেন এবং আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে আরো বিস্তৃত ও ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এক্ষেত্রে আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর গবেষণা কর্মটি আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়ের পরিপূরক। তার প্রকাশিত গ্রন্থটির নাম ‘এ বাংলাদেশ ভিলেজ এ স্টাডি অব সোস্যাল স্টারটিফিকেশন।’ একটি গ্রামের সামাজিক স্তরবিন্যাসের সমীক্ষা হলেও প্রকারান্তরে এটি হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র। এ চিত্রকে ভিত্তি করে পরবর্তী চার দশকে সমাজের ক্রমশ রূপান্তর অধ্যয়ন করা সহজতর হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে হলেও সত্য, এ গবেষণা কর্ম নিষ্পন্ন হওয়ার ঠিক ৩৪ বছর পর এ ধরনের আরেকটি গবেষণা কর্ম লক্ষ করা যায়। মানে-সম্মানে ও গুরুত্বে প্রথম গবেষণা কর্মটির সমকক্ষ না হলেও তা একই বিষয়কে উপস্থাপন করেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের পিএইচডি গবেষক মো. রিয়াদ সিদ্দিকী ২০১২ সালে গবেষণা কর্মটি সম্পন্ন করেন। তিনি গত চার দশকে পরিবর্তনশীল গ্রাম নেতৃত্বের স্বরূপ সন্ধান করেছেন। সেক্ষেত্রে একটি ইউনিয়নকে বেছে নিয়েছেন গবেষণার পাদভূমি হিসেবে। 

প্রফেসর আনোরুল্লাহ চৌধুরী তার গ্রন্থের ক্ষমতা ও রাজনীতি অধ্যায়ে গ্রামের সামাজিক স্তর বিন্যাস ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি গ্রামীণ সমাজকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন—অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ। তিনি দেখিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার মালিক তারাই যারা উৎপাদনের সব উপায় উপকরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর বহিস্থ ক্ষমতার মালিক রাজনীতিবিদরা। জনাব চৌধুরী তার বিশ্লেষণে বলেছেন, যদিও ভূমিনির্ভর সামন্তবাদ ১৯৭৮ সালে ক্ষয়িষ্ণু, তারাই প্রকারান্তরে গ্রামীণ ক্ষমতার মালিক। রক্ষণশীল রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্রমহ্রাসমান এবং নতুন ভূমি ও ক্ষমতানির্ভর রাজনীতি বিকাশমান। গ্রামীণ সমাজকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেছেন— একদল তার ভাষায় ‘খানদানি’। অন্য দল গৃহস্থ এবং কামলা। গৃহস্থরা ছোটখাটো ভূমি মালিক এবং ক্রমশ ক্ষমতাবান। কামলারা নিম্ন স্তরের দিনমজুর। শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি এবং আইনজীবী পেশার মতো ক্ষেত্রে গ্রামীণ নেতৃত্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। পুরনো খানদানিরা ক্ষয়িষ্ণু হলেও তখন পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে যায়নি। ওই সময়ই গ্রামীণ নেতৃত্বে কুশলতা এবং অর্থের আধিক্য লক্ষ করা যায়। জনাব চৌধুরীর বর্ণনায় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক পরিচয় ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ গ্রামীণ রাজনীতিতে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন নেতা ও কর্মীরা দলীয় পরিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রমাণ পেয়েছেন যে, স্থানীয় এমপি ওই সময়ে গ্রামীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তখনো শাসক দলের গ্রামীণ অংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রবল অভিযোগ ছিল। নব্য ধনিক শ্রেনীর উদ্ভব, শিক্ষা সচেতনতা ও রাজনীতির পসার ও প্রসার সত্ত্বেও জনাব চৌধুরী এ মর্মে উপসংহারে পৌঁছেন যে, ‘এতদসত্ত্বেও ভূমি, অর্থ ও মানুষের ওপর খানদানিদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে’। বাংলাদেশ এখনো একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষির প্রাধান্যের কারণেই গ্রামই বাংলাদেশের প্রাণ। গ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর মৌলিক সংগঠন। বাংলাদেশ সম্পর্কে যেকোনো সমীক্ষা, গবেষণা ও অধ্যয়ন গ্রাম ব্যতীত সম্ভব নয়। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি বৃহৎ গ্রামই রয়ে গেছে। এটাই জনগণের আসল ঠিকানা। ঈদে-উৎসবে এবং আপদের করোনাকালে সেখানেই তাদের প্রত্যাবর্তন ঘটে। ঢাকা রাজধানী বটে, সব কর্মচাঞ্চল্যের কেন্দ্রবিন্দু। সেই কেন্দ্রবিন্দুর প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে গ্রামের গহিন গভীরে। রূপকথার ‘গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়’। সুতরাং বাংলাদেশকে জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে। বাংলাদেশ একটি গ্রামপ্রধান দেশ। 

গ্রামীণ নেতৃত্বের রূপান্তর: গতানুগতিক থেকে রাজনৈতিক: গ্রামীণ নেতৃত্বের রূপান্তর সম্পর্কে জানতে সেখানে ক্ষমতার উেসর অনুসন্ধান প্রয়োজন। এটা নিঃসন্দেহ যে ভূমিকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভূমির মালিকই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। আর যেহেতু গ্রামীণ সমাজের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপাদান এখনো কৃষি, সেহেতু ভূমির মালিকই হচ্ছেন দৃশ্যত গ্রামীণ নেতৃত্বের প্রধান ধারক-বাহক। এ উপাদান গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর প্রধান উৎস মাত্র নয়। বরং অর্থনীতি, রাজনীতি ও স্থানীয় কর্তৃত্বের মূল ভিত্তি। ভূমি মালিকানার কারণে তারা সমাজের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পেশা ও কর্মক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। গ্রামীণ নেতৃত্ব সহজেই হয়েছে রূপান্তরিত। শহরে তথা শিল্পাঞ্চলে যে লোকটি কাজ করে এখন আর সে ‘বড়মিয়া’র ওপর নির্ভরশীল নয়। তবুও মুরুব্বি বলে কথা! সতত গ্রামীণ সংস্কৃতিতে তিনি এখনো রাজা। গত ৫০ বছরে ধীরে ধীরে সে নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্বের অভ্যুদ্বয় ঘটেছে। পরিবর্তন এবং নতুন নেতৃত্বের কারণগুলোকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। 

১. নতুন প্রজন্ম: সমাজের অনিবার্য পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় পুরনো গতানুগতিক বংশধারার নেতৃত্ব আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। শিক্ষিত, গতিশীল, চৌকস ও নতুন প্রজন্ম পুরনোর স্থান দখল করছে। তাই তালুকদার বাড়ি, মিয়াবাড়ি, হাওলাদারবাড়ি ও গাজীবাড়ির কর্তৃত্ব হ্রাস পেয়েছে। হয়তো বা পুরনো ধারার নতুন প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন রাজনীতির।

২. শিক্ষা: বর্তমান যুগে শিক্ষা নেতৃত্বের একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোর অনুঘটক হিসেবে অনবরত কাজ করছে শিক্ষা। এখন ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার কাঠামোয় শিক্ষিত জনশ্রেণীর প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।

৩. এনজিও: বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর ধীর ও স্থিতিশীল পরিবর্তনে বেসরকারি সংস্থা-এনজিওরা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। পিছিয়ে পড়া গ্রামের নেতৃত্ব দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীদের ক্রমে ক্ষমতায়ন ঘটছে। 

৪. অকৃষি কর্মসংস্থান: ভূমি অপ্রতুলতার কারণে গ্রামীণ জনশ্রেণী ব্যবসা, চাকরি, ঠিকাদারি ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। এছাড়া গ্রাম বা ইউনিয়নভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ছোট ছোট সেবামূলক চাকরি সংস্থান হওয়ায় গতানুগতিক সমাজ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসছে।

৫. নয়া সংস্কৃতি: পুরনো গ্রামভিত্তিক নেতৃত্ব মুরুব্বিয়ানা বা অভিজাত। এখনকার নেতৃত্ব বন্ধুত্বের। মেম্বার-চেয়ারম্যান জনগণের ওপর কর্তৃত্বশীল হওয়ার সময় শেষ হয়েছে। সমমনোভাবাপন্ন ও সমমর্যাদাসম্পন্ন নেতৃত্বের বিকাশ হচ্ছে।

৬. ক্ষয়িষ্ণু ধর্মীয় নেতৃত্ব: আগে ধর্মীয় নেতারা মাওলানা, মৌলভী, ইমাম-মোয়াজ্জেন তথা ধর্মীয় শিক্ষিত এবং ধার্মিক লোকেরা সমাজের স্বাভাবিক নেতা হিসেবে গণ্য হতেন। স্বাধীনতার পর সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব হ্রাস পায়। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পারিবারিক ও যৌন অনাচার রোধে এরা ফতোয়া এবং ধর্মীয় বিচার আরোপ করত। এসব করে এখন এরা সরকারি বিধিনিষেধ ও ক্ষেত্র বিশেষে বিপাকে পড়ছে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া নিষিদ্ধ হওয়ার প্রস্তাবনাও এদের প্রভাব খর্ব করেছে। 

৭. আধুনিকায়ন ও নগরায়ণ: এর ফলে একদল মধ্যস্বত্বভোগী আধুনিক নগরবাসী নেতৃত্বের আবির্ভাব হয়েছে। এসব গ্রামীণ নেতৃত্বের শিকল গ্রামে থাকলেও এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহরে প্রধানত রাজধানীতে বসবাস করে। 

৮. বহুমুখী নেতৃত্ব: গ্রামীণ নেতৃত্ব এখন বহুমুখী বা প্লুরালিস্টিক। একজন ব্যক্তি এখন একাধারে নেতা, ভূস্বামী, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ইত্যাদি। নেতৃত্বের বহুমুখী বিকাশের ফলে চ্যালেঞ্জও বহুমুখী। সনাতনী মূল্যবোধও অপসৃয়মাণ। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা অনেক। 

৯. সন্ত্রাস: এতদিন ধরে সন্ত্রাসকে জাতীয় রাজনীতির অনুষঙ্গ বলে মনে করা হতো। দলীয় ভিত্তিতে চেয়ারম্যান নির্বাচনের অভিনব সিদ্ধান্ত গ্রামে সন্ত্রাস রফতানি করেছে। প্রতিপক্ষকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ না করে সন্ত্রাসের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণের প্রবণতা প্রকট হয়ে উঠেছে। দলীয়করণের ফলে জাতীয় পর্যায়ের মতো প্রতিপক্ষকে হামলা, মামলা, গুম ও খুনের মাধ্যমে মোকাবেলা করার অপসংস্কৃতি রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিরোধী নেতৃত্বকে ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া ও গ্রামছাড়া করার মাধ্যমে গ্রামীণ রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। গ্রাম দেশে ভাইরাল একটি উক্তি এ রকম: ‘কইছে নেতায়, বুঝবে থানায়, কোপা সামশু কোপা’। 

১০. ক্ষমতার রাজনীতি: সর্বশেষ এবং সর্বপ্রধান দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে গ্রামীণ রাজনীতি ও নির্বাচনে। জাতীয় রাজনীতির সম্পৃক্ততা বর্তমান রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকপরিবর্তন। গ্রাম পর্যায়ে দলীয় কার্যক্রমের প্রসার স্থানীয় নেতৃত্বকে দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ সম্ভব ও সহজ করে তুলেছে। বর্তমান গ্রামীণ সমাজের অধিকাংশ নেতাই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। রাজনীতিতে সেবা ধর্ম পরিত্যক্ত হয়েছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অর্থ, বিত্ত, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস। সে কারণে গ্রামীণ নেতৃত্ব নিম্নমুখী না হয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে শহুরে নেতাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাই ক্ষমতায় আরোহণের মোক্ষম উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কালো টাকার প্রভাব। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হবে যে, একজন প্রার্থী চেয়ারম্যান হতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এ ধরনের প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যথার্থই মন্তব্য করেন যে, ‘গ্রামীণ রাজনীতির সঙ্গে জাতীয় দলাদলির রাজনীতি যুক্ত হওয়ায় গ্রামীণ রাজনীতি এখন দাঙ্গামুখর হয়ে উঠেছে।’ (আবদুল মাননান:২০৩:১৩৯)। সেই পুরনো আমল থেকেই গ্রামীণ রাজনীতি সরকারমুখী। পাকিস্তান আমলের মৌলিক গণতন্ত্র বা হাল আমলের উন্নয়নের গণতন্ত্র সবসময় গ্রামীণ সুবিধাবাদী রাজনীতির স্থায়ী সমর্থক থেকেছে। একজন গ্রামীণ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ইতোমধ্যেই মন্তব্য করেছেন যে, ‘বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া ও ক্ষমতাচর্চা করার প্রত্যাশায় গ্রামীণ নেতারা সাধারণত সরকার সমর্থক হয়।’ (আতিয়ুর রহমান:১৯৮৮:২২)। অস্বাভাবিক যা তা হচ্ছে, একদলীয় নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি। প্রায় প্রতিদিনই গ্রামে ত্রাণ চুরি, আত্মসাৎ ও অপব্যবহারের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। করোনাকালের মতো কঠিন সময়েও এ অপরাধের ব্যাপকতা একটুও হ্রাস পায়নি। ছিটেফোটা ব্যবস্থা দৃশ্যমান হলেও রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয়ের ‘সাত খুন মাফ’ সংস্কৃতি তথা বিচারহীনতাকে দুষছেন বিজ্ঞজনরা। 

পোষক-পোষ্য সম্পর্কের রূপান্তর: ইতিপূর্বে বর্ণিত গ্রামবাংলার নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের বিষয়কে যদি একটি প্রত্যয় বা টার্ম দ্বারা এক কথায় প্রকাশ করতে বলা হয় তাহলে বলতে হবে: ‘পোষক-পোষ্য’ সম্পর্ক। বস্তুত যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের গ্রামীণ সমাজ বিশ্লেষণে সমাজতাত্ত্বিকরা এ জুতসই শব্দযুগলই ব্যবহার করেন। পোষক-পোষ্য সম্পর্ক এক ধরনের দ্বিমুখী সম্পর্ক। পোষ্যের আনুগত্য ও সমর্থনের ওপর পোষক নির্ভরশীল। অসম পদমর্যাদার ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক লেনদেনের ওপর পোষক-পোষ্য সম্পর্ক ভিত্তিশীল। পোষক আশা করে পোষ্যের নিকট প্রশ্নহীন আনুগত্য। এরিক জি জেনসেন বাংলাদেশের পোষক-পোষ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন: ‘পোষ্য তার প্রশ্নহীন আনুগত্য ও সেবার বিনিময়ে কেবল কর্মসংস্থান বা জমি বর্গাই প্রত্যাশা করে না, বরং সংকটের মুহূর্তে পোষকের সমর্থনও প্রত্যাশা করে’। (এরিক জি জেনসেন:৫৮)। পাওয়েল পোষক-পোষ্য সম্পর্ককে বলেছেন: “A relationship involving interchange of non-comparable goods and serviced between actors of unequal socioeconomic rank. (উদ্ধৃতি, বিকে জাহাঙ্গীর:১৯৮২:৮৮)। বিকে জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিদ্যমান পোষক-পোষ্য সম্পর্ককে নিম্নরূপভাবে বিবৃত করেছেন: “The special case dyadic (two-person) ties involving friendship in which an individual of superior socio-economic status (patron) used his influence and resources to provide protection or benefits, or both, for a person of inferior status (client), who reciprocates by offering support, including personal services, to the patron does operate in the agrarian structure in the Bangladesh. (B. K. Jahangir: 1982:88). বিকে জাহাঙ্গীরের সংজ্ঞায় স্পষ্ট হয়েছে, এটা রীতিমতো দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। আমরা ইতোমধ্যে প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছি, বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক একটি মূল্যবান ভিত্তি। সেই সঙ্গে আমরা এ কথাও উল্লেখ করেছি, বস্তুত এ সম্পর্ক এখন ক্ষয়িষ্ণু। তবে অতি সাম্প্রতিক প্রবণতা এই যে, পোষক-পোষ্য সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি ঠিকই আছে, বদলে যাচ্ছে এর খোলস। আগে যেখানে পোষক-পোষ্য সম্পর্ক ছিল ভূমিনির্ভর বা গোষ্ঠীনির্ভর, তা এখন রাজনীতিনির্ভর হয়েছে। ধরন পাল্টেছে মূল বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে। হঠাৎ করেই তা হয়েছে, সেটি আমরা বলিনি। যেসব কারণে গতানুগতিক নেতৃত্ব ক্রমহ্রাসমান হয়েছে অর্থাৎ শিক্ষা, এনজিও, অকৃষি পেশা ও নতুন প্রজন্ম ইত্যাদি কারণগুলো বহমান ও বর্তমান থাকা সত্ত্বেও অতি সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে রাজনীতির নিরঙ্কুশতা। পুরনো প্রভুর বদলে নতুন প্রভুর উপস্থিতি। আবদুল মান্নান তার গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ সমাজে এক ধরনের রাজনৈতিক পোষকের বা পলিটিক্যাল পেট্রোনের সৃষ্টি হয়েছে। এরা স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। দলীয় রাজনীতির কর্মতত্পরতা গ্রাম পর্যায়ে বিস্তার লাভ করার ফলে এ ধরনের পোষকের সংখ্যা ও ভূমিকা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি, সরকারি অফিস-আদালতে যোগাযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রয়োজনে এ ধরনের পোষকের আশ্রয় গ্রহণ করে। এক ধরনের শিক্ষিত, রাজনৈতিক চাতুর্য সম্পন্ন ধূর্ত মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে অধিক সুবিধা লাভ করে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের পোষ্যদের কাছ থেকে আনুগত্য, সমর্থন ও ভোট ইত্যাদি পেয়ে থাকে। এ ধরনের পোষকের অর্থের মূল উৎস রাজনৈতিক দল, স্থানীয় প্রশাসন ও পোষ্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধাদি ইত্যাদি। এরূপ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক: অসম, শোষণমূলক ও কর্তৃত্বপরায়ণ। গ্রামীণ সমাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভূমিকা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত। তারা জনগণের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সাহায্য-সহযোগিতা তাদের দ্বারা বণ্টিত হয় এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। গ্রামীণ বিরোধ-মীমাংসার লক্ষ্যে তাদের হাতে বিচারমূলক ক্ষমতাও প্রত্যর্পণ করা হয়েছে। এসব কারণে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা পোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পান। সরকারি সুযোগ-সুবিধাপ্রত্যাশীরা এদের পোষ্য। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ সরকারি আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দ্বারস্থ হয়। সাধারণ মানুষ এদেরকে বিনয়, সমর্থন, আনুগত্য প্রদান করে এবং অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ভোট প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে তারা চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাছ থেকে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। আবদুল মান্নান আরো দেখিয়েছেন, পোষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা বা কোয়ার্সিভ পাওয়ার। এটি পোষক-পোষ্য সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। পোষক-পোষ্যের অসম শোষণমূলক ও নিবর্তনমূলক সম্পর্কের বিরুদ্ধে পোষ্যরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদী হয়। সুযোগ পেলেই তারা চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে। সমাজের সব ধরনের নিপীড়ন ও বলপ্রয়োগের ক্ষমতা পোষকের হাতে। এর ফলে তারা এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে পোষ্যের বিরোধিতাকে দমন করে পোষ্য-পোষক সম্পর্ক চিরস্থায়ী করার জন্য। 

বাস্তব গবেষণা সমীক্ষা: সরাসরি পোষ্য-পোষক সম্পর্কিত না হলেও এ ধরনের আরেকটি গবেষণা সম্পাদিত হয় ২০১২ সালে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগে পিএইচডি সন্দর্ভ হিসেবে এটি উপস্থাপিত হয়। গবেষক মো. রিয়াদ সিদ্দিকী ‘পরিবর্তনশীল গ্রামীণ নেতৃত্ব: সানোড়া ইউনিয়নের কেস স্টাডি’ শিরোনামে গবেষণাটি উপস্থাপন করেন। গবেষণায় প্রমাণিত হয়, গতানুগতিক পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ভাটা পড়লেও ভূস্বামীর পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পোষক-পোষ্য সম্পর্কের উত্পত্তি হয়েছে। গ্রামীণ নেতারা জাতীয় নেতাদের পোষ্যে পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালে পরিচালিত এ গবেষণায় দেখানো হয়, ওই সময়ে ১৯৭১ সালের তুলনায় ভূমিকেন্দ্রিক পোষক-পোষ্য ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আর আধুনিক রাজনৈতিক পোষ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ শতাংশ হয়েছে। গ্রামে জনকল্যাণমূলক উপস্থিতিতে চতুর, চটপটে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের স্বার্থ হাসিল প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন আবির্ভূত নেতৃত্ব জাতীয় নেতাদের কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রকাশ করছে। এ ধরনের নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যাংকের ম্যানেজার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রেখে চলে। এদের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজের অবকাঠামোগত কিছু উন্নতি হলেও স্থায়ী উন্নয়ন ঘটছে না। পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯০ সালে ৪৬ শতাংশ গ্রামীণ নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। দিনে দিনে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে এ পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ৮০ শতাংশ। গবেষক দেখিয়েছেন, এসব নেতৃত্ব তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত হলেও শিক্ষার অন্তর্নিহিত লক্ষ্য এদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়নি। ওই নির্দিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এনজিও নেতা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের শিক্ষা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের ফলে এক নতুন ধরনের নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটেছে। বিভিন্ন সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে নতুন নতুন নেতার আবির্ভাব ঘটছে। কৃষি, সমবায়, ডিলারশিপ, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষিঋণ বিতরণে সহায়তা করে নেতৃত্বের আসন দখল করছে। গবেষক যুক্তি প্রদর্শন করছেন, যেহেতু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সম্পদ আহরণের কোনো সুযোগ নেই সেহেতু এ নতুন নেতৃত্ব সরকারি প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে থেকে অধীন নেতায় পরিণত হচ্ছে। গবেষক দেখিয়েছেন, ১৯৯০ সালে যেখানে ৬০ শতাংশ নেতা নগরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, সেখানে ২০১০ সালে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ শতাংশ হয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, কৃষকের জন্য ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। কৃষিজমির মালিকানা ১৯৯০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা খাতে ১৯৯০ সালে যেখানে ২৬ শতাংশ লোক নিয়োজিত ছিল, ২০১০ সালে এসে তা ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে কৃষির অবস্থা ক্রমহ্রাসমান। ১৯৯০ সালে কৃষিজীবীর সংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশ আর ২০১০ সালে তা ৩৬ শতাংশ নেমে এসেছে। অথচ একই সময়ে স্থানীয় নেতাদের কাছে নগদ অর্থের বৃদ্ধি ঘটেছে। ১৯৯০ সালে যেখানে বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকা ছিল সর্বাধিক ৩৮ শতাংশ নেতার হাতে। সেখানে ২০২০ সালে ৫০ শতাংশ নেতার হাতে গড় টাকার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমরা মূল নিবন্ধে বলেছি, গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্রমহ্রাসমান হয়েছে। সিদ্দিকীর গবেষণায়ও দেখা যায়, ১৯৯০ সালে স্থানীয় নেতৃত্বের ৭৬ শতাংশ পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত নেতৃত্ব থেকে এলেও ২০১০ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৫৬ শতাংশ হয়েছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, স্থানীয় নেতৃত্বের পরিবর্তনের প্রবণতা প্রবল। গবেষণার আরো একটি তাত্পর্যপূর্ণ দিক হলো, নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব। এরা অর্থনৈতিক কাজ, জনকল্যাণকর সেবা, উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের মাঝে উৎসাহ সৃষ্টিতে কাজ করছে। এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের চেয়ে আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। মূল নিবন্ধে আমাদের একটি অনুমান ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের ওই অনুমান এ বাস্তব গবেষণা দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, সচেতনতা সৃষ্টি, সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন ও দ্বন্দ্ব মীমাংসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গবেষক কারণ হিসেবে গ্রামীণ সমাজে জাতীয় রাজনীতির প্রবেশকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে তার গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, গ্রামীণ রাজনৈতিক নেতারা রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার বা বাস্তবায়নে অতটা আগ্রহী নন, যতটা না তারা জাতীয় নেতাদের তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করছেন। সরকারি রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন কমিটির নেতারা টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজে লুটপাট ও সরকারি ত্রাণ আত্মস্থ করার জন্য সবসময়ই উৎ পেতে থাকেন। জাতীয় নেতাদের যোগসাজশে তারা অবাধে এ অন্যায় অপকর্মগুলো করে যান। বিরোধী রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন কমিটির নেতারা সরকারি দলের হুমকির মুখে সবসময়ই তটস্থ থাকেন। সরকারি রাজনৈতিক দলের মধ্যে গ্রুপিং ও সহিংসতা বেশি দেখা যায়। স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে লোকজনকে দলে টানার চেষ্টা করে। গবেষণায় আরো দেখানো হয়, অকৃষি অর্থনীতির প্রসার ঘটেছে। বর্তমান গ্রামীণ নেতৃত্ব মাঝারি ও নিচু বংশ উদ্ভূত। তবে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা অধিকতর। অভিসন্দর্ভের উপসংহারে আরো বলা হয়, জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের পর নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে সত্য কিন্তু গুণগত পরিবর্তন বা গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটেনি। এখানে একটি পরিসংখ্যান দিয়ে উঠতি নেতৃত্বের অধিকতর জাতীয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করার প্রয়াস পান। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে যেখানে ৩০ শতাংশ নেতা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সেখানে ২০১০ সালে এসে ৭০ শতাংশ হয়েছে। ১৯৯০ সালে ৮ শতাংশ নেতা এনজিও কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, ২০১০ সালে সেখানে ৩০ শতাংশ নেতা সম্পৃক্ত। গবেষণার অবশেষে জনাব সিদ্দিকী আবারো জোর দিয়ে বলেন, ‘গতানুগতিক পোষক-পোষ্য সম্পর্কের ভাটা পড়লেও ভূস্বামীর পরিবর্তে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পোষক-পোষ্যের সম্পর্কের উত্পত্তি হয়েছে। গ্রামীণ নেতারা জাতীয় নেতাদের পোষ্যে পরিণত হয়েছেন। (মো. রিয়াদ সিদ্দিকী: অপ্রকাশিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ:২৬৫)

গত ৫০ বছরে সমাজ কাঠামোর রূপান্তর যেভাবে ঘটেছে এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক ইতোমধ্যেই বিশ্লেষিত হয়েছে। আমরা নিশ্চয় লক্ষ করেছি, এ রূপান্তর ঘটেছে ক্রমশ এবং ধীরগতিতে। কাঠামোগত পর্যায়ে সেই পুরনো পঞ্চায়েত থেকে কীভাবে পরিষদে উত্তরণ ঘটেছে তা আমরা দেখেছি। আবার সমাজ পরিবর্তনের অনুষঙ্গগুলো কীভাবে নীরবে-নিভৃতে বিকশিত হয়েছে, তাও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষত ১৯৭৮ ও ২০১২ সালে পরিচালিত দুটি গবেষণা সমীক্ষা আমাদের প্রমাণ্য প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে সমাজতাত্ত্বিকদের কাছে ২০১৫ সালে ঘোষিত দলীয় পর্যায়ে বা প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থা অনেকটাই আকস্মিক ও আরোপিত। নিয়মানুগভাবে যে প্রথা প্রক্রিয়া এসব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়, তা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। সরকারবিরোধীরা মনে করেন, সরকার চিরস্থায়ীভাবে তার ক্ষমতার ভিতকে সুদৃঢ় করার জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দলীয়করণ করেছে। আকবর আলী খান মনে করেন, ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্রমশ রাজনীতিকরণ গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ’। (আকবর আলী খান, ডেইলি সান, ২৫ মার্চ, ২০১৬)। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ মন্তব্য করেন, ‘সাম্প্রতিক রাজনীতিকরণের সিদ্ধান্ত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করবে’। (তোফায়েল আহমেদ, ডেইলি সান, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬)। সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিত্বশীল বদিউল আলম মজুমদার স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে দলীয় প্রতীককে ‘বিপজ্জনক’ বলে অভিহিত করেন। (দ্য ডেইলি স্টার, নভেম্বর ৭, ২০২০)। দুজন লোক প্রশাসন গবেষক তাদের গবেষণা নিবন্ধে এ ধরনের রাজনীতিকরণকে সুষ্ঠু স্থানীয় সরকারের প্রতিবন্ধক এবং ক্ষমতাসীন দলের অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। (আল-ফাহাদ ভূঁইয়া, রিপন হোসাইন, Party-based Local Government Election in Bangladesh: Problems and Comprehancive Solution, International Journal of Scientific and Research Publications, Volume-08, Issue 10, October 2018)

অতীতে, নিকট অতীতে কিংবা সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা স্পষ্ট যে, ক্ষমতাসীন সব দলই স্থানীয় সরকারকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে প্রাথমিক ভিত হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে। ২০১৫ সালে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও প্রতিষ্ঠানিকতা বিরোধী। প্রচলিত ও প্রকাশিত জনমত যে এ পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়নি তা সহজেই বলা যায়। এ নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, চিরায়ত গ্রামীণ নির্বাচন ব্যবস্থার অপলোপন। কালো টাকা ও পেশি প্রভাবিত হয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। একরকম প্রকাশ্যেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ভোট প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে। তারাই স্লোগান দিয়েছে ‘চেয়ারম্যান ওপেনে, মেম্বার গোপনে’। এর ফলে দলীয় ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তির নামে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে। ধর্ষণ ও হত্যাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যে, এ বাহিনী দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না। এসব বাহিনী স্থানীয় প্রশাসনকে অকার্যকর করে ফেলেছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় দলীয়করণে গজিয়ে ওঠা দুর্বৃত্ত দল। হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন ও সুপারিশ পেশ করার জন্য একটি বিদ্বজন কমিটি করে। কমিটি যে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে তা গ্রামীণ সমাজ কাঠামোতে রূপান্তর প্রশ্নে প্রাসঙ্গিক। কমিটি বলেছে, ‘দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন সনাতন পঞ্চায়েত প্রথাকে বিলুপ্ত করেছে। গ্রামের মুরুব্বিদের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল এবং সামাজিক শৃঙ্খলায় যে ভূমিকা ছিল, তা খর্ব হয়ে পড়েছে। দলগতভাবে বিভক্ত সমাজে মুরুব্বিদের প্রভাব আর খাটছে না। ফলে দলীয় ছত্রছায়ায় অস্ত্র, মাদক ও অর্থবলে এক শ্রেণীর লোক গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব বিস্তার করে সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা ও নির্যাতনের মাধ্যমে জিম্মি করে রেখেছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত অবস্থা সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত বাহিনীকেও যেন তারা অবজ্ঞা করছে। প্রকারান্তরে সরকার ও রাষ্ট্রকে ওই সন্ত্রাসী চক্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছে। এর অবসান হওয়া উচিত। তাই আমরা মনে করি, নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে এ ধরনের সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মূল ও দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা এখন সময়ের দাবি।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ অক্টোবর ২০২০)। কমিটির সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। সেই সঙ্গে এ উপলব্ধিও দরকার, গ্রামীণ রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অবসান প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে দলীয় পরিচয়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবশ্যই পরিত্যাজ্য। 

কবি গুরুর ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলো’ এখন অশান্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ‘আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন, মিলেমিশে ওরা আছে যেন আত্মীয় হেন’। এখন আত্মীয়তার পরিবর্তে সেখানে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে। আর বিদ্বজনরা সবকিছুর জন্য দায়ী করছেন গ্রামীণ সমাজের অতিমাত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তরকে। রাজনীতি নগরের। সন্ত্রাস-সহিংসতা নগর সভ্যতার। সুতরাং গ্রামবাংলার প্রার্থনা: ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সে তপোবন পূণ্যাচ্ছায়ারাশি।’


ড. আবদুল লতিফ মাসুম: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন