ক’দিন পরই একুশে গ্রন্থমেলা। দম ফেলার ফুরসত নেই ঢাকার ছাপাখানাগুলোয়। সমানতালে
চলছে বই বাঁধাইয়ের কাজও। রাজধানীর বাংলাবাজারে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ
ব্যস্ততা দেখতে গিয়ে হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক শিশুশ্রমিকের দিকে। নাম সাখাওয়াত, বয়স আট কি দশ। দুই হাতে লেগে আছে আঠা । সেই হাত দিয়েই বারবার চোখ-মুখের ঘাম মুছছে এ শিশু।
সাখাওয়াত জানায়, বই বাঁধাইয়ের কাজ করায় দিনের লম্বা সময়জুড়ে দুই হাতে আঠা
লেগে থাকে তার। সে জানে না কেমিক্যাল মিশ্রিত এ আঠা তার জন্য কতটা ক্ষতিকর। জানলেও
কিছুই করার নেই তার। এটা যে তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ কথা বলতেই সাখাওয়াতের
উত্তর—‘এত কিছু ভাবুনের সময় নাই। পেট চালাইতে কাম (কাজ)
হরি (করি)।’
শুধু সাখাওয়াত নয়, তার মতো আরো অনেক শিশুশ্রমিক কাজ করে রাজধানীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বই বাঁধাইয়ের। কেবল বাঁধাই নয়, প্রেসের বিভিন্ন মেশিন চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করছে তারা। জীবিকার তাগিদে এ পেশা বেছে নিয়েছে তারা। শিশুশ্রম বন্ধে নীতিমালা থাকলেও এ কারখানাগুলোতে নজর পড়েনি যথাযথ কোনো কর্তৃপক্ষের।
বাংলাদেশ মুদ্রণ
শিল্প সমিতির তথ্যমতে, রাজধানী ও এর আশপাশে প্রায় ১ হাজার ৩০০ ছাপাখানা
আছে। এ ছাপাখানাগুলোতে বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। শুধু রাজধানীতে
প্রায় ১ হাজার প্রেস ও বাইন্ডিং কারখানা রয়েছে। ঢাকা মহানগর প্রিন্টিং বাইন্ডিং
শ্রমিক ইউনিয়ন বলছে, প্রতিটি কারখানায় শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী শ্রমিক কাজ করে। কোনো কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা চার-পাঁচজন, আবার কোনো কারখানায় ১৫ জনের অধিক শ্রমিক কাজ
করেন।
আরামবাগ, ফকিরাপুল,
বাংলাবাজার, নীলক্ষেত প্রিন্টিং প্রেস ও বই বাঁধাইয়ের কারখানাগুলোতে
ঘুরে দেখা যায়, এসব কারখানার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ শ্রমিকই শিশু।
বইমেলাকে ঘিরে প্রেস ও বই বাঁধাই কারখানায় রাত-দিন কাজ করতে
ব্যস্ত এ শিশুশ্রমিকরা। কাজের চাপ বেশি থাকায় দিনশেষে রাতে কাজ করতে হচ্ছে তাদের।
বই বাঁধাইয়ের
কাজে বাইন্ডিং কারখানায় ব্যবহার করা হয় আঠা ও সুচ। এসব আঠায় থাকে ক্ষতিকর
কেমিক্যাল, যা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
এ বিষয়ে স্যার
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অফিসার ইন স্পেশাল ডিজিজ ও শিশু বিশেষজ্ঞ ড. ভিকারুন্নেসা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বই বাঁধাইয়ের কাজে যে ধরনের আঠা ব্যবহার করা হয়, তাতে তুত,
চুনসহ বেশকিছু ক্ষতিকর
উপাদান থাকে। দীর্ঘদিন এ ধরনের আঠা দিয়ে কাজ করলে হাত-পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। খাদ্যনালিতে আলসার ও খাদ্যনালি চিকন হতে পারে।
এক্ষেত্রে বড়দের চেয়ে শিশুদের ঝুঁকি বেশি।’
শুধু আঠা নয়, বই বাঁধাই করতে ব্যবহার করা হয় ধারালো সুচ ও সুতো। বেশির ভাগ বই সেলাই করে পরে আঠা দিয়ে মলাট লাগানো হয়। মোটা বই সেলাইয়ের সময় প্রায়ই হাত ফসকে ধারালো সুচ শিশুশ্রমিকের হাতে ঢুকে যায়। এতে ক্ষত সৃষ্টির পাশাপাশি ক্ষত থেকে অনেকের ঘা পর্যন্ত হয়েছে বলে শিশুশ্রমিক নাজমুল জানায়। তার কথায়, ‘গতবার অল্পের জন্য বাঁইচা গেছি। অর্ধেক সুই হাতে ঢুকছিল। ওই হাতে আঠা দিয়া কাম করছি। পরে ঘা হইছিল। অনেক টাকার ওষুধ খাইছি। ম্যালা দিন কাম করতে পারি নাই। মালিক একটা টাকাও দেয় নাই।’
বই বাঁধাই ছাড়াও
প্রেসের প্রিন্টিং মেশিন ও কাটিং মেশিন চালানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করতে দেখা যায়
শিশুদের। এসব কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে অনেকেই।
বেশকিছু শ্রমিকের প্রিন্টিং মেশিনে হাত ঢুকে কেটে যাওয়া ও কাটিং মেশিনে হাতের আঙুল
কেটে পড়ে গেছে বলে কয়েকজন কারখানা মালিক জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারখানা
মালিক বলেন, এর আগে প্রিন্টিং মেশিন ও কাটিং মেশিনে অনেকেরই
হাত কেটেছে। আসলে এ মেশিনগুলো শিশুদের দিয়ে চালানোর মতো না। একটু ভুলেই দুর্ঘটনা
ঘটতে পারে। কম টাকায় শিশুদের দিয়ে কাজ করানো যায় বলে অনেকেই শিশুদের নিয়োগ দেন।
আবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও তার দায়ভার কোনো সংগঠন নেয় না। শুধু মালিকরা চিকিৎসা
করতে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তবে শিশুদের দিয়ে এমন কাজ না
করানোই ভালো।
ঝুঁকি নিয়ে কাজ
করলেও এর বিনিময়ে আর্থিক প্রাপ্তি খুবই কম এসব শিশুশ্রমিকের। সারা মাস কাজ করে ৩
থেকে ৭ হাজার টাকা পেয়ে থাকে তারা।
শরীয়তপুর থেকে
ঢাকায় এসে বুক বাইন্ডিংয়ের কাজ করছে ১০ বছরের শিশু মো. তামমি মোল্লা। এখন তার বয়স ১০ বছর হলেও তিন বছর আগে থেকেই
পেশায় নিজেকে জড়িয়েছে সে। ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে কেন জড়িয়ে আছে জানতে চাইলে তামিম বলে, ‘আমার মা মারা গেছেন। বাড়িতে অসুস্থ বাবা আছেন। তিন ভাই-বোন আমরা। বাবার মুখে খাবার তুলে দিতে এ কাজ করি। বেতন কম হলেও কিছু করার নেই।
পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পড়লে সংসার চলবে কী করে? এ কাজ করতে মন সায় দেয় না। রাত-দিন কাজ করতে হয়। একটু ভুল হলে মালিকের বকাঝকা লেগেই থাকে। নিজেকে খুব অসহায়
মনে হয়।’
শুধু তামিম নয়, মো. আক্তার, মো. আলামিন, মো. রায়হানের মতো এমন অসংখ্য শিশুর স্বপ্ন প্রতিদিন চাপা পড়ছে বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠার ভাঁজে। প্রায় সব কারখানায় শিশুশ্রমিক থাকলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের। একাধিক কারখানা মালিকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কিছু কারখানার মালিকের কণ্ঠে শোনা যায় ভিন্ন সুর। তারা জানান, ছোটবেলা থেকে তারাও এ পেশায় জড়িয়ে আছেন। তারা যখন কাজ শুরু করেছিলেন তখন তারাও এমন শিশু ছিলেন। এ শিশুরা পড়াশোনা করে না, কাজ না করে বাড়িতে থাকলে ভুল পথে পা বাড়াত, তাই এ কাজে তাদের বাধা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না তারা।
ঢাকা মহানগর
প্রিন্টিং বাইন্ডিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. মানিক কাজী বলেন, ‘আমাদের কাছে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা আছে।
আমাদের সংগঠনেরও একটি নীতিমালা আছে। তবে এগুলো প্রয়োগ করা হয় না। তাছাড়া প্রশাসনের
পক্ষ থেকেও কখনো এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়নি। তাই আমরাও এ নিয়ে ভাবি না।’ কাজের সময় কোনো শিশু দুর্ঘটনার কবলে পড়লে তাকে সহায়তা দেয়া হয় কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা দু-একটি ঘটলেও আমরা তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করেছি।’