বিক্রি না হওয়ায় বিটুমিন উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি

দেবব্রত রায় চট্টগ্রাম ব্যুরো

কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল সড়ক নির্মাণ মেরামতের কাজ। চাহিদা সংকটে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে অবিক্রীত পড়ে আছে প্রায় ১০ হাজার টন বিটুমিন। কারণে নতুন করে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)

বিপিসির তথ্যমতে, কয়েক মাস ধরে চাহিদা না থাকায় দফায় দফায় দাম কমিয়েও বিক্রি করা যায়নি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ উপকরণটি। সর্বশেষ গত শনিবার পর্যন্ত ইআরএলে ৩১ হাজার ১৩৬টি ড্রাম, যমুনা অয়েলে ১৬ হাজার ৩৭০ ড্রাম, পদ্মা অয়েলে ১১ হাজার ৪৫৫ ড্রাম, মেঘনা অয়েলে হাজার ৪১৬ ড্রাম স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে হাজার ৫১ ড্রাম বিটুমিন মজুদ ছিল। সব মিলিয়ে বিপিসির পাঁচ প্রতিষ্ঠানে ৬৫ হাজার ৪১৮টি ড্রামে (প্রতি ড্রামে ১৫০ কেজি) মোট হাজার ৮১৪ টন বিটুমিন অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে।

দেশে প্রতি বছর সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টনের মতো বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে কম-বেশি ৬০ হাজার টন বিটুমিন সরবরাহ করে ইআরএল, যা মোট চাহিদার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। উৎপাদিত এসব বিটুমিন স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, পদ্মা অয়েল, মেঘনা অয়েল এবং যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করে বিপিসি।

বিটুমিনের বিক্রি কমে যাওয়ায় এক বছরের মধ্যে অন্তত তিন দফায় নির্মাণ উপকরণটির দাম কমানো হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই সময়ে তিন দফা কমিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বিপিসি। সর্বশেষ দাম কমানো হয় গত জুলাই। সময় ১৫০ কেজির প্রতি ড্রাম বিটুমিনের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০/৭০ গ্রেডের জন্য হাজার ৩০০ টাকা, যা আগে ছিল হাজার ৯০০ টাকা। ৮০/১০০ গ্রেডের জন্য নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় হাজার ৯০০ টাকা, যা আগে ছিল হাজার ৫০০ টাকা। এদিকে ড্রামজাত বিটুমিনের টনপ্রতি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬০/৭০ গ্রেডের জন্য ৪০ হাজার ৯২৩ টাকা এবং ৮০/১০০ গ্রেডের জন্য ৩৮ হাজার ৬৫০ টাকা। কিন্তু তৃতীয় দফায় দাম কমিয়েও বিক্রিতে গতি না আসায় বর্তমানে বিটুমিন উৎপাদন বন্ধই রেখেছে ইআরএল।

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আকতারুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, করোনা মহামারী বৃষ্টির কারণে বিটুমিনের বিক্রি আপাতত কম। বিপিসির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনো বিটুমিন অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে কিছু বিক্রি যে হচ্ছে না তা নয়।

বিটুমিনের উৎপাদন বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্মকর্তা বলেন, করোনা, লকডাউন বৃষ্টির কারণে বিটুমিন অবিক্রীত থাকায় আমাদের প্লান্ট মাঝে মাঝে বন্ধ রাখা হয়। এটি রুটিন কাজ। চাহিদা বাড়লে বিটুমিন প্লান্ট আবারো পুরোদমে চালু হবে।

বিপিসির তথ্যমতে, দেশের একমাত্র ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডই সরকারিভাবে বিটুমিন উৎপাদন করে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি বিটুমিন বিপণন করা হয়েছিল ৬২ হাজার ৪৪০ টন। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫৯ হাজার ৮৩৬ টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ৪৪৬ টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৫ হাজার ২৮ টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৯ হাজার ৩৯৯ টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৮৭৭ টন বিটুমিন সরবরাহ করে ইআরএল।

এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে বেসরকারিভাবে লাখ ২০ হাজার ৭৪১ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে লাখ ৮০ হাজার ২৭৫ টন বিটুমিন আমদানি করা হয়।

বিশ্লেষকরা জানান, দেশে বিপিসির আমদানি করা অপরিশোধিত ক্রুড অয়েল থেকে বিভিন্ন ধরনের তেল তৈরি করে ইআরএল। ক্রুড অয়েলের উপজাত থেকে তৈরি হওয়া বিটুমিন দেশের সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। যদিও এভাবে দেশের চাহিদার মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ বিটুমিন সরবরাহ করে বিপিসি। চাহিদার বাকি বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিটুমিনের মাসিক চাহিদা প্রায় ৪৫ হাজার টনের কাছাকাছি। সরকারের নতুন নতুন প্রকল্পের কারণে প্রতি বছর চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু ইআরএল তাদের সক্ষমতা না বাড়ানোর কারণে বিটুমিন খাত একেবারেই বেসরকারি খাতের দিকে চলে যাচ্ছে।

তবে সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, ইস্টার্ন রিফাইনারি সাধারণত ৮০/১০০ এবং ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করে। যার মধ্যে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন অনেক বেশি টেকসই। দেশের সড়ক এবং আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিনই এখানকার সড়কের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। কিন্তু এলজিইডির চাহিদা অনুযায়ী বিটুমিন সরবরাহ করতে পারে না প্রতিষ্ঠানটি। সেজন্য বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিন ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু সেখানে বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিনের নানা জটিলতা এবং মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় সেগুলো ব্যবহারের কিছুদিন পরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

আমদানি করা বিটুমিনের মান নিয়ে বরাবরই অভিযোগ আছে ব্যবহারকারীদের। তারা বলছেন, সরকারিভাবে তৈরি বিটুমিনের স্বল্পতার কারণে বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিন দিয়েই কাজ করতে হয়। কিন্তু সেগুলো নিম্নমানের হওয়ার কারণে সড়কে ব্যবহার করা হলে কিছুদিন পরই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সড়ক নষ্ট হলে সেগুলো সংস্কারে নতুন করে আবারো প্রকল্প নিতে হচ্ছে সরকারকে। যার কারণে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সরকার। তবে আমদানিকারকদের দাবি, আমদানি করা বিটুমিনের মান সরকারি বিটুমিনের কাছাকাছি মানের। কিন্তু আমদানি করা বিটুমিন ডিলার বা এজেন্টদের মাধ্যমের বিক্রি করা হয় মাঠ পর্যায়ে। সেখানে হয়তো বিটুমিনের মানের কারসাজি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ বিটুমিন আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়ন কবির উদ্দিন ভুঁইয়া বণিক বার্তাকে জানান, আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে যে বিটুমিন আমদানি করি, সেগুলো অটো ড্রামজাত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মানের। ইরানি বিটুমিন যেগুলো আসে সেগুলোর মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। করোনার কারণে এখন সরকারি প্রকল্প বন্ধ থাকায় বিটুমিনের আমদানিতে কিছুটা ধীরগতি আছে। তবে প্রকল্পগুলো শুরু হলে আবারো আমদানি হবে। এখন তেমন একটা বিটুমিন মজুদ নেই বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন