দ্বিতীয় ঝড়ের দুর্ভাবনা

বণিক বার্তা ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি মার্চ থেকে চরম তাণ্ডবলীলা শুরু করেছিল নভেল করোনাভাইরাস। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অনেক দেশকে কঠোরভাবে লকডাউনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। জনগণ সরকারের সচেতন উদ্যোগে কোনো কোনো দেশ দারুণভাবে মহামারীর বিধ্বংসী রূপকে প্রতিরোধ করতে পেরেছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে যেসব দেশ ভাইরাসকে নিজ দেশের সীমানা থেকে তাড়াতে পেরেছিল তাদের মাঝে স্লোভেনিয়া নিউজিল্যান্ড অন্যতম। এছাড়া আরো কিছু দেশ ভাইরাসের সংক্রমণ আটকাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।

লকডাউনের কঠোর এই নীতির ফলে অর্থনৈতিক সামাজিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে অনেক দেশকে। বিশেষ করে সামাজিক দূরত্বের নীতি কঠোরভাবে আরোপ করার ফলে এই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বর্তমান সময়ে এসে সরকারের মতো জনগণও এখন চাইছে বিধিনিষেধ ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। কিন্তু এই লকডাউন বিধিনিষেধ তুলে দেয়ার যে প্রক্রিয়া তা নতুন এক আশঙ্কার বার্তাও শোনাচ্ছে দেশগুলোকে। সেটি হলো কভিড-১৯ ফিরে আসতে পারে। পুনরায় শক্তি অর্জন করে ফিরে আসার এই প্রক্রিয়াকেই বলা হচ্ছে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঝড়।

মানুষের মনে দ্বিতীয় ঝড় নিয়ে জেগে ওঠা ভয়ের পেছনে বাড়তি রসদ জোগাচ্ছে অতীত ইতিহাস। বিশেষ করে ১৯১৮-২০ সালের মাঝে ঘটে যাওয়া স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর ইতিহাস বলছে দ্বিতীয় ঝড়ের আঘাত আরো বেশি বিধ্বংসী ছিল। একই চিত্র দেখা গেছে ২০০৯-১০ সালের এইচ১এন১ মহামারীর সময়েও। প্রশ্ন হচ্ছে কভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঝড় থেকে বাঁচতে আমরা আসলে কী করতে পারি?

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য যা দরকার তা হলো একটি উপযুক্ত সংবেদনশীল বাহক। সে সঙ্গে প্রয়োজন একটি সফল সংক্রমণও। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে কতজন নতুন মানুষকে সংক্রমিত করছে সেই হিসাব কষে এটি ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে। এটিকে দিয়ে বোঝানো হয়।

-এর মান যদি একের বেশি হয় তখন বুঝতে হবে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে একের নিচে হলে বুঝতে হবে আক্রান্তের সংখ্যা কমছে। লকডাউনের আগে কোথাও কোথাও -এর মান দুই থেকে চার পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছিল।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র্রসহ অনেক ইউরোপিয়ান দেশে এখন এই মান একের নিচে চলে গেছে। অন্যদিকে সুইডেন রাশিয়ার মতো দেশগুলা আবার -এর মান হয় একের ওপর বা কাছাকাছি। যা বুঝিয়ে দিচ্ছে সেসব দেশে সংক্রমণের মাত্রা এখনো বেশ ঊর্ধ্বমুখী।

জন-আচরণ -এর মানের মাঝে যে সম্পর্ক তা বেশ জটিল। কিন্তু আমরা এখনো ধারণা ব্যবহার করে দ্বিতীয় ঝড় কেমন হতে পারে, তার একটা চিত্র তৈরি করতে পারি। যতক্ষণ পর্যন্ত সংবেদনশীল সংক্রমিত মানুষ জনগণের মাঝে উপস্থিত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। সংগৃহীত করা প্রমাণগুলো বলছে, প্রথম ঝড়ের যে ধাক্কা তা হার্ড ইমিউনিটি লেভেলের অনেক নিচে ছিল, ফলে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার জন্য তা বেশ উপযুক্ত ছিল।

এখানে আবার এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে যেখানে ভাইরাস কেবল টিকেই ছিল না, বরং ছড়িয়ে পড়াও অব্যাহত রেখেছিল। কেয়ার হোমগুলোতে সংক্রমণের হার অনেক দেশে আক্রান্তের সংখ্যাকে বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে টানা লকডাউনের পর করোনাভাইরাসের উপস্থিতি এখন মানুষের অভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল করার পর মানুষের মাঝে মেলামেশাও বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। আর এটা নিশ্চিতভাবেই -এর যে মান তাকে বাড়িয়ে দেবে। তবে এই মানকে একের নিচে বা সমান সমান রাখা মোটেই সহজ কাজ নয়।

এমনকি -এর মান যদি বেড়ে মাত্র . তে গিয়েও দাঁড়ায়, সেটিও নিয়ে আসতে পারে বড় ধরনের দুর্যোগ। যাকে আমরা দেখতে পারি দ্বিতীয় ঝড় হিসেবে। তাই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো যথাযথ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার তা উপলব্ধি করাও বেশ জরুরি।

এখন দ্বিতীয় ঝড় সামলানোর জন্য আবারো সেই লকডাউনের বিধিনিষেধেই ফিরে যেতে হবে। প্রথম ধাক্কাকে সামনে রেখে এতদিন পর্যন্ত জনগণ লকডাউন নীতি বেশ ভালোভাবেই মেনে চলেছে। কিন্তু লকডাউন পুনরায় আরোপ করতে গেলে -সংক্রান্ত যে ক্লান্তি তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পরে। ফলে একই মাত্রায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞ মত হচ্ছে, কভিড-১৯-এর মহামারী শরৎ থেকে শীত পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, যখন মৌসুমি ফ্লুও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এখন পর্যন্ত যেহেতু কভিড-১৯-এর আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কোনো প্রমাণ মেলেনি, তাই সে সময়ে গিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে যদি কভিড-১৯ ফ্লু একসঙ্গে আক্রমণ করে।

তবে একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। কভিড-১৯-এর মোকাবেলায় যেসব স্বাস্থ্য সুরক্ষার নীতি মেনে চলা হয়, যেমন মাস্ক পরা এবং বারবার হাত ধোয়া, তা মৌসুমি ফ্লুর বিস্তারকে অনেকাংশে রুখে দিতে পারে।

তবে এর মাঝে আরেকটি দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে ভাইরাসের মিউটেশন। যেখানে নিজেকে পরিবর্তনের মাধ্যমে সার্স-কোভ- আরো বেশি শক্তি সঞ্চয় করে নিতে পারে। যেখানে পরিবর্তন দ্বিতীয় ঝড় বয়ে এনে ক্ষতির পরিমাণকেও অনেক বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় ঝড়ের ক্ষেত্রে।

যদি তেমন কিছু আসলেই ঘটে যায় তবে বর্তমানে চলতে থাকা প্রাদুর্ভাব তার সামনে নস্যি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে -এর যে মান যদি -এর কাছাকাছিও হয়, সেটিও চূড়ান্ত বিস্তৃতির জন্য যথেষ্ট হবে। তাতে যে ক্ষত তৈরি হবে সেটিও অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ভয়ংকর হবে।

নিকট ভবিষ্যতে সরকারগুলোকে ভাইরাস দমনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সামাজিক জীবনের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। টেস্ট, ট্রেস আঞ্চলিকভাবে সাড়া দেয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এপিডেমিওলজিক্যাল মডেল এবং -এর মানের যে ধারণা তা এটা বুঝতে সহায়তা করবে যে কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতদিন পর্যন্ত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার দ্বিতীয় ঝড় প্রতিরোধ করতে পারে।

সায়েন্স অ্যালার্ট

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন