পোশাক খাত

বাংলাদেশে কার্যালয় বন্ধ করছে ক্রেতারা, বিপাকে কর্মী

বদরুল আলম

বাংলাদেশসহ আরো বেশকিছু দেশ থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে পোশাকপণ্যের যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ডেবেনহ্যাম। বেশ আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি নাজুক ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের প্রভাবে প্রতিষ্ঠানটি হংকংয়ে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ডেবেনহ্যাম হংকং লিমিটেডের ঢাকা লিয়াজোঁ কার্যালয়টিও বন্ধ হয়ে গেছে। অঘোষিত লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন লিয়াজোঁ কার্যালয়ে কর্মরত অর্ধশতাধিক কর্মী।

শুধু ডেবেনহ্যাম নয়, কার্যালয় বন্ধ হতে পারে এমন তালিকায় আছে ইতালির আল কর্তে। আবার কর্মী কমিয়ে আনতে শুরু করেছে এমন তালিকায় আছে যুক্তরাজ্যের নেক্সটসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কভিড-১৯ প্রভাব শুরুর আগে থেকেই আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছিল অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। ধারাবাহিকতায় বিপুল পরিমাণ বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অনেক ক্রেতা দেউলিয়া হতেও আবেদন করতে শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশে কার্যালয় আছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয় বন্ধ করেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই কর্মী কমাতে শুরু করায় বিপাকে পড়েছেন বিপুলসংখ্যক কর্মী।

ডেবেনহ্যাম বাংলাদেশ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ডেবেনহ্যাম হংকং লিমিটেডের অধীনে লিয়াজোঁ কার্যালয় আছে ঢাকায়। সম্প্রতি ডেবেনহ্যাম হংকং লিমিটেডের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের লিয়াজোঁ অফিসে কাজ করছেন ৬৯ জন কর্মী। অতিসম্প্রতি ডেবেনহ্যামের যুক্তরাজ্য কার্যালয় থেকে একটি -মেইল মারফত বলা হয়, ইউ আর অল টার্মিনেটেড বা আপনাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করা হলো। যদিও বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইনও অনুসরণ করে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে টার্মিনেট করার কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেবেনহ্যামের কর্মীরা বলেছেন, লিয়াজোঁ অফিস হিসেবে বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নিবন্ধন নিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল ডেবেনহ্যামের বাংলাদেশ কার্যালয়। সম্প্রতি একজন লিকুইডেটর পাঠিয়ে বলা হলো এখন থেকে লিকুইডেটর সব ধরনের যোগাযোগ রক্ষা করবেন। আমাদের -মেইল আইডিও ব্লক করে দেয়া হয়।

আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করা হলে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দাবি তুললে আমরা জয়ী হব, এমন তথ্য উল্লেখ করে ডেবেনহ্যাম ঢাকা লিয়াজোঁ কার্যালয়ের কর্মীরা আরো বলেন, সমস্যা হলো ক্লেইম উত্থাপন করে প্রাপ্য আদায় করা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত যেতে হতে পারে, আর সবাই তা করতে চাইবে না। যদিও বাংলাদেশ কার্যালয়ে এমন কর্মীও আছেন যারা আর এখানে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। এমন কর্মীরা কোনো ধরনের সুবিধা পাবেন না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিয়াজোঁ কার্যালয়গুলোর কার্যক্রম তদারকি কর্মী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইন যথাযথভাবে পরিপালন না হওয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান পরিচালন কাঠামোর আইনি দুর্বলতার কারণেই ক্রেতারা চাইলেই কার্যালয় গুটিয়ে ফেলতে পারছেন। এদিকে বিপাকে পড়ছেন কার্যালয়গুলোতে কর্মরত কর্মীরা।

জানা গেছে, বস্ত্র আইন ২০১৮ প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের বস্ত্র-পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট বায়িং হাউজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধন নেয়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। আইনে দিকনির্দেশনা ছিল বস্ত্র শিল্পের পোশাক কর্তৃপক্ষ বস্ত্র অধিদপ্তরের নিবন্ধনের আওতায় রয়েছে পোশাকের বায়িং হাউজ, ব্র্যান্ড অন্য ক্রেতাদের লিয়াজোঁ কার্যালয় থেকে শুরু করে শিল্পসংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো। আইনের আওতায় প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে নিবন্ধন নিতে আহ্বানও জানানো হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু ডেবেনহ্যামের কর্মীরা নয়, আরো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা বাংলাদেশের কার্যালয় গুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। ব্র্যান্ড হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক স্বীকৃতি থাকলেও দেশের আইনি দুর্বলতায় চাইলেই যখন তখন তারা কার্যালয় গুটিয়ে নিতে পারে। এতে বিপাকে পড়েন কর্মীরা। বর্তমান কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে। কিন্তু আইনি দুর্বলতার কারণে যথাযথ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর শুধু পোশাক পণ্যের ক্রেতাদের লিয়াজোঁ কার্যালয়ের কর্মীরা নন, বাংলাদেশে বায়িং হাউজ হিসেবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও কর্মসংস্থান নিয়ে শঙ্বা সৃষ্টি হয়েছে। গার্মেন্ট ট্রেডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন চার লক্ষাধিক দক্ষ শিক্ষিত কর্মী।

সম্প্রতি ইন্দোশাইন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি হংকংভিত্তিক বায়িং হাউজের বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান এশিয়া এক্সেল ট্রেডিং লিমিটেডে কর্মরত কর্মীদের ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ফ্যাব্রিক টেকনোলজিস্ট হিসেবে ২০১৯ সালের জুনে কাজ শুরু করেছিলেন একজন কর্মী। সম্প্রতি তাদের রিট্রেঞ্চমেন্ট বা ছাঁটাই করার তথ্য জানানো হয় প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগ থেকে। সেখানে বলা হয় ৩০ এপ্রিল থেকে প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় অনেক ব্র্যান্ডও নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুই বছর ধরে একের এক বন্ধ হচ্ছে আউটলেট। সম্প্রতি কভিড-১৯ বিপর্যয়ে অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতিতে পণ্য সরবরাহকারী দেশগুলোতে স্থাপিত কার্যালয়েও ব্যয় সংকোচন হবে। যার ভুক্তভোগী হতে হবে কর্মীদের।

কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার বেশ আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক স্থানীয় প্রেক্ষাপট নিয়ে সমীক্ষা করে বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউজকুপারস (পিডব্লিউসি) ওই সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দেউলিয়া হতে চেয়েছে ব্রাজিলের কিকো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বন-টন, মার্চে সাউদার্ন গ্রোসার্স, এপ্রিলে নাইন ওয়েস্ট ওয়েস্ট, মে মাসে রকপোর্ট, আগস্টে ব্রুকস্টোন, অক্টোবরে সিয়ার্স নভেম্বরে ডেভিড ব্রাইডাল দেউলিয়া হতে চেয়ে আবেদন করে। আর চলতি বছর দেউলিয়া হতে চাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিউটি ব্র্যান্ডস, ফুল বিউটি ব্র্যান্ডস। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে জেসি পেনি দেউলিয়া হতে চাইছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন