গণপরিসর উন্নয়নে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা জরুরি

ড. আকতার মাহমুদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক। পড়াশোনা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা’ ডিসিপ্লিনে। পরবর্তী সময়ে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২০০০ সালে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ২০০৪ সালে সুইডেনের রয়েল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে আরবান প্ল্যানিংয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি পরিকল্পনাবিদদের পেশাজীবী সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে গণপরিসর, অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর উন্নয়ন, নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস

একজন নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে শহরের কোন দিকগুলো আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?

মানুষ যখন কোনো শহরে যায়, সে তখন শহরের ভবন, পরিবহন ব্যবস্থা কিংবা অবকাঠামো দেখে। আমার কাছে যেকোনো শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় মনে হয় মানুষ। আমি মানুষ দেখি। মানুষের চলাফেরা, ‘লাইফ বিটুইন বিল্ডিংস’ দালানকোঠার মাঝে মানুষের জীবন আর শহরের গণপরিসরগুলোকে দেখি। আমি মনে করি, যেকোনো শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে গণপরিসর। শহরটি কীভাবে এর গণপরিসরগুলো সাজিয়ে রাখে বা রক্ষণাবেক্ষণ করে যেকোনো শহরের সার্থকতা আসলে এ জায়গায়। কোনো শহরে দুজন ভাইবোন হাত ধরাধরি করে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাচ্ছে, আমার মনে হয় এটা একটি শহরের সুখের ছবি। আর এ ছবিটা তৈরি করতে শহরকে অনেক বেশি অবদান রাখতে হয়। শহরের অবকাঠামো, নিরাপত্তা সবকিছু মিলে এমন দৃশ্য তৈরি হয়। সুতরাং আমার কাছে শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মানুষ ও গণপরিসর। 


আপনি যে গণপরিসরের কথা বললেন, গণপরিসর বলতে কি শুধু পার্ক বা উন্মুক্ত স্থানকে বুঝব। গণপরিসরের সংজ্ঞা নিশ্চয়ই এ দুটো শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নগর পরিকল্পনাবিদরা গণপরিসর বলতে আসলে কী বোঝান?

গণপরিসরের সংজ্ঞা বা ব্যাপ্তিটা আরো বেশি। মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির বাইরে যা কিছু আছে সবকিছুই মোটাদাগে আমরা গণপরিসর বলতে পারি। ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরে সরকারি মালিকানাধীন পরিসর যা, কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি নয়, যেখানে যেকোনো বয়স, বর্ণ ও অর্থনৈতিক অবস্থার মানুষ বাধাহীনভাবে সহজে যেতে পারে, ব্যবহার করতে পারে এবং উপভোগ করতে পারে, এমন স্থানকে আমরা গণপরিসর বলি। এর মধ্যে উদ্যান বা পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ যেমন আছে তেমনি রয়েছে নদীর ধার, লেক, জলাশয়, সবুজ বনায়ন ও রাস্তাঘাট। রাস্তা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসর। রাস্তার দুইপাশে যে ফুটপাতগুলো রয়েছে, তা নগরজীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত গণপরিসর। এছাড়া স্টেডিয়াম, কমিউনিটি স্পেস, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, কমিউনিটি লাইব্রেরি, নদীর ধার, খোলা প্রান্তরকে আমরা গণপরিসরের অংশ হিসেবে ধরি। সফল শহরের সার্থকতা নির্ভর করে এর গণপরিসর কতটা উন্মুক্ত, কতটা সুন্দর করে ব্যবহার করা হয় এবং শহর কর্তৃপক্ষ কতটা সুন্দরভাবে তা গুছিয়ে রাখতে পারে তার ওপর। নগরজীবনে গণপরিসরকে এমনভাবে বিন্যাস করা উচিত, যাতে মানুষে মানুষে অর্থপূর্ণভাবে দেখা করা, কথা বলা এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সোস্যাল কোহেশান বা সামাজিক সংযুক্তি তৈরি হয়। নগর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সোস্যাল কোহেশান জরুরি বিষয়।  


গণপরিসর উন্নয়ন ও সংরক্ষণে আমরা কতটা সফল হলাম। গণপরিসর প্রতিষ্ঠায় সোস্যাল জাস্টিস কি রক্ষা হচ্ছে? না হলে সমস্যা বা বাধাগুলো কোথায়? 

এ প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে ঢাকা শহরের গণপরিসরের অবস্থাটা আসলে কী বা শহরের অধিবাসী হিসেবে এর ফুটপাতগুলোকে আমরা কতটা ব্যবহার করতে পারি, তা নিয়ে বলতে চাই। প্রতিটা মানুষের জন্য নয় বর্গমিটার করে গণপরিসর থাকা প্রয়োজন, এটা একটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। সেই হিসাবে এ শহরে যত মানুষ বসবাস করে, তাদের জন্য যে পরিমাণ গণপরিসর দরকার তার তুলনায় ৯০ শতাংশের মাত্র এক ভাগ গণপরিসর রয়েছে। অতিসম্প্রতি আমরা দেখলাম বেশকিছু পার্ক ও খেলার মাঠের উন্নয়ন করা হয়েছে। কিছু খেলার মাঠ মাল্টিপারপাস অ্যাপ্রোচে ডিজাইন করা হলো, শহরের অবস্থা বিচারে সেটা হয়তো ঠিকই আছে। কিন্তু সেগুলো এমন সব উপকরণ দিয়ে সাজানো হলো যে এলাকার ছেলেমেয়েরা আগে যেভাবে এসে মাঠে খেলাধুলা করতে পারত, নতুন উপকরণে সাজানোর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। তারা কিন্তু এ জায়গাগুলোয় ঠিক আগের মতো স্বচ্ছন্দে যেতে পারছে না। ডিজাইনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বিভক্তি আরো প্রকট হয়েছে। এ ধরনের কাজগুলো যখন করা হয়, সেখানে গণসম্পৃক্ততার প্রয়োজন রয়েছে। কীভাবে এটাকে উন্নয়ন করলে গণসম্পৃক্ত হবে, সব মানুষ এটাকে ব্যবহার করতে পারবে, সে চাহিদাটুকুকে গুরুত্ব দিয়ে যদি নকশা করা হয় তখন এগুলো অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। সরকারের সব দপ্তর, প্রতিষ্ঠান টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। সেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এটা করতে হলে সব মানুষের চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে উন্নয়ন করতে হবে। আমরা দেখেছি কিছু মাঠ হয়তো কোনো সংগঠনের কাছে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে সংগঠনের লোকেরা ছাড়া এলাকার বাকি মানুষ হয়তো এটি আর ব্যবহার করার সুযোগ পায় না। তাই খেয়াল রাখতে হবে মাঠগুলো সংগঠন বা ব্যক্তিমালিকানায় যেন চলে না যায় এবং মাঠ ও পার্কগুলোকে যখন তৈরি করা হবে সেখানে যেন দেয়াল তুলে দেয়া না হয়। আমাদের গণপরিসরের পরিমাণ কম। তাই শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক ও সব ধরনের মানুষ যেন এগুলো ব্যবহার করতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। 


অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর উন্নয়নের শর্তগুলো কী? আমরা দেখছি পাড়া বা মহল্লায় প্লটের পর প্লট, বিল্ডিং করা হচ্ছে। শিশুদের খেলার বা বয়স্কদের হাঁটার জায়গা খোলা পরিসর রাখার বিষয়টি আমলে নেয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কী করণীয়? 

কিছুদিন আগে আমরা পার্কের ওপর একটি জরিপ করেছিলাম। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। অনেক নারী বলেছেন, এখানে তো সবাই ক্রিকেট খেলে, আমরা যেতে পারি না। বয়স্করা বলেছেন, আমি এখানে গিয়ে কিছু করতে পারি না। আমার হাঁটার জায়গা নেই। তার মানে প্রত্যেকটা বয়সের আলাদা আলাদা চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদাগুলোকে আমলে রেখে নকশা করতে হবে। যেখানে সব বয়সের জন্য কিছু উপাদান, যেমন হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে, বসার ব্যবস্থা ও ছোটদের খেলার জায়গা রাখতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন আয়ের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে, ব্যবহারের উপযোগী করা গেলে, তাকে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা বলব। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কেউ যেন বাদ না পড়ে, তা খেয়াল রাখতে হবে। পাড়া মহল্লাগুলোয় এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ৬ থেকে ৭ মিনিট হাঁটার মধ্যে একটা খেলার জায়গা পেয়ে যায়। এটাকে প্লেয়িং লট বলে। এজন্য অনেক বড় জায়গা প্রয়োজন হয় না। চার-পাঁচ কাঠার মতো জায়গা হলেই হয়। এবার যদি কমিউনিটি স্পেস বা নেবারহুড মাঠের কথা বলি, তবে এজন্য একটু বড় অর্থাৎ ১৫ থেকে ২৫ একর জায়গার দরকার হবে। প্রতিটা পাড়া বা মহল্লার মধ্যে প্লেয়িং লট, মিনি পার্ক, নেবারহুড পার্ক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের গণপরিসর থাকতে পারে। 


এ উদ্যোগগুলো কি সিটি করপোরেশন নিতে পারে?  

হ্যাঁ, সিটি করপোরেশন থেকেই উদ্যোগগুলো নিতে হবে। স্থানীয় সরকার বিষয়ে আমাদের যে আইনটি আছে সেখানে উদ্যান, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি তৈরির জন্য বিশেষভাবে সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই অংশটির কাজই হচ্ছে বিনোদনের জন্য এ ধরনের গণপরিসরের ব্যবস্থা করা। আমাদের উদ্যান, খেলার মাঠের পরিমাণ কম, তবে উদ্যোগ নিলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি তার মেয়াদে প্রতিটা পাড়া-মহল্লায় একটা করে পার্ক, খেলার মাঠ তৈরি করতে পারেন, তবে ঢাকা শহরে প্রতি পাঁচ বছরে নতুন করে ১২৯টি নতুন গণপরিসর সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, খুব দ্রুতই এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে জায়গা কিনে হলেও তৈরি করা উচিত।

  

গণপরিসরগুলোয় নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ। নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় আসছে না কেন? পরিকল্পনার জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ কম বলে কি এমনটা হচ্ছে? 

মাঠ, পার্ক, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বিনোদনের স্থান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গণপরিসর নির্মাণ পরিকল্পনায় নারীদের অংশগ্রহণ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যখন নগর উন্নয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের বেশি বেশি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে তখন নারীদের চাহিদার বিষয়গুলো মাথায় রেখে তারা কাজগুলো করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যদি প্রশ্ন করা হয়, যারা কাজ করে তারা কি নারীবান্ধব নগর তৈরির পক্ষে নয়? আমি বলব, তারাও পক্ষে। কিন্তু নারীদের চাহিদাগুলো অনেক সময় একজন পুরুষ হয়তো সেভাবে উপলব্ধি না-ও করতে পারে। উত্তর-আধুনিক এ সময়ে নগর পরিকল্পনায় চাইল্ড সেনসেটিভ প্ল্যানিং, জেন্ডার সেনসেটিভ প্ল্যানিংয়ের বিষয়গুলো কিন্তু আলোচিত। তাই পরিকল্পনা ও নকশা করার সময় খুব সযত্নে এ বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণ ও নকশায় যেমন নারীদের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন, তেমনি যখন এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয় তখন এলাকার মানুষের অংশগ্রহণও জরুরি। এলাকার যেসব নারী গণপরিসরগুলো ব্যবহার করেন, তারাও যেন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই তাদের চাহিদাটুকু সেখানে প্রতিফলিত হবে। 


রাস্তা, ফুটপাত, মার্কেট, প্লাজাসহ অন্যান্য স্থান কীভাবে ব্যবহার করলে ঢাকা শহরে ব্যাপক অর্থে উন্মুক্ত স্থান ও গণপরিসর সৃষ্টি করা সম্ভব হবে?

ফুটপাতটা খুবই ব্যবহূত একটা গণপরিসর। তাই এগুলো প্রশস্ত ও নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন। ফুটপাত যদি ব্যবহারের উপযোগী হয়, কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, সেক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সবাই তা ব্যবহার করবেন। আমাদের ফুটপাতগুলোয় নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের উপস্থিতি কম দেখি। এর অর্থ এটা নয় যে তাদের সংখ্যা কম। আসলে ফুটপাতগুলো তাদের ব্যবহার উপযোগী নয় বলে তাদের উপস্থিতিটা কম দেখা যায়। রাস্তা, ফুটপাত মার্কেট, প্লাজাগুলো যখন তাদের ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে আমরা তৈরি করতে পারব তখন তাদের উপস্থিতিটা তত বেশি পাব। গণপরিসরের অসুবিধার কথা ভেবে অনেক নারীই এখন বের হতে চান না। শহরকে যদি ব্যবহার উপযোগী করতে হয় তাহলে অবশ্যই গণপরিসরগুলোকে সবার ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। 

অন্যান্য দেশে উন্মুক্ত স্থানের পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কী করা হয়? তারা কাজগুলো কীভাবে করে?

প্রথমত, পরিকল্পনা করা। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়ন করা। তৃতীয়ত, রক্ষণাবেক্ষণ করা। আমাদের সব জায়গাতেই ঘাটতি আছে। আমরা দেখি একটা প্রকল্পভিত্তিক কাজ হয় এবং পরবর্তী সময়ে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো তহবিল থাকে না। নগরের গণপরিসরগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ‘অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেইন্যান্স’ বাজেট থাকা জরুরি। বিদেশেও স্থানীয় সরকারেরই দায়িত্ব এ কাজগুলো করা। সেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলে তেমন কিছু নেই। সব কাজই স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) করে। এর বাইরে কোথাও কোথাও বড় শহরগুলোয় পার্ক-ওপেন স্পেস উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকে। তাদের কাজই হচ্ছে গণপরিসরগুলোকে নাগরিকবান্ধব হিসেবে তৈরি করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বটা স্থানীয় সরকারের থাকে। আমাদের এখানে যেহেতু সিটি করপোরেশন আছে তাই তারাই এটা করতে পারে, তবে এখানে জনসম্পৃক্ততা খুবই প্রয়োজন। গণপরিসরগুলোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্থানীয়দের অংশীদার করা প্রয়োজন। যখনই তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হবে তখনই তাদের মধ্যে একাত্মতার অনুভূতি তৈরি হবে। তারা মনে করবে এটা আমাদের সম্পত্তি। এটাকে আমরা যত যত্ন করে রাখতে পারব তত বেশি আমরা এটাকে সুন্দর করে ব্যবহার করতে পারব। পার্ক বা উন্মুক্ত জায়গার প্রতি তখন তার একটা মায়া জন্মাবে। একটা কর্তৃত্ব তৈরি হবে। গণপরিসর ঘিরে একাত্মতার অনুভূতি যদি না থাকে, তবে লোকেরা তা নিজের মনে করে না। তারা মনে করে এটা সরকারি সম্পত্তি, সরকারই এটাকে দেখাশোনা করবে। 


ঢাকার চারটা নদী, প্রাকৃতিক খালসহ জলাধারগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে কীভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়?  

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা—চারটি নদীর একটা পাশের পরিধি প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মতো। তাহলে দুই পাশ মিলে হয় ১০০ কিলোমিটার। আমরা তো এখন ব্লু- নেটওয়ার্ক, গ্রিন নেটওয়ার্কের কথা বলি; এই নদীর ধারগুলো বাঁধাই করে যদি সেখানে সবুজ বেষ্টনী বা সবুজ পরিসর তৈরি করা যায়, তাহলে টানা ৫০ কিলোমিটার নতুন সবুজ পাওয়া যাবে। সেখানে মানুষেরা বসার জন্য জায়গা পাবে। এতে শহরে যে গণপরিসরের অভাবের কথা আমরা বলি সেক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি পূরণ হবে। শুধু নদী কেন অসংখ্য খাল আছে। কেউ বলে, ৪২ বা ৪৬টি। আমার গবেষণায় দেখেছি এ শহরে প্রায় ৫২টি খাল আছে। এ খালগুলোকে যদি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা যায় তাহলেও গণপরিসর সৃষ্টি করা যাবে। আমরা বলছি উন্মুক্ত স্থান নেই, গণপরিসর নেই, সে জায়গাটায় একটা বিরাট পরিবর্তন হতে পারে যদি আমরা নদীগুলোকে সবুজ বেষ্টনী দিতে পারি, সংরক্ষণ করতে পারি এবং গণপরিসর সৃষ্টি করতে পারি। এবার আসি জলাধারের কথায়। ঢাকায় অনেক লেকও আছে। যেমন হাতিরঝিল তৈরি করা হলো। ঢাকা শহরের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের মধ্যে এ রকম আরো পাঁচটি জলাধারের প্রস্তাবনা দেয়া আছে, যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ একর জমি বরাদ্দ করা আছে। আমার পরামর্শ থাকবে এ জলাধারগুলোকে এখনই সংরক্ষণ করা, প্রয়োজনে সেগুলোকে অধিগ্রহণ করা এবং সংরক্ষণ করা। তাহলে কয়েকটি কাজ হবে। গণপরিসর বাড়বে, জলাধার সংরক্ষণ হবে এবং প্রত্যেক বছর বর্ষাকালে আমরা যে জলাবদ্ধতার সমস্যার সম্মুখীন হই, তা থেকে একটি স্থায়ী পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। জলাধারগুলো খালের সঙ্গে সংযুক্ত হলে খুব দ্রুত শহরের পানি সেখানে চলে যেতে পারবে। বালু নদের পাশ দিয়ে হয়তো তিনটি ও তুরাগের পাশে দুটি জলাধারের প্রস্তাব দেয়া আছে। এ জলাধারগুলোকে এখনই অধিগ্রহণ করে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করা প্রয়োজন। 

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে উড়াল সড়ক ভেঙে গণপরিসর তৈরির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো স্থাপনা আছে কিনা, যেটা নিয়ে নতুন করে ভাবা যায়?

সাধারণত গণপরিসরের গুরুত্ব বোঝাতে আমরা কোরিয়ার এ উদাহরণটা ব্যবহার করি। আধুনিকায়নের চিন্তা থেকেই একটা সময় দেশটির কর্তৃপক্ষ সিউল শহরের ভেতরেই একটি নদীর ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ একটি উড়াল সড়ক করেছিল। পরবর্তী সময়ে তা ভেঙে ফেলে সেখানে নদী পুনরুদ্ধার করে গণপরিসর সৃষ্টি করা হয়। জলাধারের দুই পাশে হাঁটার জায়গা রাখা হয়। গণপরিসরকে গুরুত্ব দিয়েই তারা কাজটি করেছে। কারণ মানুষকে কেন্দ্রে রেখে যদি নগর পরিকল্পনা করা হয়, সে নগর অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়। আমরা শহর তৈরি করি মানুষের জন্য। সুতরাং মানুষের চাহিদাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে যে কোন বিষয়গুলো রাখলে মানুষ সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। শহরটা তার কাছে প্রিয় মনে হবে। উড়াল সড়ক তৈরি করে, অবকাঠামো নির্মাণ করে শহরকে প্রাণবন্ত করা যায় না। বরং মানুষের চাহিদা সামনে রেখে যদি তৈরি করা যায়, তখনই শহরগুলো বেশি প্রাণবন্ত হয়। 


মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে-পরবর্তী ঢাকা কি গাড়ির জটমুক্ত হবে বলে মনে করেন। ঢাকার রাস্তায় আগের তুলনায় বাইসাইকেল চালানোর পরিমাণ বেড়েছে। আলাদা বাইসাইকেল লেন করা কতটা জরুরি?

বর্তমান নগর পরিকল্পনায় ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহন ব্যবহারকে উৎসাহ দেয়া হয়। গণপরিবহনের মধ্যে মেট্রো, বাস র্যাপিড ট্রানজিট ও হাঁটার জন্য ফুটপাত তৈরির বিষয়গুলো আছে। যার মানে গণমানুষের উপযোগী অবকাঠামো তৈরি  করা। ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার কোটি ট্রিপ তৈরি হয়। কেউ বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে আসছে—এটা একটা ট্রিপ। আবার বাসে করে অফিসে আসা এবং ঠিক একইভাবে অফিস শেষে বাসায় যাওয়া—মোট চারটি ট্রিপ তৈরি হলো। ঢাকা শহরের বর্তমান যে গণপরিবহন ব্যবস্থা আছে, সেটা দিয়ে এই জনবহুল শহরকে সচল রাখা যাচ্ছে না। আমাদের এ জায়গাটায় পরিবর্তন আনতে হবে। তা হলো, বেশি মানুষকে বহন করতে পারে এ রকম পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করা। সেক্ষেত্রে মেট্রো হতে পারে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট হতে পারে, দোতলা বাস বা রাইড শেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ব্যবস্থাপনা যত ভালো হবে তত বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। ইদানীং সাইকেলের পাশাপাশি মোটরসাইকেলের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কারণ যানজটের মধ্যেও মোটরসাইকেল বা সাইকেলে করে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। সব শহরে সাইকেল ব্যবহারকে উৎসাহ দেয়া হয়, কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তা সাইকেল চলানোর মতো নিরাপদ নয়। তাই বলব, সাইকেল চলার জন্য নিরাপদ লেন যেন তৈরি করা হয়। এটি তৈরি হলে অনেকেই সাইকেল চালাতে উৎসাহিত বোধ করবে। পাশাপাশি হেঁটে চলা মানুষদের জন্য প্রশস্ত ফুটপাত তৈরি করতে হবে। চার কোটি ট্রিপের একটা বিরাট অংশ কিন্তু হেঁটে চলাচল করে। মনে রাখা জরুরি, আমরা যেন তাদের গাড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য না করি। 


গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা কীভাবে আরো আধুনিক করা সম্ভব? 

ঢাকা শহরের রাস্তার পরিমাণ বিবেচনায় অন-স্ট্রিট পার্কিং এখানে করা যাবে না, কারণ শহরকে সচল রাখার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রাস্তা এখানে নেই। মতিঝিলে অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং আছে, যেগুলোর অনেকাংশ খালি পড়ে থাকে। অথচ দেখা যায় গাড়িগুলো সব রাস্তায় পার্ক করে রাখা হয়েছে। সুতরাং এখানে আইন প্রয়োগেরও ব্যাপার আছে। তাই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে বহুতলবিশিষ্ট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং সেখানে অর্থ দিয়ে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকবে। এজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। তাহলে বাইরে থেকে বোঝা যাবে কোথায় পার্কিংয়ের জন্য জায়গা খালি আছে। পার্কিংয়ের বন্দোবস্ত করার পাশাপাশি কেউ যাতে অন স্ট্রিট পার্কিং না করে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া আমরা যদি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করি তাহলে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। গণপরিবহন ব্যবহার উপযোগী, আরামদায়ক, নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য করতে হবে। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে গণপরিবহন স্টেশনে আসতে পারে, সেজন্য অবকাঠামো তৈরি করা জরুরি। এভাবে ভালো একটি পরিবহন পরিকল্পনা তৈরি হবে। অনেক সময় আমরা দেখি ফুটপাতের ওপর মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা হয়। ফুটপাতে মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে এমন কোনো কিছু করা যাবে না, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।   


হকার নিয়ন্ত্রণ ও তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায় কীভাবে? অন্যান্য দেশেও নিশ্চয়ই হকার বাণিজ্য রয়েছে। ওরা কাজগুলো কীভাবে করে? 

অনেক শহরে ভেন্ডর পলিসি আছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিল্লিতেও আছে। হকাররা কীভাবে জায়গাগুলো ব্যবহার করবে তার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নীতিমালা রয়েছে। হকাররা কোন জায়গায় কতজন দাঁড়াবে, তার সংখ্যা নির্ধারণ করা আছে। প্রথম কাজ হচ্ছে হকারদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা। এটা করা গেলে আমরা বুঝতে পারব কতজন হকারের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। এখন দেখা যায় বিশেষ কিছু জায়গায় সব হকার একসঙ্গে বসতে চায়। যে কারণ সে জায়গায় চলাচলের অসুবিধা হয়। হকারদের নিবন্ধনের আওতায় আনার মাধ্যমে প্রতি বছর সিটি করপোরেশন তাদের কাছ থেকে অর্থও পেতে পারে। তাছাড়া হকারদের কাছ থেকে ফি বাবদ অর্থ নিলে সিটি করপোরেশনেরও তাদের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয় যে এদের আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট জায়গা দিতে হবে, যেখানে তারা বসলে পথচারীদের কোনো অসুবিধা হবে না। অনেক সময় হকারদের উচ্ছেদ করা হয় এবং হকার মার্কেট বা অন্য কোথাও বসার কথা বলা হয়। হকাররা সে জায়গায় যায় না। সে বরং ওই জায়গাটা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করে দিয়ে পুরনো জায়গায় ফিরে আসে। এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। হকারদের জন্য যাতে ফুটপাতের পথচারীদের কোনো অসুবিধা না হয়, এটি দেখা গুরুত্বপূর্ণ। 


বাস্তুহারা বা কাজ হারানো মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়গুলো আমলে নিয়ে অভিঘাতসহিষ্ণু নগর ব্যবস্থাপনার চেহারাটা কেমন হতে পারে?  

অভিঘাত শহরে যেমন আছে তেমনি গ্রামেও আছে। গ্রামে যেমন নদীভাঙন আবার উপকূলীয় এলাকাগুলোয় বন্যা, সাইক্লোনের কারণে মানুষ তার জীবিকা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে তারা শহরে চলে আসছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনার পাশাপাশি দেশভিত্তিক জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা জরুরি। সারা দেশের স্থানিক বিন্যাস, সুযোগ, সম্ভাবনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়নের সময় সে অনুযায়ী বাজেট পরিকল্পনা তৈরি, তহবিল বরাদ্দ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ যদি তৈরি করা যায় তাহলে সে তার নিজের এলাকায় কাজের সুযোগ পাবে। এটা জাতীয় পরিকল্পনার অংশ। ঢাকা এখন একটি মনোসেন্ট্রিক শহর। ঢাকা নিজের সমস্যা নিয়ে খুবই জর্জরিত। আমাদের জেলা, বিভাগীয় শহর ও মফস্বলগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কারণ আগামী দশকগুলোয় এ জেলা শহরগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যদি আমরা টেকসই উন্নয়ন চাই তাহলে ওই শহরগুলোর ওপর অনেক বেশি মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। সেখানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান তৈরি করা প্রয়োজন। এগুলো যদি তৈরি করা যায় তাহলে সেখানে তাদের কাজের সুযোগ হবে এবং তারা সেখানেই থাকবে। ঢাকার মতো একটা শহরে এসে জড়ো হবে না।


এই যে অভিঘাতসহিষ্ণু নগরের কথা আপনি বললেন। এক্ষেত্রে আমাদের অভিঘাতগুলো কেমন হতে পারে?

ভূমিকম্প, জলাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় আছে। প্রতিটা অভিঘাতকে বিবেচনা করে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। শহরাঞ্চলের জন্য যেমন প্রস্তুতি নিতে হবে, তেমনি গ্রামাঞ্চলের জন্যও প্রস্তুতি রাখতে হবে যে অভিঘাতগুলো মোকাবেলা করে কীভাবে আমরা আরো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারব। যেমন ভূমিকম্প কোন পর্যায়ের হতে পারে, এটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আগাম ধারণা নিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় যাতে না হয়, সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে। আগে থেকে এ ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণই অভিঘাতসহিষ্ণু নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। বিভিন্ন অভিঘাতের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। 


অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশে যে আইন আছে তা কতটুকু আমলে নেয়া হচ্ছে? যদি না নেয়া হয়, এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী হবে?

নগর পরিকল্পনা বা উন্নয়নের যতগুলো সেক্টর রয়েছে, সব সেক্টরেই অসংখ্য আইন-নীতিমালা আছে। মূল বিষয়টি হলো, সেগুলো মানা হচ্ছে কিনা। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা, কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা, ড্রেনেজ প্ল্যান, উন্মুক্ত স্থানের জন্য পরিকল্পনা, জলাধার সংরক্ষণ আইন আছে। আইন আছে, বাস্তবে আইনের প্রতিপালন করা দরকার। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের নিজেদের কিছু দায়দায়িত্ব আছে, আমরা নিজেরা যেমন এ আইনগুলোর প্রতিপালন করব, যারা নগর কর্তৃপক্ষ আছে, তাদেরও দায়িত্ব হবে আইন মান্যের ব্যবস্থা করা। এজন্য যদি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়, তা নিতে হবে। বনানী থেকে শুরু করে নিমতলী ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো যখন ঘটে তখন প্রত্যেকটা জায়গায় কমিটি গঠন করা হয়, সুপারিশমালা যায়। সুপারিশগুলোয় কিন্তু নতুন কিছু থাকে না, ঘুরেফিরে করণীয় সম্পর্কে পুরনো কথাগুলোই বলা হয়। যেমন দাহ্য বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত গুদামগুলোকে সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়। এটা কিন্তু নতুন নয়। বারবার বলা হয়েছে। তবু গুদামগুলো কিন্তু সরছে না। তাই প্রস্তাবিত আইন প্রতিপালন করার বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যেন না হয়, বরং আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা শক্তিশালী অবস্থান দরকার। প্রতিষ্ঠানগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে আইনগুলোকে বাস্তবায়ন করবে। এ শহরকে যত আইনি কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত করতে পারবেন তত বেশি তা বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন