বর্তমানে ভারতের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে এশিয়ার দেশটির বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল চীন। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে ৮ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের। একই সময় চীনের সঙ্গে এ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ডলার। একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে। অন্যদিকে ওই সময়ে ৬ হাজার ৪৯৬ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পাদিত হয় ভারত ও চীনের মধ্যে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের এ ধারা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে। কারণ নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন উভয়েই তাদের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করতে চাইছে। তাছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। বিশেষ করে ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোনো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) চূড়ান্ত করতে পারলে, দেশ দুটির দ্বিপক্ষীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের মহাপরিচালক অজয় সাহাই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এফটিআই হলে তা ভারতের জন্য খুবই লাভজনক হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র গার্হস্থ্য পণ্য ও সেবার বৃহত্তম বাজার। সাহাই আরো বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে তা কমছে।
যুক্তরাষ্ট্র হলো সেই গুটিকয়েক দেশের অন্যতম, যার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ অনেক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ১ হাজার ৬৮৫ ডলারের। কিন্তু একই সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৫৬ কোটি ডলারে। উপাত্ত অনুযায়ী, চীন ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল। এর আগে দেশটির সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হতো সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সঙ্গে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেডের অধ্যাপক রাকেশ মোহন যোশি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি করার আগে বেশকিছু ক্ষেত্রে ভারতকে সতর্ক হবে। বিশেষ করে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বিষয়ে এ সতর্কতা বিশেষ জরুরি। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ভুট্টা ও সয়াবিনের মতো বহু ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম উৎপাদক ও রফতানিকারক।
অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্য প্লাটফর্ম কানেক্ট টু ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী পবন গুপ্ত বলেন, একটি চুক্তি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্কে আরো গতি আনবে। শুল্কের বাধ্যবাধকতা সহজ হলে পণ্যের বাজার আরো বড় হবে। বিশেষ করে সম্প্রসারিত হবে ভারতে উৎপাদিত ইস্পাত, ইস্পাতজাত পণ্য ও অ্যালুমিনিয়ামের রফতানি।
ভারত প্রত্যাশা করছে, দেশটির উৎপাদিত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামজাত কিছু পণ্যে আরোপিত উচ্চশুল্ক প্রত্যাহার করবে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ভারত কৃষিপণ্য, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ রফতানির জন্য মার্কিন বাজারে আরো বেশি প্রবেশাধিকার পাবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও ভারতের বাজারে নিজেদের খামার ও ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে দেশটি ভারতের সঙ্গে উচ্চ বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়েও উদ্বিগ্ন।
২০ বছর আগে ভারত সফর করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এরপর থেকেই মার্কিন-ভারত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক উষ্ণতর হতে থাকে। কিন্তু তারপরও কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাণিজ্য নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখনো টানাপড়েন থেকে গেছে। কিন্তু আশা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের এবারের ভারত সফরে এসব বিষয়ের কিছুটা হলেও সমাধান হবে।
মূলত, ট্রাম্পের এবারের সফরকালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি পারমাণবিক চুল্লি বিক্রির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। এ বিষয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ ও মনমোহন সিং।
এছাড়া ভারতের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি ২০১৬ সালের ৩ হাজার কোটি ডলার থেকে ২০১৮ সালে আড়াই হাজার কোটি ডলারে নামলেও তা ট্রাম্পের জন্য এখনো অনেক বেশি। এছাড়া ট্রাম্প ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সফরের আগে ভারত সম্পর্কে বলেছেন, দেশটি বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন বিষয়ে আঘাত করেই চলেছে। ফলে ট্রাম্পের এবারের সফরকালে বড় ধরনের কোনো চুক্তি সম্পাদন নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
তবে নানা বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও চীন নিয়ে দুই দেশেরই অনুভূতি একই ধরনের। ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্র কেউই ঠিক চীনকে সর্বতোভাবে বিশ্বাস করে না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে বহুদিন ধরে। অন্যদিকে ১৯৬২ সালে যুদ্ধে জড়িয়েছিল ভারত ও চীন। প্রায়ই দেশ দুটির মধ্যে সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও এএফপি অবলম্বনে