ঘূর্ণিঝড় আম্পান

করোনা বিবেচনায় নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক

করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই বাংলাদেশে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আবহাওয়া বিভাগের ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পান আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়াল ঝড়ের মতো গতিশক্তি। দক্ষিণবঙ্গের ওপর দিয়ে ঝড়টি প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। সরকার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে, আজ থেকে মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার কাজ শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিরন্তর প্রচেষ্টাও চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে এবং আরো ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। এজন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে ভবিষ্যতের জন্যও। সমাধান হতে হবে টেকসই দীর্ঘমেয়াদি। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি লাখ ৩৮ হাজার। সেই অবস্থা থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতি করেছে, যার প্রমাণ ২০০৭ সালে সিডরের মতো সুপার সাইক্লোনেও মানুষের মৃত্যু আটকে রাখা গেছে ১০ হাজারের মধ্যে। এর পরের ঘূর্ণিঝড়গুলোয় ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশকে এখন দুর্যোগ সামলানোর রোল মডেল বলা হয়। অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি পূর্বাভাস ব্যবস্থা জোরদার, প্রশাসনের দ্রুত সাড়াদান লাখো প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীর চেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু দিন যায় আর তার সঙ্গে নতুন সমস্যা যুক্ত হয়।

প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল-মে মাসে বঙ্গোপসাগরে সাধারণত একাধিক লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। সেই লঘুচাপ কখনো-কখনো পরিণত হয় ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান গত কয়েক দিনে অগ্রসর হয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বড় বিষয় হলো, এটি ক্ষণে ক্ষণে দিক পরিবর্তন করছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানার শঙ্কা বেশি। একথা সত্য, গেল কয়েক দশকে বাংলাদেশ সামুদ্রিক ঝড় মোকাবেলায় বিশেষ সক্ষমতা অর্জন করেছে। উপকূলজুড়ে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার তৈরি করা হয়েছে এবং মানুষের মৃত্যু ক্ষয়ক্ষতিও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। আগের অভিজ্ঞতা বলে, ধরনের ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যথেষ্ট হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা তাত্পর্যপূর্ণ অগ্রগতি করেছি। কিন্তু এবারের বিষয়টি ভিন্ন। করোনার কারণে সময়ে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিতে হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাটাও জরুরি। পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলাটা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার মানুষ গবাদি পশুর মৃত্যু কমাতে হলে সাইক্লোন শেল্টারের কোনো বিকল্প নেই। কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যাপ্ত শেল্টার প্রয়োজন, যা একটা চ্যালেঞ্জ হবে বৈকি। কারণ যদি শেল্টারে আশ্রয় নেয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঘটে, তাহলে ওই এলাকায় সংক্রমণের সংখ্যাটি অনেক বেড়ে যেতে পাোর। তাছাড়া ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময় মানুষের মধ্যে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাটাও নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসতে পারে। কারণ সেখানে শারীরিক দূরত্ব মানতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে সাফল্যের সঙ্গেই সরকার ঘূর্ণিঝড় সামলাতে পারবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা উপকূলের সাড়ে তিন কোটি মানুষকে দুর্যোগ সহনশীল করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রথমেই তাদের আবাসস্থলকে প্রাথমিক দুর্যোগ সহনশীল করতে হবে। জলোচ্ছ্বাসের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এর উচ্চতা এবং বাতাসের সর্বোচ্চ গতিতে যেন এটি টিকে থাকতে পারে, তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

পার্শ্ববর্তী দেশের পশ্চিমবঙ্গ আম্পান মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে রাজ্য সরকার অধিবাসীদের সরিয়ে নেয়া, পর্যাপ্ত ত্রাণের মজুদ গড়ে তোলাসহ জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। স্থানীয় পত্রিকা থেকে শুরু করে জাতীয় দৈনিকগুলো সচেতনতার কাজে এগিয়ে এসেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতির ঘাটতি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট এনজিওগুলো বড় ভূমিকা রেখে থাকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবারো যেন সেসব কাজ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। রেডিও, টিভিতে প্রচারণা আরো জোরদার করা দরকার। একই সঙ্গে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে আগে থেকেই, যাতে ঘূর্ণিঝড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সরকারকে বেগ পেতে না হয়। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার পাশাপাশি দুর্যোগকালীন পরবর্তী সময়ে মানুষের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মেডিকেল টিম গঠনসহ দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে অনিয়ম দুর্নীতি প্রতিরোধে ত্রাণ দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের তদারকিও জোরদার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। 

দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্য প্রশংসনীয়। দুর্যোগ-পূর্ববর্তী ব্যাপক প্রস্তুতির কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো গেছে। এর পরও প্রাণহানি সম্পদ বিনাশের দিক থেকে ক্ষতি একেবারে কম হয় না। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দুর্যোগ কাটিয়ে তারা যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সহায়তায় দ্রুত সেগুলো কাটার ব্যবস্থা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বা সহায়তার পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে গবাদিপশুর ক্ষতি হতে পারে। এজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে যাদের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, দ্রুত তা মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। অধিকাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে। কাজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য বন রক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে, যা এড়ানোর সুযোগ নেই। তবে চাইলেই আমরা পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে পারি যেন প্রকৃতি বৈরী হয়ে না ওঠে। এই সচেতনতাও জরুরি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন