বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের নানা অনুষঙ্গ

ড. তোফায়েল আহমেদ

পরিবর্তন সময়ের স্বাভাবিকতা, কালের অমোঘ ধর্ম। কিন্তু পরিবর্তনের প্রকার, প্রকৃতি ও ধারাক্রম সময় ও কালের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। পরিবর্তন কালজয়ী, কালনিরপেক্ষ এবং সময় প্রতিকূলও হতে পারে। পরিবর্তন স্বয়ংক্রিয় আবার পরিকল্পিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমেও ঘটানো সম্ভব। পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষিত-অনাকাঙ্ক্ষিত ও ইতিবাচক-নেতিবাচক যেকোনো রকম হতে পারে। ঘটনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ঘটনা ঘটানো হলো। ঘটনা যারা ঘটাল তাদের উদ্দেশ্য সফল হলো। কিন্তু ঘটনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে তারা ভাবিত নয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়া থেমে নেই। সবার অজান্তে কিছু ঘটনা ঘটে গেল বা ঘটানো হলো। যার প্রতিক্রিয়া হলো অনেক পর। প্রতিক্রিয়ার মন্দ পরিণতির শিকার হতে পারে ঘটনার বহু বহু বছর পর, ঘটনা থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানের কিছু নিরীহ-নিরপরাধ প্রাণিকুল ও প্রাণবৈচিত্র্য। যেমন ধরুন, সিএফসি গ্যাস উদগীরণ করে ওজোন স্থর নষ্ট করল এক গোষ্ঠী বা এক দেশ। তার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হওয়া বা বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্ষতি সংগঠিত হলো বিশ্বব্যাপী। ডুবতে বসল বাংলাদেশ, শ্রীলংকা-মালদ্বীপ-ভারতের উপকূলের মানুষ। সেজন্য পরিবর্তনের উদ্দীপক বা নিরোধক উপাদান, কার্য-কারণ সম্পর্ক, পরিবর্তকের চরিত্র, ঘটনার আনুপূর্বিকতা এবং অনুষঙ্গগুলো চিহ্নিত করা গেলে পরিবর্তনের প্রকার, প্রকৃতি ও ধারাক্রম এবং তার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব উপলব্ধি ও নিরূপণ সহজ হয়। এভাবে ‘পরিবর্তন’ বা ‘রূপান্তর’-এর ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর জীব-জড় তথা মানব কল্যাণের উপযোগী পরিবর্তনে সমাজ-সভ্যতা সামনে এগোলো না শেষ বিচারে পেছালো তা নিরূপণ করা যাবে। তাই ভৌত বিজ্ঞানের নানা অভূতপূর্ব আবিষ্কার ও উন্নয়নের কারণে মানুষ কি দিন দিন বেশি সক্ষমতা অর্জন করল, বেশি শক্তিশালী হলো; না কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসহায়, সামর্থ্যহীন ক্রীড়নকে পরিণত হলো তা বুঝতে হলে ‘পরিবর্তন’র বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবিতপূর্ব উদ্ভাবন সমাজে ব্যাপক আর্থিক সমৃদ্ধি এনেছে। সে সমৃদ্ধি সমভাবে সবার কল্যাণে লাগেনি। এ অসম উন্নয়ন সভ্যতাকে নানাভাবে বিভক্ত করছে। সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ গুটিকয় হাতে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। Global wealth Report 2015-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৩৬০ কোটি দরিদ্র মানুষ তথা সারা পৃথিবীর ৫০% মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ, মাত্র ৬২ জন ব্যক্তির করায়ত্তে। অন্য ক্ষেত্রে প্রযুক্তির একাধিপত্যের অন্য চিত্রের জন্য ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ য়ুবাল নোয়া হারারির (Yubal Noah Harari-1. Sepians: A Brief History of Humankind 2. Homo Deus: A Brief History of Tomorrow দেখা যেতে পারে। তাঁর এ বইগুলো পৃথিবীর ৬০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং প্রায় ২৮ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।) গবেষণাগুলো দেখা যেতে পারে। উত্তরাধুনিক বিশ্বে যার হাতে একটি সেলফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার বর্তমান, তার শরীরবৃত্তীয় ও মনোবৃত্তীয় সব তথ্য একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে সংরক্ষিত থাকছে। কেউ ইচ্ছা করলে তার প্রতিটি কাজ, কথা, গতি, স্থিতি, আচরণ, এমনকি ভবিষ্যৎ ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে তাকে একটি অদৃশ্য সুতার টানে পুতুল নাচ নাচাতে পারে। হারারির মন্তব্য, একবিংশ শতকে হিটলার-মুসোলিনীর মতো কোনো একনায়কের হাতে এ প্রযুক্তি পড়ে গেলে তিনি তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ‘আলগারিদম’-এর এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। শুরুতে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে সব ‘পরিবর্তন’ তা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক যা-ই হোক সময় সময় বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তার নির্মোহ অধ্যয়ন প্রয়োজন। নতুবা পরিবর্তন পরিকল্পনা ও ফলাফল কল্যাণকর দিকে ধাবিত হবে না। সমাজের কল্যাণকে নয়, মুনাফাকে ভরকেন্দ্রে রেখে বহু বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার পৃথিবীতে হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র প্রযুক্তির কথাই ধরা যাক। এ প্রযুক্তি থেকে মানবজাতির প্রকৃত প্রাপ্তি কী? প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লব পর্যন্ত সমাজ সভ্যতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে অগ্রগতি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তাকে কোন কুলে নিয়ে যায় এখনো স্পষ্ট নয়। তথ্যপ্রযুক্তির অপ্রতিহত যাত্রা ও ডিজিটাইজেশনের কল্যাণকর ব্যবহার এবং এর অপর পিঠের অকল্যাণকর দিকগুলো উন্মোচিত হওয়ার জন্যও প্রতিনিয়ত গবেষণা প্রয়োজন।

পরিবর্তনের নানা অনুষঙ্গ

আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, জাতীয় এবং স্থানীয় অর্থাৎ বসবাসের ক্ষুদ্র অণু ইউনিট পর্যন্ত, নানাভাবে ‘পরিবর্তন’-এর প্রকার, প্রকৃতি, ধারাক্রম ও প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা করা উচিত এবং এতে নানা অনুষঙ্গের পরিকল্পিত ব্যবহার প্রয়োজন হবে। সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক (Macro-Micro) আর্থসামাজিক নানা তথ্য, রাজনৈতিক ঘটনা-দুর্ঘটনা, উত্থান-পতন, প্রাকৃতিক দৈব-দুর্বিপাক, নানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, ধর্মসহ নানা মতবাদ ও ডক্ট্ররিন, আঞ্চলিক ও বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রভাব এসব বহু বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে আসবে। তথ্যপ্রযুক্তি, বায়োটেকনোলজিসহ সব প্রযুক্তি, নানা মাধ্যমে অবাধ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গত ৩০-৪০ বছরে আমাদের আর্থসামাজিক মানচিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। তবে তার ফলাফল সর্বক্ষেত্রে অবিমিশ্র ইতিবাচক বা নেতিবাচক তা নয়। তাই তার প্রভাব-ফলাফল নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। তাতে ভবিষ্যতে পরিবর্তন সাধনের কার্যক্রম সত্যিকারের একটি দিকদর্শন পেতে পারে। তাহলে অন্ধভাবে প্রভাব-প্রতিক্রিয়া, সুফল-কুফল না ভেবে সবকিছুকে গ্রহণ-বর্জনের মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়া সহজ হতে পারে।

অনুষঙ্গ-১: বাংলাদেশের সামষ্টিক অগ্রগতির পঞ্চাশ বছর

১৯৭০ থেকে ২০২০, বাংলাদেশের এ পঞ্চাশ বছরকে নানা সূচকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়। ১৯৭১-৭২ এ বছরকে বিশ্লেষণের ভিত্তি বছর হিসেবে না নেয়ার কারণ যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থার অস্থিতিশীল সময়ের তথ্য তুলনার জন্য সবসময় নিরাপদ নয়। তাই ১৯৭০-কে ভিত্তি বছর ধরা যায়। এ আলোচনায় সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতির সব তথ্যের সমাবেশ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এখানে হয়তো আমাদের বিশ্লেষণে সব তথ্য নেই। কিন্তু সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে বোঝার জন্য সব তথ্যই প্রয়োজন। বর্তমানে শুধু উদাহরণ হিসেবে নানা জটিল মাপকাঠি ব্যবহার না করে শুধু তিনটি তুলনামূলক তথ্য ব্যবহার করা হলো। যথা জিডিপি, জাতীয় বাজেট ও গড়পড়তা আয়ু। তার সঙ্গে পঞ্চাশ বছরের বাজেটের একটি তুলনামূলক আলোচনা। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শুধু ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ২৭৫ মিলিয়ন ডলার। ঊনপঞ্চাশ বছরে যার বৃদ্ধি প্রায় ৩০ গুণ। ১৯৭০-এ মাথাপিছু আয় ছিল ১৪০ ডলার, যা ২০১৮-২০১৯-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৯০৯ ডলার এবং ২০২০-এ তা ২০৬৪-এ উন্নীত হয়। তাহলে ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলানায় ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪.৭৫ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, যা ২০১৮-২০১৯-এ এসে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকায়। ২০১৯-২০২০-এ তা ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি এবং ২০২০-২০২১ সালের বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে ৭২২ গুণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে উন্নয়ন বাজেটের আকার ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০১৮-২০১৯ সালে হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি, যা ৩৪৫ গুণ বেশি। এখানে একটি অসংগতি যারা সামষ্টিক অর্থনীতির নানা ইন্ডিকেটর দিয়ে উন্নয়ন দেখতে চান, তাদের জন্য প্রশ্ন থাকল, বাজেটের বৃদ্ধি যদি হয় ৭২২ গুণ, ওই বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় কেন ৩৪৫ গুণে আটকে গেল? তার মানে বাজেটের বাকি বিপুল অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হয়েছে। দ্বিতীয় গুচ্ছের প্রশ্ন হবে, বাজেটের এ শত শত গুণ বৃদ্ধির সঙ্গে জিডিপি, আর মাথাপিছু আয়েরই বা সংগতি কতটুকু। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি মাত্র ১৪ গুণ আর জিডিপি ৩০ গুণ। অথচ এ পঞ্চাশ-ঊনপঞ্চাশ বছরে ক্রমপুঞ্জিত সরকারি বাজেট বরাদ্দ দেখা যায় সর্বমোট ৪১ লাখ ২১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এই বিরাট অংকের অর্থ ব্যয়ের পর জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মস্ত ফারাকের অর্থ কি দুর্নীতি, অর্থের অপচয়, পাচার, অপ্রদর্শিত আয়, কালো অর্থের গুহাবাস? আয়-উন্নয়নের সুফলের অসম বণ্টনের ফলেই একদিকে মাথাপিছু আয় নিম্ন পর্যায়ে রেখে হাজার হাজার কোটিপতির জন্ম? কারণ অনুসন্ধান হয়তো যেভাবে বলা হলো তত সহজ-সরল নয়, কিন্তু বিশ্লেষণ করে তো দেখা যায়। পরিবর্তন যা উপরে হলো, তার ফলাফল নিচে চুইয়ে (Trickle down) যা পড়ার কথা, সে তুলনায় বড্ড কম পড়েছে। তাই পরিবর্তনের স্কেল মাপতে হলে বিষযগুলোর সঠিক পরিমাপ প্রয়োজন হবে।

পঞ্চাশ বছরের পরিবর্তনকে তৃণমূলের দর্পণে দেখারও সুযোগ আছে। তাহলে আরো ভিন্ন রকমের সংগতি-অসংগতি ধরা দেবে। পঞ্চাশ বছরের এ সময়কে বিভিন্ন রেজিমভিত্তিক বিশ্লেষণে যেমন দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় ১০ বছরের পাঁচটি গুচ্ছে ভাগ করেও দেখা যায়।

অনুষঙ্গ-২: বাংলাদেশী সমাজের তৃণমূলে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার একটি সহজ পদ্ধতি

বাংলাদেশ সমাজ, জনজীবন ও রাষ্ট্রে পঞ্চাশ বছরের পরিবর্তনের স্থিরচিত্র বিস্ময়কর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, জীবিকা ও জীবনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাব অপরিসীম। ধরা যাক ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ পূর্বকাল ১৯৭০ এবং স্বাধীনতার ঊনপঞ্চাশ বছর পরের ২০২০ সাল, এ দুই সময়ের রাষ্ট্র, সমাজ ও জনজীবনের পাশাপাশি ১০টি চলকের একটি স্থিরচিত্র উপস্থাপন করি, তখন দুটি সময়ের চিত্র গুচ্ছে যে পার্থক্য দেখা যাবে তা হবে পরিবর্তনের অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর এক সম্মুখ যাত্রার উপাখ্যান। বাংলাদেশের ১০টি জেলার ১০টি গ্রামের ১০টি পরিবারের ১৯৭০ এবং ২০২০ এর ১০টি দৃশ্যমান চলক নির্ধারণ করে তার চিত্রগুলো পাশাপাশি স্থাপন করা হলো। একই পরিবারের বর্তমান ষাটোর্ধ্ব বয়সী এক ব্যক্তি তার ১৯৭০ সালের পোশাক-আশাক, সারা দিনের খাদ্য-খাবার, তার বসবাসের ওই সময়কার ঘর-বাড়ির ধরন, ঘরের আসবাবপত্র, নানা নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী, ওই সময়কার স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, হাট-বাজার, চলার রাস্তা-ঘাট এবং সামাজিক চলনশীলতা বা গতিশীলতা এবং ওই একই পরিবারের বর্তমানে ১০ বছর বয়সী একজন শিশুর ১০টি একই চলকের তুলনামূলক স্থিরচিত্র পর্যবেক্ষণ করলে আমরা কী দেখতে পাব? দেখা যাবে পরিবর্তন আকাশ-পাতাল। এ বিষয়ে কোনো পেশাদার গবেষকের গবেষণার প্রয়োজন নেই। যে কোনো একজন সচেতন পাঠক নিজের ও পরিবারের দিকে তাকালেই খুব সহজেই পরিবর্তনের ধরন অনুমান করতে পারবেন। অন্য কেউ বিষয়টি আরেকটি ভিন্ন পদ্ধতিও করতে পারেন। যে কোনো ১০টি পরিবারের সুনির্দিষ্ট কিছু চলক ধরে বিগত পঞ্চাশ বছরের জীবনযাত্রার (১৯৭০-২০২০) ইতিহাসের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। ওই পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক ঊর্ধ্বগতি, স্থিতাবস্থা বা অধোগতি নির্বিশেষে লক্ষণীয় পরিবর্তনের নানা উপাদান তাতে পাওয়া যাবে। কাল অনুসন্ধানে দেখা যাবে বেশির ভাগ পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি রাষ্ট্রীয় নীতি বা পৃষ্ঠপোষকতার সম্পর্ক খুবই কম। বৈদেশিক কর্মসংস্থান, বিশ্ববাজার ব্যবস্থা ও ব্যক্তি খাতের শক্তিশালী অবস্থান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা দুর্বোধ্য বা ব্যাখ্যা করা দুরূহ হয়ে পড়ে।

অনুষঙ্গ-৩: গ্রাম-শহরের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ

বিগত ১০ বছরে আমার নানাভাবে গ্রাম পর্যবেক্ষণের একটি প্রচেষ্টা ছিল এবং সুনির্দিষ্টভাবে চারটি রচনায় নানাভাবে তা আনার চেষ্টা করেছি। ১. নগরায়ণ ও নগর সরকার (আগামী, ২০১৮), ২. Reform Agenda for Local Governance (প্রথমা, ২০১৬), ৩. আমার গ্রাম: রূপান্তরের রেখাচিত্র (প্রথম আলো, ৭/১১/২০১৩) এবং ৪. ক্ষমতা কাঠামো: রূপান্তরের রেখাচিত্র (বণিক বার্তা, ১৬/১২/২০১৬)। এ চারটি পূর্ব কর্ম থেকে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সংক্ষেপে নতুনভাবে অবতারণা করা যায়। নিচে গ্রামের পরিবর্তনের যে পর্যবেক্ষণ তা হচ্ছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার অধীন একটি এলাকা যাকে অন্তত ৫০ বছর ধরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

মোটা দাগে বলা যায়, বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের গ্রাম-শহর দুটোই বদলেছে। গ্রাম-শহর দুটোই বৃহত্তর সমাজেরই অংশ, তাই অদল-বদলে একে অপরের দ্বারা স্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত হয়। তাছাড়া পরিবর্তনের সব প্রভাবক উপাদান এখন আর জাতীয় ভৌগোলিক সীমায় স্থির নয়। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা এখন একটি প্রত্যন্ত গ্রামকেও প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে। ১৯৭০-এর দশকে শহরগুলো ছিল গ্রাম-সমাজেরই সম্প্রসারিত ও অগ্রসর অংশ, তখন নগরকেন্দ্রের বাড়তি গুরুত্ব ছিল মূলত প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কারণে। আরো বাড়তি জৌলুস হিসেবে কোনো শহর ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। কোনো শহর সমুদ্রবন্দর, কোনো শহর নদীবন্দর, কোনো শহর ছিল সুফি-দরবেশের খানকা-সমাধি ইত্যাদি। তার সঙ্গে ধীরে ধীরে বাণিজ্য ও শিল্পের সংযোগ ঘটে এবং আশির পর থেকে শিল্প-বাণিজ্য ছিল দ্রুতবর্ধনশীল। এখন সে শহরগুলোর আকার-আয়তন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার গড়ে উঠেছে নতুন নতুন আরো অনেক শহর। যেমন ঢাকার অদূরেই নারায়ণগঞ্জ বাদেও গড়ে উঠেছে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী প্রভৃতি নতুন পূর্ণাঙ্গ শহর। এখন মহাসড়ক ধরে এক শহরের সঙ্গে আরেক শহর প্রায় লেগে যাচ্ছে। এক শহর থেকে আরেক শহরকে পৃথক করা যাচ্ছে না, পৃথক করা গেলেও দূরত্ব অনেক কমে গেছে। মূল শহর বা এক সময়ের ‘কোর সিটি’ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিত্যক্তের মতো দেখায়, যেমন, পুরনো ঢাকা। এক শহরের ভেতর অনেকগুলো নতুন নগরকেন্দ্র গড়ে উঠছে। নগরগুলো কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ নয়। জনস্রোত, কর্মস্রোতের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক সম্প্রসারণ। ইংরেজিতে নগরবিদদের ভাষায় Urban sprawl,leaffrog urban development and commercial strip development নগর গড়ায় সক্রিয় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সরকারিভাবে ১৯৭০-এ নগর কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৭৮, যা ২০০১-এ এসে দাঁড়ায় ৫৩১। গত ২০ বছরে এ সংখ্যা এখনো আর নবায়িত হয়নি। একসময় বলা হতো পুরো বাংলাদেশটাই একটা বৃহত্তর গ্রাম। এখন বলতে হবে পুরো বাংলাদেশটাই একটি একক শহরে রূপান্তরের প্রক্রিয়াধীন।

গ্রাম বলতে অন্তত ৩০ বছর আগেও যে চিত্র দেখা যেত, গ্রামের এখন সে চিত্র নেই। প্রথমত, পেশা হিসেবে কৃষিকাজ বা সামগ্রিক কৃষি এখন আয় ও পেশার মূলস্রোতে নেই। আয়-উন্নতির প্রধান উৎসও আর ৮০% মানুষের প্রধান অবলম্বন নয়। কমেছে মাথাপিছু জমির পরিমাণ, ছোট হয়েছে কৃষি খামারের আকার এবং বেড়েছে ভূমিহীন খানার সংখ্যা ও হার। ভূমিহীনতা মানে দারিদ্র্য, এ ধারণা এখন অচল। ভূমিহীনতা এখন শেকল ভাঙার প্রথম সোপান। সর্বশেষ জমিখণ্ডটির বাঁধনমুক্ত হয়ে একজন দরিদ্র চাষী (Peasant) বিশ্ব শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এখন সরকারি পরিসংখ্যান মতে, বছরে ১% কৃষি জমি বিলুপ্ত বা প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামে ৭৮% এবং শহরে ৮৯% প্রকৃতি পরিবর্তিত জমিতে বাড়িঘর, ব্যবসা, কারখানা উঠেছে। আমার পর্যবেক্ষণ করা গ্রামের চাষের জমির সরাসরি ৫০% আবাসনের আগ্রাসনের শিকার। বাকি যে জমিগুলো অবশিষ্ট দুঃখজনক হচ্ছে ওই জমিগুলোর বেশির ভাগ এ সময় তিন ফসলা জমি হলেও এখন শুধু আমন চাষ সীমাবদ্ধ। যে আগ্রাসী আবাসন সেখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। চলাচলের ন্যূনতম সড়ক, পানি নিষ্কাশন, পয়োবর্জ্য নিষ্কাশন ইত্যাদির কোনো ভাবনা নেই। ফলে গ্রামে এখন এক নতুন ধরনের ‘বস্তি’ সৃস্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ, কেবল টিভি, মোবাইল ফোন গ্রামে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। কমছে মাথাপিছু জমি, বিলীন এলাকার বন সম্পদ, খাস জমি ও সাধারণ জলাশয়, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত প্রান্তর। ইতিবাচক দিক হচ্ছে, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে আকাশছোঁয়া। পর্যবেক্ষণকৃত গ্রামে স্কুল-মাদ্রাসা সবটাই ধারণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে। এমনকি পূর্বের অতি রক্ষণশীল মাদ্রাসায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে এবং সহশিক্ষাও বিদ্যমান। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যথা মসজিদ, মন্দির, মঠ, আশ্রমের উন্নতি চোখ ধাঁধানো। সর্বত্রই সুদৃশ্য ভবন। অনেক মসজিদের সঙ্গে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। একই রকম বিদ্যালয় রয়েছে মঠ ও আশ্রমের সঙ্গেও। এসব মসজিদ, মাদ্রাসা, মঠ, মন্দির গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত দান-অনুদানে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে পীর সিলসিলাকেন্দ্রিক মতভেদ বেশ তীব্র। নানা পীরের মুরিদের পৃথক মসজিদ দেখা যায়। ঘরে ঘরে বিভক্তি। বিভক্তির আরেক উপাদান রাজনীতি। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, বাজার, গ্রামীণ ক্লাব সর্বত্র ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক নিয়ন্ত্রিত কমিটি। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ সর্বত্র একদলীয় প্রাধান্য। গ্রাম সমাজে বিভিন্ন পীর-মুরিদের ওয়াজ মাহফিল ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা উৎসব-অনুষ্ঠান নেই। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশও সর্বজনীন নয়, নেতাকেন্দ্রিক। সাধারণ উৎসব বা জনসমাবেশ দেখা যায় সাধারণত বিবাহ-বৌভাত, মেজবানি ও জানাজা অনুষ্ঠানে।

সমাজে দৃশ্যমান কোনো নেতৃত্ব কাঠামো বা ক্ষমতা কাঠামো দেখা যায় না। কাঠামো না থাকলেও নেতা ও ক্ষমতা চর্চার মানুষ আছে, ক্ষমতার উত্তাপ আছে। কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার সূত্রে তারা ‘নাজিল’ হন। কিন্তু তারা কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অংশীজন বা অঙ্গীভূত নন। তাদের অধিভুক্ত এলাকায় তাদের কোনো দায় নেই। স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদ খুবই নিষ্প্রভ। এলাকায় জমিসংক্রান্ত বহু বিরোধ। বিরোধগুলো আগের মতো গ্রাম্য সালিশে মীমাংসা হয় না। এক. আচমকা ‘নাজিল’ হওয়া নেতাদের ভয়ে দুর্বল পক্ষ চুপ হয়ে যায়। দুই. পুলিশের থানাতেই মূলত বিচার-সালিশ বসে। পুলিশের তালিকাভুক্ত কিছু সালিশকার এবং জমি মাপজোখের ‘আমিন’ আছে। তারাই থানার কোনো পুলিশ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সালিশ-বিচারে অংশ নিয়ে থাকেন। 

পুলিশ, এসি ল্যান্ড, তহশিল অফিস এবং সাব-রেজিস্ট্রার এ কয়টা অফিসে ঘুষ লেনদেন প্রকাশ্য এবং স্বাভাবিক বলে মানুষ ধরে নিয়েছে। উন্নয়ন কর্ম বলতে যেসব মাটির কাজ, পাকা কাজ ও নগদ সহায়তা এসবের জন্য মেম্বার-চেয়ারম্যানরা পিআইও, এলজিইডি ও ট্যাগ অফিসারকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইউএনওকে ঘুষ দেয়ার কথা বলে। কিছু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার প্রধান জীবিকা বা উপজীবিকা ঘুষ-দুর্নীতির কমিশন এবং সরকারি ঠিকাদারি। এ বিষয়েও রাখঢাক বা গোপনীয়তা নেই। গ্রামের মানুষ কোনোভাবে বিশ্বাস করে না যে, ঘুষ ছাড়া কোনো চাকরি-বাকরি বা সরকারি কাজ হয়। আবার অনেকে ঘুষ দিয়েও প্রতারিত হয়েছে। টাকা গেছে, কিন্তু চাকরি হয়নি বা কাজ পায়নি। বিদ্যুতের মিটার, গ্যাসের লাইন, জমির জমা-খারিজ এ কাজে টাকা দিয়েও অনেকের কাজ হয়নি। আবার টাকা ফেরতও পায়নি। কোনোদিন ফেরত পাওয়ার আশাও করে না। প্রতারিতরাও সহজে মুখ খুলতে চায় না।

আমার পর্যবেক্ষণাধীন গ্রামগুলোতে প্রচুর মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশীয় এমনকি আমেরিকা ও ব্রিটেন প্রবাসী আছে। ফলে বাজার ব্যবস্থা, বিনিয়োগ এবং প্রবাস-পরবর্তী জীবিকার নানা প্রভাব এখানে দেখা যায়। একটি দৃশ্যমান প্রভাব হচ্ছে এলাকায় নবনির্মিত সুদৃশ্য দালান-বাড়ি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও দোকানপাটের সংখ্যা বৃদ্ধি। এ গ্রামের ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক। এ সড়কের দুই কিলোমিটার এ গ্রামের মাঝ বরাবর ওপর দিয়েই গেছে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এ সড়কের দুই পাশে তিনটি চিহ্নিত বাজার ছিল। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যথাক্রমে নন্দির হাট, ইসলামিয়া হাট ও মদন হাট। মদন হাট সপ্তাহে একদিন বুধবার এবং ইসলামিয়া হাটে সপ্তাহে দুইদিন সোম ও শুক্রবার বিকালে কাঁচাবাজার বসত। তিন বাজারেই ১০-১৫টা করে স্থায়ী দোকান ছিল। স্থায়ী দোকানগুলোর মধ্যে মুদি, মনিহারি, বেকারি, চা দোকান, ডিসপেনসারি, নাপিত, ধোপা, কামার, কাঠের আসবাবপত্র, দর্জি ও কাপড়ের দোকানই ছিল প্রধান। গত ১০ বছরে ওই সনাতনী দোকানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, নির্মাণ সামগ্রী তথা রড-সিমেন্ট-ইট-বালুর দোকান, হার্ডওয়্যার, পাইপ ফিটিং, ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ, স্যানিটারি ওয়্যার, টাইলস, ডোর-উইন্ডো, থাই গ্লাস, গ্রিল, ঝালাই ওয়ার্কশপ, কুলিং কর্নার, ফলের দোকান ইত্যাদি। চা দে০াকান বা রেস্টুরেন্ট কমে গেছে। বিবাহসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেল তৈরি, চেয়ার-টেবিল, ক্রোকারিজ ভাড়া দেয়া, বাবুর্চি ইত্যাদির ভালো ব্যবস্থা আছে। একটি বাজারে দুটি ব্যাংক এবং একটি এজেন্ট ব্যাংকিং আছে। তিনটি বাজারে তিনটি কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে, যেখানে দুই থেকে পাঁচ হাজার লোকের আয়োজন সম্ভব। এখন কোনো বিবাহসহ অন্যান্য সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠান আর বাড়ির আঙিনায় হয় না। কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয়।

১০ বছর আগের মতো হাটবারের নির্দিষ্ট দিনে হাট বসে না। প্রতিদিন এবং সারাদিনই হাট বসে। আগের তিনটি বাজার কোনোটিই আর নিজ নিজ পূর্ব বাজার সীমায় আবদ্ধ নেই। মহাসড়ক ধরে দুইপাশে দোকান বেড়েই চলেছে (commercial strip)। এখন দুই কিলোমিটারের পুরো মহাসড়কজুড়েই দোকান আর দোকান। প্রায় সব সম্পন্ন পরিবারগুলোর বাড়িঘর ও ব্যবসা-বাণিজ্য মহাসড়ক বা বড় সড়ককে ঘিরেই যূথবদ্ধ হচ্ছে। পাড়ার ভেতরের গ্রামীণ সড়কগুলোতেও সারিবদ্ধ দোকান। আগে দোকানে বা বাজারে মেয়েদের দেখা যেত না এখন মেয়েরা অবাধে দোকান বা বাজারে আসে। অনেকেরই ঘরে পুরুষ মানুষ নেই। তারা কর্ম উপলক্ষে দেশের বাইরে বা গ্রামের বাইরে। মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি গাড়ি চড়ে, বলতে গেলে হাঁটতেই চায় না। এখন প্যাডেল রিকশা উঠে গেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ও সিএনজিচালিত ত্রিচক্রযানের ছড়াছড়ি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শেয়ার করে সিএনজি চড়ে। এ অবস্থা শুধু পর্যবেক্ষণাধীন গ্রামে নয়। পুরো হাটহাজারী উপজেলাব্যাপী। বাইরের দুনিয়ার কাছে হাটহাজারী দেশের অন্যতম একটি রক্ষণশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু নারীর গতিশীলতার ক্ষেত্রে সংগঠিত গত ১৫-২০ বছরের সামাজিক পরিবর্তন বিস্ময়কর। বিস্ময়কর এ কারণে যে, ১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত নারীরা বোরখা আবৃতা থাকত শুধু নয়, বোরখা পরেও রিকশা যাত্রার সময় রিকশার চারদিকে কাপড় বাঁধা থাকত। হেঁটে যাওয়ার সময় বোরখা এবং আবার নিজেকে আরো আড়াল করার জন্য বোরখার সঙ্গে ছাতা ব্যবহার হতো। এখন তাদের পরবর্তী প্রজম্ম শেয়ারে সিএনজি অটোরিকশায় ভ্রমণ করে। 

এ গ্রামগুলোতে সরকারি বিনিয়োগ বা ব্যয় দেখার চেষ্টা করে দেখলাম দৃশ্যমানভাবে চারটি জায়গায় সরকারের সরাসরি ব্যয় বা বিনিয়োগ নিয়মিত। ক. গ্রামীণ সড়ক, খ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গ. একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ঘ. সেফটি নেট কার্যক্রম। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির দালান থাকলেও সেবা সম্পর্কে কেউ ইতিবাচক কোনো কথা বলেনি। নিরাপদ পানীয়জল সরবরাহের ক্ষেত্রে দেখা যায় সরকারের সরবরাহ করা চাপকলে এ এলাকায় পানি আসে না। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ডিপসেট বা মোটরচালিত নলকূপ ব্যবহার করে। অনেকে প্রতিবেশী সম্পন্ন পরিবারের টিউবওয়েলের পানি পায়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই পুকুরে গোসল করে। যেসব গরিব বাড়িতে পুকুর নেই, তারা অন্যের পুকুরে গোসল করে।

বিভ্রান্ত করার মতো একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম, যা উন্নয়ন চিন্তা বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’—এ স্লোগানটি এখানে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত যাদের ১৯৬০/৭০/৮০-এর দশক থেকে ছেলে-মেয়ে সীমিত ছিল, তারা জীবন যুদ্ধে বড় ধরনের পরাজয় বরণ করেছে। অধিক সন্তানের জনক-জননীরা সমৃদ্ধি ও ক্ষমতার যুদ্ধে জয়ী হযেছে। ৪০টি পরিবার গুচ্ছের একটি পাড়ায় দেখা যায়, ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকের এক-দুই সন্তানে সীমাবদ্ধ পরিবারগুলো তাদের প্রতিবেশী চার-পাঁচ সন্তানের পরিবারগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থা বা অবস্থানে নেই। এ রকম সাত-আটটি পরিবারের মধ্যে দুটি পরিবারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটেছে। যে ছয়টি পরিবার টিকে আছে তারা তাদের প্রতিবেশী অধিক সন্তানবিশিষ্ট পরিবারের চেয়ে আর্থিক ও মোট সম্পদ আহরণের মাপকাঠিতে অনেক গুণ পিছিয়ে আছে। অধিক সন্তানের পরিবারগুলো শিক্ষাসূচকে অনেকে পিছে থাকলেও দেশী ও বিদেশী শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের কারণে তাদের পরিবারের অর্থকরী ও বস্তুগত সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সব ভাই-বোনের মিলিত সামাজিক পুঁজি তাদের সমাজের ক্ষমতা কেন্দ্রেরও কাছাকাছি নিয়ে গেছে। শ্রমঘন সমাজে শ্রমশক্তির পুঞ্জীভূত শক্তিকে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৭০-১৯৮০-এর দশকের অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের শ্রমশক্তির বহুমুখী ব্যবহারের কারণে অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী কম সন্তানের পিতা-মাতাকে অতিক্রম করে গেছে। অপরদিকে সভ্য-সংস্কৃত মধ্যবিত্ত পরিবারের চেয়ে একই আর্থিক ভিত্তির দুর্বিনীত ও সহিংস পরিবারগুলো যাদের সঙ্গে রাজনীতির যোগ হয়েছে, তারা তাদের আর্থিক সমৃদ্ধিকে অনেক গুণ বাড়াতে পেরেছে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তি এসব গ্রামে আছেন সত্যিকার অর্থে ছেলে সন্তানরা তাদের বৃদ্ধ বয়সের নিশ্চিত পেনশন। ছেলে সন্তানহীন পরিবারগুলোর মধ্যে বড় ধরনের হতাশা বিদ্যমান। এ রকম চারটি পরিবার ৩০-৪০ বছরের ব্যবধানে মোটামুটি বিলুপ্ত হয়েছে। শুধু শিক্ষা ও অর্থ সম্পদ গ্রামে যথেষ্ট নয়। জনবল ও পেশিশক্তি যুক্ত হলে সোনায় সোহাগা। এ দুই শক্তির সংযোগ না হলে বিত্ত আহরণ, তার সুফল ভোগ এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ দুরূহ।

স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিয়য়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর এ এলাকার মানুষ কোনোভাবে আস্থাশীল নয়। জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তরা প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার ও বেসরকারি ক্লিনিক এবং অপেক্ষাকৃত গরিব মানুষ হাতুড়ে বিদ্যার চিকিৎসা গ্রহণ করে। বিগত ৫০ বছরে এ এলাকার প্রচুর নানা প্রফেশনাল ডাক্তার, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, আমলা ইত্যাদির জন্ম হয়েছে, তারা কেউ গ্রামে থাকেন না। কালেভদ্রে এলেও অবস্থান করেন না। অনেকে পরিবারের বাইরে কাউকে চেনেনও না।

পরিবর্তনবিষয়ক এ লেখার প্রধান উপসংহার হচ্ছে, এ লেখার কোনো উপসংহার নেই। পরিবর্তন জীবনের অংশ। পরিবর্তনের দুরন্ত স্রোতে শুধু নিরন্তর ছুটে যাওয়া নয়। পরিবর্তনের মাইলস্টোন বোঝার জন্য মাঝে মাঝে পেছন ফিরে এক-দুইবার তাকানো ভালো। বাংলাদেশের কোনো শহর-গ্রামই এখন পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সবজি বিক্রেতা, ছোট দোকানদার, একজন অফিস পিয়নও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খোঁজখবর নিচ্ছে। ফ্রান্সের শার্লি আবদুর ঘটনায় বিচলিত বোধ করছে। আমাদের চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার প্রাদুর্ভাব কেন বেশি তা-ও তাদের ভাবাচ্ছে। নানা জাতীয় বিষয় নিয়ে ভাবছে না, তা নয়। তবে বেশির ভাগ সময় সঠিক তথ্য তারা পায় না। তাই দেখা যায়, সবই বলতে গেলে গুজবের জন্য এক ধরনের মুখিয়েই থাকে।


ড. তোফায়েল আহমেদ : রাজনীতি ও লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক। রাজনীতি, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নবিষয়ক গবেষক ও লেখক। তিনি বর্তমানে ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুমিল্লা) উপাচার্য

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন