এক উচ্চাভিলাসী দুর্দম উদ্যোক্তার প্রয়াণ

বণিক বার্তা অনলাইন

মারা গেছেন স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের চেয়ারম্যান লি কুন হি। দক্ষিণ কোরিয়ার বহুজাতিক কোম্পানি স্যামসাংকে প্রভাবশালী বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার কারিগর তিনি। আজ রোববার ৭৮ বছর বয়সে লি মারা যান। 

চেয়ারম্যান লি ছিলেন সত্যিকারের দূরদর্শী, যিনি স্থানীয় ব্যবসায় থেকে স্যামসাংকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উদ্ভাবক এবং শক্তিশালী শিল্প খাতে রূপান্তরিত করেছিলেন।

লি কুন-হি স্যামসাংয়ের হাল ধরেন ১৯৮৭ সালে। স্যামসাংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লি বাইউং-চুলের মৃত্যুর পর লির হাতে এসেই কোম্পানি নতুন জীবন পায়। তার আগে পর্যন্ত পশ্চিমের বাজারে সস্তা টেলিভিশন আর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল স্যামসাং। লির নেতৃত্বেই স্যামসাং বিশ্বের বৃহত্তম স্মার্টফোন ও মেমোরি চিপ নির্মাতা হিসেবে উঠে এসেছে।

লির নেতৃত্বেই  স্যামসাং গ্রুপের বাজারমূল্য ৩৪৮ গুণ বেড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার বৃহত্তম কনগ্লুমারেটে পরিণত হয়। 

এই গ্রুপের প্রধান ব্যবসা ইলেকট্রনিক চিপ হলেও এর রয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্সসহ কনজিউমার ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসা স্যামিসায় ইলেকট্রনিক্স, নির্মাণ ব্যবসা স্যামসায় সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনসহআরো বেশ কয়েকটি। 

লির নেতৃত্বে ২০১৪ সালেই কোম্পানির বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৩১৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন উন (২৮২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার)। যেখানে ১৯৮৭ সালে যখন তিনি বাবার মৃত্যুর পর দায়িত্বভার কাঁধে নেন তখন বাজারমূল্য ছিল ২৮২ দশমিক ৪ বিলিয়ন উন। এফএনগাইডের হিসাব এটি।

সে হিসাবে স্যামসাং গ্রুপের বিক্রি ৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন উন থেকে  ৩৪ গুণ বেড়ে হয় ৩৩৮ দমমিক ৬ ট্রিলিয়ন উন।

এতে কোম্পানির সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ৫৭৫ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন উন। দায়িত্ব নেয়ার সময় এর পরিমান ছিল ৮ ট্রিলিয়ন উন। পাশাপাশি কোম্পানির জনবল প্রায় এক লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজারে।

কোম্পানির রফতানিও বাড়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। ১৯৮৭ সালে স্যামসাং গ্রুপ রফতানি করতো ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। সেটি ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্য সরবরাহের মোট ২৮ দশমিক ২ শতাংশ।

বাবা লি বাইউং-চুলের মৃত্যুর পর যখন ১৯৮৭ সালে স্যামসাংয়ের দায়িত্ব নেন লি, তখন এশীয় এই কোম্পানির নাম পশ্চিমে খুব একটা পরিচিত ছিল না। বড়জোর তারা ভাবতো এটি একটি টেলিভিশন ও মাইক্রোওয়েভ ওভেন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, যেসব পণ্য সস্তা বা ডিসকাউন্ট শপগুলোতে পাওয়া যায়। ৪৫ বছর বয়সে কোম্পানির হাল ধরেন লি। ২০১৩ সালেই স্যামসাংকে বিশে^র অষ্টম শীর্ষ কোম্পানিতে পরিণত করেন তিনি।

লির বাবা বাইউং-চুল লি স্যামসাং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৩৮ সালে। এ কোম্পানি তখন কোরিয়ান শুঁটকি মাছ, সবজি এবং ফল চীনে রফতানি করতো। ১৯৬৯ সালের আগে অর্থাৎ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ৩১ বছর পর্যন্ত স্যামসাং কোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিক্রি শুরু করেনি। এবং ১৯৯০-এর দশকের আগে পর্যন্ত কুন-হি লি সস্তা পণ্যের কোম্পানি বলে যে অমর্যাদা ছিল স্যামসাংয়ে তা ঘুচিয়ে হাইএন্ড পণ্য নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ১৯৯৩ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটে কোম্পানির নির্বাহীর নিয়ে এক সভায় তিনি কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, স্ত্রী আর সন্তান বাদে আমাদের আর বাকি সবকিছু পাল্টে ফেলতে হবে!

এই ঘোষণাতেই থেমে থাকেননি লি। ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে কু-হি লি আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করেন যে, তাদের উপহার হিসেবে দেয়া ফোনটি ঠিকঠাক কাজ করছে না। ক্ষোভ গজরা গজরাতে তিনি গুমিতে স্যামসাংয়ের অ্যাসেম্বলি প্লান্টে গিয়ে হাজির হোন। দেড় লাখ ফোন সেট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেন। এরপর সেগুলো জ¦ালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে নতুন অভিযানে মনোযোগ দেন। এবারই প্রথমবারের মতো স্যামসাং উচ্চমানের পণ্য তৈরিতে পূর্ণ মনোযোগ দেয়। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের জগতে দ্রুতই নাম করতে শুরু করে স্যামসাং।

আজ স্যামসাং বিশে^র অন্যতম বৃহৎ স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। প্রায় এক দশ ধরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল স্যামসাং। গত বছর চীনা কোম্পানি হুযাওয়ে স্যামসাংকে ছাড়িয়ে যায়। তবে সিনো-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধের জেরে হুয়াওয়ে আবার পিছিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। 

লির জন্ম ১৯৪২ সালের ৯ জুন, তৎকালীন জাপান অধিকৃত কোরিয়ায়। ১৯৬৫ সালে টোকিওর ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি থেকে ¯œাতক হোন তিনি। এরপর জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করতে যান। তবে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন তিনি।

১৯৬৬ সালে তিনি তঙ্গিয়াং ব্রডকাস্টিং কোম্পানিতে চাকরি নেন। এটি স্যামসাং গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান। পরে স্যামসাংয়ের নির্মাণ ও আমদানি রফতানি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশনে কাজ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি স্যামসাং গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান।

লি স্যামসাং গ্রুপে চেয়ারম্যানি হসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। আর ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন চেয়ারম্যান অ্যান্ড সিইও। ২০১০ সালে ফের স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু সে পদেই ছিলেন।

২০১১ সালের আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সাধারণ সভায় ২০১৮ সালের শীতকালীন অলিম্পিক গেম আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হওয়ার প্রতিযোগিতায় জিতে যায় দক্ষিণ কোরিয়া। এর পেছনে লির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে বলে জানা যায়।

লি’র নীতি কৌশলের কল্যাণেই স্যামসাং বিশে^র অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্টানে পরিণত হয়। স্যামসাং হয়ে ওঠে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী কোম্পানি ও আর দেশের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হোন লি।

তবে কর ফাঁকি, সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষহ নানা অনিয়মের জন্যও বারবার আলোচনায় এসেছে স্যামাসং ও লি। এ ধরনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও দুইবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমা পেয়েছেন লি, প্রথমবার ১৯৯৬ সালে, এবং ফের ২০০৮ সালে।

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ বেগ পোহাচ্ছে বিশে^র অন্যতম বৃহৎ এ এশীয় কোম্পানি। ২০১৪ সাল থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে তার। বারবার তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। ফলে কোম্পানি তার বিচক্ষণ নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়। উত্তরাধিকারী হিসেবে ছেলে জে ওয়াই লি দায়িত্বভার বুঝে নেয়ার আগেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিয়মের বিতর্কে জড়িয়ে যান। ২০১৭ সালে তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। ঘুষসহ বেশ কয়েকটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হোন তিনি। ওই সময় কোম্পানির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেই বসেন, স্যামসাং এখন মাঝিবিহীন নৌকার মতো। অবশ্য পরের বছরই জে ওয়াই লির কারাদ- স্থগিত করা হয়।

এই ধাক্কা সামলে ওঠার আগে হানা দিল মহামারী। ৫জি প্রযুক্তি এবং ফোল্ডেবল ফোনের আগমনসহ বেশ কিছু উদ্ভাবনের কারণে ২০২০ সালকে সেলফোন ইন্ডাস্ট্রির জন্য বেশ সম্ভাবনাময় বলে ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বছরজুড়ে কভিড-১৯ মহামারী সে আশায় গুঁড়েবালি।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং মহামারীর কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা কোম্পানিগুলোকে বৃহৎ আকারে ডিভাইস নির্মাণে নিরুৎসাহিত করবে। ফোনের বাজারে এখনো ক্রেতারা সেভাবে ফিরেনি। ফলে অনিশ্চয়তা সহজে ঘুচবে বলে আশা করা যাচ্ছে না।

স্যামসাংই প্রথম বাজারে আনে ফাইভজি স্মার্টফোন। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকলেও বাজারে তাদের ছাড়িয়ে যায় হুয়াওয়ে। বিশ্লেষকরা আশা করছেন, চলতি বছর ফাইভজি ফোনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হবে অ্যাপল। ফলে নতুন ধরনের মোবাইল ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তিতে স্যামসাং তৃতীয় স্থানে নেমে যেতে পারে। স্যামসাংয়ে রাজস্বের অনেকখানি নির্ভর করে এটির ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ব্যবসার ওপর। অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসা যখন ধুঁকছে তখন রাজস্বে কম্পোনেন্ট ব্যবসা বিভাগরে ওপরই ভরসা করছে স্যামসাং।

চলতি মাসের শুরুর দিকে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তৃতীয় প্রান্তিকে তারা ৫৮ শতাংশ মুনাফা বৃদ্ধির আশা করছে। কারণ গত কয়েক মাসে ডাটা সেন্টারে ব্যবহার হয় এমন মেমোরি চিপের ব্যবসায় দারুণ উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে।

ইয়নহাপ নিউজ এজেন্সি, নিউইয়র্ক টাইমস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন