মন্দায় থাকা বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারে করোনার ধাক্কা

শামীম রাহমান

আগে থেকেই মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার। এর মধ্য দিয়ে খাতটিকে আরো সংকটে ফেলে দিয়েছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দুই মাসের অঘোষিত লকডাউন অর্থনৈতিক স্থবিরতার ধারাবাহিকতায় জুনে বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি কমেছে ৫০ শতাংশ।

দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারে ২০১৯ সালটি ছিল মন্দার। গত বছর দেশে পণ্য পরিবহনের প্রধান বাহন ট্রাকের বিক্রি এক ধাপে কমে যায় ২৬ শতাংশ। বাস, মিনিবাস আর থ্রি-হুইলারের বাজার তুলনামূলক ভালো থাকলেও পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান, কার্গো ভ্যান ডেলিভারি ভ্যানের বিক্রি কমে যায়। মন্দার বাজারে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে নতুন বছর শুরু করেছিলেন দেশের বাণিজ্যিক গাড়ি শিল্পের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু খাতটিকে আরো সংকটের মধ্যে ফেলে দেয় কভিড-১৯ মহামারী।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, বাণিজ্যিক গাড়ি প্রধানত তিন ধরনের কাজে ব্যবহার হয়। আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহন, নির্মাণসামগ্রী পরিবহন খাদ্যসামগ্রী পরিবহন। করোনার সময়ে ধরনের পরিবহনের চাহিদা কমেছে। এর প্রভাব এসে ঠেকেছে গাড়ির বাজারে। জুনে আমাদের বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি ৫০ শতাংশের মতো কম হয়েছিল। চলতি মাসে বাজার কিছুটা ভালো হতে শুরু করেছে। বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বিক্রি ৭৫ শতাংশের মতো হচ্ছে।

দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারটি প্রধানত আমদানিনির্ভর। নিটল-নিলয়, ইফাদ অটোস, র্যাংগস মোটরস, আফতাব অটোমোবাইল, রানার, উত্তরা মোটরসের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খাতের প্রধান অংশীদার। আমদানির পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক গাড়ি অ্যাসেম্বলিংও করছে। হিনো, মিত্সুবিশি, টাটা, আইশার অশোক লেল্যান্ড ব্র্যান্ডের বিভিন্ন গাড়ি বাংলাদেশে অ্যাসেম্বলিং করছে রানার, নিটল, ইফাদ র্যাংগস। আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির এক সাম্প্রতিক রিভিউ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারের ৪০ শতাংশ দখল করে আছে নিটল-নিলয় গ্রুপ। ইফাদ অটোসের মার্কেট শেয়ার ৩৮ শতাংশ। বাজারটিতে রানারের অংশীদারিত্ব ১০ শতাংশের মতো।

কয়েক বছর ধরে দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়ে আসছিল ১৫-২০ শতাংশ হারে। ছন্দপতন ঘটে গত বছর। ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক গাড়ির বাজার পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মোটরযান নিবন্ধনের তথ্যে। গত বছর দেশে ২০১৮ সালের চেয়ে হাজার ৩৩৭টি ট্রাক কম নিবন্ধন হয়েছে। গত বছর দেশে কার্গো ভ্যান নিবন্ধিত হয় মোটে চারটি, যেখানে আগের বছর নিবন্ধিত হয়েছিল হাজার ২৮০টি। একইভাবে গত বছর কাভার্ড ভ্যান নিবন্ধন কমেছে হাজার ২৮৭টি কাভার্ড ভ্যান। এছাড়া ডেলিভারি ভ্যান পিকআপের নিবন্ধন কমেছে আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ৫৬৯ হাজার ১৪৫টি। গত বছর গাড়ির বাজারের পরিস্থিতির পেছনে পর্যাপ্ত ব্যাংকঋণ না পাওয়াকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের পরিস্থিতি গিয়েছে আরো খারাপের দিকে। বিষয়টি বিআরটিএর পরিসংখ্যানের পাশাপাশি উঠে এসেছে বণিক বার্তাকে দেয়া খাতসংশ্লিষ্টদের তথ্যেও। বর্তমানে বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন তারা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারব্যাপ্তি কম-বেশি হাজার ২০০ কোটি টাকা। বছরে অন্তত ৩৫ হাজার ইউনিট গাড়ি বিক্রি হয়। প্রতি মাসে গাড়ি বিক্রি হয় চার থেকে সাড়ে চার হাজার ইউনিট। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও হারে বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। মার্চে বিক্রি কিছুটা কমে যায়। এরপর এপ্রিল মে মাসের অঘোষিত শাটডাউন চলাকালে বিক্রির পরিমাণ নেমে আসে প্রায় শূন্যে। শাটডাউন তুলে দেয়ার পর জুনে বিক্রি হয়েছে আনুমানিক দেড় হাজার ইউনিট গাড়ি।

টাটা অশোক লেল্যান্ড ব্র্যান্ডের বাণিজ্যিক গাড়ি গাড়ির যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে এনে অ্যাসেম্বলিং বাজারজাত করছে ইফাদ অটোস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসকিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বলি আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বলি, প্রতিটি খাতেই নভেল করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা যারা বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি করি, তাদের ওপরও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোটি গতিশীল করে আসছে বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থা। এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক জড়িত। সব মিলিয়ে আমরা এখন একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সরকার দেশের বিভিন্ন শিল্প ব্যবসা খাতের জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। আর্থিক ক্ষতি সামলে উঠতে দেশের বাণিজ্যিক গাড়ি শিল্পের ব্যবসায়ীদের জন্যও ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ অত্যন্ত জরুরি।

গত বছর সার্বিকভাবে দেশের বাণিজ্যিক গাড়ির বাজারে মন্দা ভাব থাকলেও থ্রি-হুইলারের বিক্রি ভালো ছিল। তবে বছর করোনার কারণে থ্রি-হুইলার বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চের দিকে যে হারে গাড়ি বিক্রি হয়েছে, জুনে বিক্রি হয়েছে তার মাত্র ৪০ শতাংশ। চলতি মাসের বিক্রির ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে বিক্রির প্রবণতা কিছুটা বেড়েছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো কয়েক মাস সময় লাগবে। যদিও সেটি নির্ভর করছে চলমান পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হবে তার ওপর।

উত্তরা মোটরসের হেড অব সেলস (থ্রি-হুইলার) তফাজ্জাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার কারণে বাণিজ্যিক গাড়ির ব্যবসায় টান পড়েছে, চাহিদা কমেছে। ক্রেতার চাহিদার জায়গায়ও এসেছে পরিবর্তন। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের চেয়ে সিঙ্গেল ট্রান্সপোর্ট বা প্রাইভেট ট্রান্সপোর্টের দিকে মানুষ বেশি ঝুঁকছে। এক্ষেত্রে বাড়ছে মোটরসাইকেল বিক্রি।

শুধু বাণিজ্যিক গাড়ি নয়, ব্যক্তিগত গাড়ির (প্রাইভেট কার) বাজারও এখন কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) নেতারা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে দুই মাসের বেশি সময় ধরে বিপুলসংখ্যক গাড়ি ব্যবসায়ীদের শোরুম বন্দরে আটকে ছিল। করোনাপরবর্তী সময়েও গাড়ির বেচাবিক্রি কমেছে। প্রাইভেট কারের পাশাপাশি মোটরসাইকেলের বাজারেও তৈরি হয়েছে মন্দা ভাব। মোটরসাইকেল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, দুই মাসের সাধারণ ছুটিতে দেশের মোটরসাইকেল শিল্পে ক্ষতি হয়েছে হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে যে রকম পরিস্থিতি চলছে, তাতে বছর শেষে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন