বদলে গেছে শোক-শেষকৃত্যের ধরনও

বণিক বার্তা ডেস্ক

গত শনিবার দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছেন সাংবাদিক ব্রিটিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ফুয়াদ নাহদি। তার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে অনেকেই শোক প্রকাশ করেছে। যদিও তার জানাজা তথা শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে পরিবারের ২০ সদস্য ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। অথচ এমন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের শেষকৃত্যে হাজার না হোক অন্তত কয়েকশ লোক উপস্থিত থাকার কথা ছিল। 

মুসলমানদের কাছে মৃত্যু সাধারণত সাম্প্রদায়িক ঘটনা। যেকোনো মানুষের মৃত্যুতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিত-অপরিচিত অনেক লোক উপস্থিত থাকেন। মৃতের জানাজাকেও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। তবে হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল কীভাবে? কেন নাহদির মতো একজন মানুষের মৃত্যুতে এমন অল্পসংখ্যক উপস্থিতি? উত্তরটা অবশ্য খুব সহজেই দেয়া যায়। নভেল করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে পৃথিবীর রঙ। যার প্রভাব এড়াতে পারেনি শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানও। গোটা পৃথিবী যখন লকডাউন অবস্থায় দিন পার করছে, তখন শেষকৃত্যে জনসমাগমও বাড়াবাড়ি বটে। তবে সরাসরি উপস্থিত হতে না পারলেও কেনিয়া থেকে মালয়েশিয়াতে হাজারো মানুষ ফেসবুকে লাইভ দেখেছে নাহদির শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান। 

নাহদিকে শেষ বিদায় জানাতে পরিবারের সদস্য ইমামসহ আর যারা উপস্থিত ছিলেন সবার মুখে ছিল মাস্ক। মূলত করোনার হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা। বিষয়ে কম্পেশনেট ফিউনারেলসের সহপ্রতিষ্ঠাতা হাসিনা জামান বলেন, মাস্ক পরে শেষকৃত্যের আয়োজন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাজ কঠিন হয়ে যায়। এমনকি মৃতের জন্য শোক প্রকাশের যে ধরন, তাতেও পরিবর্তন চলে এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সময় হাসিনা জামান বলেন, মৃতের শেষকৃত্য আয়োজনের জন্য সরকার যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তাতে অস্পষ্টতা আছে। পাশাপাশি করোনায় কেউ মারা গেলে মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারাকেও সামনে আনেন তিনি। যদিও কয়েকদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বলা হয়েছে, মৃতদেহ থেকে করোনা ছড়ায় না। অবশ্য তার পরও মৃতের শেষকৃত্যে জমায়েত অনুমোদন করা যায় না। কারণ উপস্থিত মানুষদের নিজেদের ভেতর সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়। 

এদিকে ব্রিটেনের মুসলিম কাউন্সিল থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, মৃতের গোসল দেয়ার সময় যেন পুরোপুরিভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। যদিও এটি খুব বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন জামান। 

কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের লেকচারার মনসুর আলী বলেছেন, ব্রিটিশ বোর্ড অব স্কলারস এবং ইমামরা শেষকৃত্য আয়োজনের নিয়ম সংক্ষিপ্ত করতে বলেছেন। যেমননিয়মতান্ত্রিক যে গোসল, সেটি করানোর প্রয়োজন নেই এবং কাফনের পরিবর্তে মৃতদেহ ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়া যাবে। 

শেষকৃত্য পরিচালনাকারী অনেকেই সংক্রমণ এড়াতে এরই মধ্যে এসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। জামানও জানিয়েছেন, মৃতদেহকে এখন তারা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে নিচ্ছেন, এরপর গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করে ব্যাগটি কফিনে রাখা হয়। পরে সরাসরি তা কবরস্থ করা হয়। 

ইরানের মতো মুসলিম দেশেও শিয়া সম্প্রদায়ের লাশ কবরস্থ করার যেসব আচার-অনুষ্ঠান, তা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি পরিবারের করবস্থানে যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মৃতদেহ গোসলের যেসব আচার, তা- এখন আর মানা হচ্ছে না। 

অবশ্য কেবল মুসলমানদের মাঝেই নয়, মহামারীর কারণে মৃতদেহকে ঘিরে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর প্রার্থনা অনুষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। চার্চ, সিনাগগ মন্দিরের জমায়েতও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ব্রিটেনের ইহুদি সম্প্রদায়ও গত বুধবার স্থগিত করেছে তাদের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। 

আয়ারল্যান্ডে আইরিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফিউনারেল ডিরেক্টরস পরামর্শ দিয়েছে, মৃতদেহে সুগন্ধি না মাখাতে এবং ওপেন-ক্যাসকেট ইভেন্টসের (মৃতের মুখ দর্শন) পরিবর্তে ক্লোসড-কফিন ফিউনারেল আয়োজন করতে। 

অবশ্য অবস্থায় সমস্যা সমাধানে প্রযুক্তির সহায়তা নিতে বলা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কাছে না গিয়েও অংশ নেয়া যেতে পারে আয়োজনে। যদিও অনেকে মনে করেন, কেউ মারা গেলে তখন তার পরিবারের পাশে থাকা এবং সান্ত্বনা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। অবস্থায় দুর্বলদের সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি আরো বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। আর এমনিতে কাছের কেউ মারা গেলে একজন লোক নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন। তার ওপর বিধিনিষেধগুলো আরো বেশি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে।

অবশ্য এটা কেবল ব্রিটেন, ইরান কিংবা আয়ারল্যান্ডের চিত্র নয়। গোটা পৃথিবী মৃতের শেষকৃত্য আয়োজনে ভয়াবহ এক সংকটের মুখে পড়েছে। যে দেশে করোনা সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ডেকে এনেছে, সেই ইতালিকেও পার করতে হচ্ছে একই পরিস্থিতি।

ইতালির কাস্তিগ্লিওনে শহরের ৫৮ বছর বয়সী যাজক ডন গ্যাব্রিয়েল বেরনারদেল্লি বলেন, এখন শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি আমার এক সহকারী কেবল রয়ে গেছি মৃতদের প্রার্থনার জন্য। 

একইভাবে বাংলাদেশেও সামনে এসেছে একই ধরনের ঘটনা। এখানেও করোনা আক্রান্তদের সবার অগোচরে কবর দেয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনকি সন্দেহজনক মৃত্যুতেও ভয়ে প্রতিবেশীরা আসছে না শেষকৃত্যে। উল্টো লাশ দাফনে বাধা দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে করোনার ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে তা মৃতকেও ছাড় দিচ্ছে না। 

 

আল জাজিরা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন