করোনার প্রভাব

চায়ের বিপণনে মন্দা কমেছে উৎপাদনও

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশে রেকর্ড চা উৎপাদন হয়েছে গত বছর, চাহিদা ভালো থাকায় বিপণনেও ছিল চাঙ্গা ভাব। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে উৎপাদন বিপণন দুটোতেই ধাক্কা লেগেছে।

চা বোর্ডের মাসিক উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বর্ষা তথা ভরা মৌসুমেও চা উৎপাদন কমেছে। দেশের বাগানগুলোয় গত বছরের জুনে যেখানে কোটি ১৬ লাখ ৬৭ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল, সেখানে বছরের জুনে ১৬৭টি বাগানে মোট চা উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার কেজি।

জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে মোট চা উৎপাদন হয়েছে কোটি ১৮ লাখ হাজার কেজি। যদিও গত বছরের একই সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কোটি ৭৯ লাখ ৪৮ হাজার কেজি। অর্থাৎ মৌসুমের প্রথম ছয় মাসে উৎপাদন কম হয়েছে ৬১ লাখ ৩৯ হাজার কেজি।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে জনজীবন স্বাভাবিক না হওয়ায় বিক্রি কমেছে চায়ের। এতে স্বল্প পুঁজির বাগানগুলোতে পরিচালন ব্যয় বিশেষত শ্রমিক মজুরি নিয়ে জটিলতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম সূচক চায়ের ভোগ্যতা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখী থাকলে চায়ের চাহিদাও বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে চা ভোগের পরিমাণ বাড়লে খাতটির উৎপাদক সংশ্লিষ্টরাও লাভবান হয়। কয়েক বছর ধরে দেশের চা খাতের ঈর্ষণীয় ভোগ বাড়লেও কভিড-১৯-এর কারণে বর্তমানে চাহিদায় মন্দা বিরাজ করছে। দুই মাসের বেশি সময় দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি থাকায় চায়ের দোকান বন্ধ ছিল। বর্তমানে অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেকটা সচল হলেও মানুষের চা পানের প্রবণতা কমেছে। কারণে পাড়া-মহল্লার চা দোকানের ওপর বিপণন নির্ভরশীল এমন কোম্পানিগুলোর চা বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। সর্বশেষ অর্থবছরে দেশে নিলামে প্রতি কেজি চা গড়ে ১৭৬ টাকা দরে বিক্রি হলেও বছর চায়ের গড় দাম আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ মৌসুমে দেশের আন্তর্জাতিক নিলামে গড়ে প্রতি কেজি চা বিক্রি হয়েছিল গড়ে ১৮৭ টাকায়। এর পরের বছর (২০১৬-১৭) দাম কিছুটা বেড়ে হয় ১৯১ টাকা, দাম আরো বেড়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২১৪ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬২ টাকায় উন্নীত হয়। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেকর্ড উৎপাদন হওয়ায় চায়ের দাম হঠাৎ কমে প্রতি কেজি গড়ে ১৭৬ টাকায় বিক্রি হয়। চলতি ২০২০-২১ মৌসুমে নিলামে চায়ের কাটতি কমতে থাকায় গড় দাম আরো কমে গেছে। জুন পর্যন্ত চায়ের গড় দাম প্রতি কেজিতে নেমে এসেছে ১৭০ টাকারও নিচে। বছরের শেষার্ধের চা বিপণনের হিসাব যুক্ত হলে চলতি মৌসুমের চায়ের গড় দাম ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন চা ব্রোকার্স বাগান মালিকরা।

বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে চা খাত সাধারণ মানুষের ভোগ্যতার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে মার্চ থেকেই চায়ের বিপণন অর্ধেকে নেমে গেছে। বাগানে উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও নিলাম থেকে ফেরত আসায় গুদামে চা জমছে। এতে বাগানগুলোর পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। করোনাকালীন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে উৎপাদন খরচ বাড়ালেও আয় কমে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন বাগান মালিকরা। পরিচালন খরচ মেটাতে না পারায় বাধ্য হয়ে দেশের অধিকাংশ চা বাগানই উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

দেশের চায়ের নিলাম বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত নবম নিলামে ৩৭ লাখ ৪৩ হাজার কেজি চা প্রস্তাব করা হয়, যা পূর্ববর্তী বছরের একই নিলামের চেয়ে লাখ কেজি বেশি। এছাড়া ২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত দশম নিলামে চা প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৩ লাখ ৩৮ হাজার কেজিযা পূর্ববর্তী বছরের একই নিলামের চেয়ে প্রায় পৌনে দুই লাখ কেজি কম। আগে প্রতিটি নিলামে প্রস্তাব করা চায়ের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত নিলামগুলোতে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বিক্রি হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি চা অবিক্রীত থাকায় দেশীয় বাগানে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি দাম কমছে বলে মনে করছেন চা সংশ্লিষ্টরা।

বাগান মালিকদের দাবি, সরকারের নানা সহযোগিতায় চা বাগানগুলো দেশীয় চাহিদার প্রায় শতভাগ উৎপাদন করছে। কিন্তু কভিড-১৯-এর কারণে উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় বাগানগুলোকে সুরক্ষা দিতে সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ছাড়াও ব্যাংকঋণে বিশেষ সুবিধা পেতে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাগান মালিকদের সংগঠন। প্রায় ছয় লাখ চা শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পাশাপাশি রফতানিমুখী খাত হিসেবে চায়ের উৎপাদন ধরে রাখতে সরকারের বিশেষ সহযোগিতার দাবি করেছেন বাগান মালিকরা।

প্রসঙ্গত, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চলতি মৌসুমের নিলাম আয়োজন শুরু করতে বিলম্ব হয়। তবে ১৮ মে থেকে কিছুটা বিলম্বে নিলাম শুরু হয়। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এরই মধ্যে দেশের চায়ের নিলাম সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বাড়িয়েছে চা বোর্ড। চলতি মৌসুমে দেশে চায়ের বিপণন কমে যাওয়ায় রফতানির পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চায়ের উৎপাদন স্বাভাবিক রেখে রফতানি বাড়ানো গেলে চা উৎপাদনে ক্ষতি রফতানির মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন চা সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন