ব্র্যাকের জরিপ

আয় শূন্যে নেমেছে ৫১ শতাংশ খানার

নিজস্ব প্রতিবেদক

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ঘোষিত ছুটিতে উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষের। ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা গিয়েছে, এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ উত্তরদাতার খানাভিত্তিক আয় শূন্যে নেমে এসেছে। দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল স্বল্প আয়ের মানুষদের ৬২ শতাংশ চাকরি বা উপার্জনের সুযোগ হারিয়েছেন। আর্থিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন ২৮ শতাংশ ব্যক্তি। সংক্রমণরোধী সব পদক্ষেপ মানছেন না ২৪ শতাংশ মানুষ।

কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিতে দেশের জনসাধারণের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে ব্র্যাক সম্প্রতি জরিপ পরিচালনা করে। গতকাল আয়োজিত এক ডিজিটাল সম্মেলনে জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। গত মে থেকে ১৩ মে পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় পরিচালিত জরিপে বিভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থার হাজার ৩১৭ জন উত্তরদাতা অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চল ৩২ শতাংশ নগর এলাকার বাসিন্দা। অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশই নারী।

জরিপের তথ্যমতে, সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগে যেখানে খানাভিত্তিক গড় মাসিক আয় ছিল ২৪ হাজার ৫৬৫ টাকা, সেখানে মে মাসে তা ৭৬ শতাংশ কমে নেমে এসেছে হাজার ৯৬ টাকায়। এর মধ্যে শহর এলাকায় আয় কমার হার ৭৯ শতাংশ পল্লী অঞ্চলে ৭৫ শতাংশ। সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ জেলার উত্তরদাতারা। জেলাগুলো হলো পিরোজপুর, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, গাইবান্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

পুরুষপ্রধান খানাগুলোর তুলনায় নারীপ্রধান খানাগুলো আর্থিক দিক থেকে কিছুটা বেশি নাজুক অবস্থানে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠেছে। এর মধ্যে নারীপ্রধান খানার আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। ৭৫ শতাংশ কমেছে পুরুষপ্রধান খানার আয়। নারীপ্রধান খানাগুলোর উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ জানিয়েছেন, বর্তমানে তাদের কোনো উপার্জনই নেই। অন্যদিকে পুরুষপ্রধান খানাগুলোর উত্তরদাতাদের মধ্যে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন ৪৯ শতাংশ।

ব্র্যাকের গতকালের ডিজিটাল সম্মেলনে প্যানেল আলোচক ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সাবেক সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জী, ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান এবং ব্র্যাকের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ।

জরিপের ৭৬ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তারা নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সবসময় মেনে চলেন। বাকিরা অনিয়মিতভাবে অনুসরণ করেন, যা আশঙ্কাজনক। ৭৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তারা কভিড-১৯- আক্রান্ত হবেন না। বিশ্বাস গ্রামাঞ্চলের ৮১ শতাংশ মানুষের। শহরে হার সামান্য কম ৭১ শতাংশ।

জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর নিম্নআয়ের দৈনিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ধীরে ধীরে জীবিকা নির্বাহের পথে ফিরে আসছেন। কিন্তু এসব পরিবারের অনেকের অন্তত আগামী তিন মাসের জন্য ধারাবাহিক খাদ্য বা আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হবে।

আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকার শ্রমঘন খাতকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছে, যাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা যায়। প্রবাসফেরত শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা কাজ ফেরত পায়।

ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেয়াটা বেশ চ্যালেঞ্জিং, কারণ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো নতুন ব্যবস্থার প্রসার প্রয়োজন। একবার ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেই মানুষ সহজেই আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে। ব্র্যাক পর্যন্ত লাখ ৬০ হাজার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে এবং পাঁচ লাখ ঋণগ্রহীতার পরিবারকে তাদের জমা দেয়া সঞ্চয় ফেরত দিয়েছে।

জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, উত্তরদাতাদের ৩৮ শতাংশ মনে করছেন, অভাবী পরিবারগুলোর কাছে সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আরো সমন্বয় প্রয়োজন। বেশির ভাগ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা আগের মতোই আছে। ১১ শতাংশ জানিয়েছেন, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে সংক্রমণকালীন দারিদ্র্য বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছেন অধিকাংশ উত্তরদাতা (৫৮ শতাংশ)

সম্মেলনে সুদীপ্ত মুখার্জী বলেন, মহামারীর সংকট মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে যাওয়ার উপায় নেই। সেবার দ্বৈততা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার চেয়ে এটাই এখন বেশি জরুরি।

ব্র্যাকের পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটি মনে করছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং -সংক্রান্ত বিবিধ প্যাকেজ প্রণোদনা দারিদ্র্যবান্ধব দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সহায়তা প্রণোদনা প্যাকেজ ব্যবস্থাপনায় আরো স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যক্তি খাতের সাহায্য গ্রহণ করা উচিত। নিম্নআয়ের মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে তালিকা প্রণয়নের কাজে এনজিও স্থানীয় সমাজভিত্তিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করা উচিত।

এছাড়াও সংস্থাটি মনে করছে, সহায়তা প্রয়োজন এমন পরিবারগুলোর তথ্যভাণ্ডার প্রণয়ন করে তা উন্মুক্ত করা যেতে পারে, যাতে করে দ্বৈততা এড়ানো যায়। সহায়তা প্রদানবিষয়ক অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে নারীপ্রধান খানাসহ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন