প্রাণিদেহের আদি
কোষ বা স্টেম সেলকে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্দীপ্ত করে বিভিন্ন অঙ্গের
পুনর্গঠন ও ক্ষত নিরাময় সম্ভব। যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড, রক্ত সংবহনতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি অঙ্গের রোগের চিকিৎসায় স্টেম
সেল থেরাপির ব্যবহার হলেও কিডনির ক্ষেত্রে তা গবেষণার পর্যায়েই রয়েছে। সম্প্রতি
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন
(এফডিএ) বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় এ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সতর্কতা
জারি করেছে। অথচ গবেষণার পর্যায়ে থাকা এ পদ্ধতিতে দেশে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে
বাংলাদেশ লেজার সেল সার্জারি ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালসহ (বিএলসিএস)
আরো বেশ কয়েকটি
প্রতিষ্ঠান।
গবেষণা পর্যায়ে
থাকা এমন চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার এটির সফলতা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
বাংলাদেশ রেনাল
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন)
ডা. মোহাম্মদ রফিকুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, স্টেম সেলের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে
কিডনি রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেলের ব্যবহারে বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। বিশ্বের
কোনো দেশেই স্টেম সেলের মাধ্যমে কিডনি চিকিৎসা করা হয় না। এই চিকিৎসা নিয়ে উন্নত
দেশে গবেষণা চলছে।
বিএলসিএস
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত
হাসপাতালটিতে ২৫০-৩০০ রোগীকে স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। প্রতি রোগীকে
এ চিকিৎসার ব্যয় বাবদ দিতে হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৩০ জন
রোগী ধারাবাহিকভাবে স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা
নেয়া রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসার পর ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ভালো
থাকলেও পরবর্তী সময়ে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তারা। এমনকি এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেয়ার
পর ছয়জন রোগীর অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনাও
ঘটেছে। কোনো কোনো রোগী এ হাসপাতালে স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিলেও পরামর্শের
জন্য অন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে তাদের।
বিএলসিএস
হাসপাতালে এক বছর স্টেম সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেন কিডনি রোগী হুরুন নেসা। তার ছেলে
আব্দুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন,
‘মাকে এখনো অন্য ডাক্তারের
পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছে। পাশাপাশি ডায়ালাইসিসও করাতে হয়।’
জানা গেছে, মস্তিষ্ক,
অস্থিমজ্জা, রক্ত ও রক্ত সংবহনতন্ত্র, হাড়ের সঙ্গে
যুক্ত মাংসপেশি, ত্বক ও যকৃতে স্টেম সেলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন
বিজ্ঞানীরা। সাধারণভাবে দেহে স্টেম সেল চিহ্নিত করা কঠিন। কারণ অধিকাংশ সময়ে
নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকা এসব কোষ শুধু ক্ষত নিরাময় বা নতুন কোষ তৈরির ক্ষেত্রে
সক্রিয়তা ফিরে পায়। মূলত হেপাটোলজি বা হেমাটোলজির পাশাপাশি ত্বকের ঘা, স্নায়ুরজ্জুতে আঘাত,
ডায়াবেটিস, হূিপণ্ডের কার্যকারিতা হ্রাস ও চোখের রোগে স্টেম সেল থেরাপি
ব্যবহার হয়। দেশে এখন অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, রক্ত
সংবহনতন্ত্রের রোগ ও যকৃতের চিকিৎসায় এ থেরাপি ব্যবহার হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি চালুর আগে ন্যূনতম তিনটি ধাপে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করে সফলতা পাওয়ার পরই তা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়। প্রথমে গবেষণাগারে, এরপর প্রাণীর ওপর ও সবশেষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ওপর নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এসব ধাপ অতিক্রম করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে রোগীর ওপর তা প্রয়োগ করা হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশেই কিডনি রোগের চিকিৎসায় স্টেম সেলের ব্যবহার স্বীকৃত নয়।
২০১৩ থেকে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিডনি রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য স্টেম সেল পদ্ধতি নিয়ে
গবেষণা শুরু হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র,
কানাডা, চীন,
জার্মানি, কোরিয়া,
ভারতেও এ চিকিৎসা পদ্ধতি
নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে ভারত,
অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশে সীমিত পরিসরে এই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
আর দেশে বিএলসিএস কিডনি ও লিভারজনিত রোগীদের স্টেম সেলের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া
শুরু করে ২০১৮ সালে।
এ বিষয়ে জানতে
চাইলে কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কিডনি বিভাগের প্রধান ডা. হারুন অর রশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, স্টেম সেল থেরাপির মাধ্যমে যারা কিডনি ও লিভারের চিকিৎসা
দিচ্ছে, তা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। এটার এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে
প্রমাণ মেলেনি। উন্নত দেশ পরীক্ষামূলকভাবে প্রাণীর ওপর স্টেম সেল ব্যবহার করে
গবেষণা করছে।
তিনি বলেন, স্টেম সেলের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হলে অবশ্যই ঔষধ প্রশাসনের
অনুমতি নিতে হবে। আর এ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করতে হলেও বাংলাদেশ মেডিকেল
রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি)
অনুমোদন নিতে হবে। আর
গবেষণা পর্যায়ে থাকলে এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেয়া যাবে
না। নেয়া হলে তা হবে বেআইনি।
সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, এই চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক কোনো প্রমাণ নেই হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষের কাছে। উন্নত দেশগুলোতেও এই চিকিৎসা বর্তমানে গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশে স্টেম সেল পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর শরীরে কী ওষুধ প্রয়োগ করছে, সেটার বিষয়েও নজর দেয়া প্রয়োজন। এই থেরাপি মানুষের জন্য
কতটুকু নিরাপদ, এটাও দেখা প্রয়োজন। গবেষণা পর্যায়ে থাকা চিকিৎসা
পদ্ধতিতে রোগীদের চিকিৎসা দিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যদিও হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, অকেজো কিডনি ও লিভারের কার্যকারিতা ফেরাতে
চিকিৎসাবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক আবিষ্কার স্টেম সেল চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করছে
তারা। এছাড়া ডায়াবেটিসসহ অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিও এ পদ্ধতিতে নিরাময় সম্ভব বলে দাবি
করেছে তারা। স্টেম সেল চিকিৎসা দিতে রোগীর পেটের চামড়ার নিচ থেকে চর্বি সংগ্রহ করা
হয়। পরে তা ল্যাবে প্রক্রিয়াজাত ও উজ্জীবিত করে ধাপে ধাপে আলাদা করা হয় স্টেম
সেলগুলোকে, যা শিরাপথে পুনরায় প্রবেশ করানো হয় রোগীর শরীরে।
নাম প্রকাশে
অনিচ্ছুক এক কিডনি বিশেষজ্ঞ বণিক বার্তাকে বলেন, এক শ্রেণীর
বিশেষ মহল দাবি করছে স্টেম সেল দিয়ে সবকিছু তৈরি করা সম্ভব। তবে এটা সম্পূর্ণ
অবৈজ্ঞানিক কথা। সাময়িকভাবে এ চিকিৎসায় কিছুটা নিরাময় হলেও পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের
জটিলতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া চিকিৎসায় স্টেম সেল ব্যবহারের কোনো প্রমাণ নেই। এই
চিকিৎসা নিয়ে কাজ করার অনুমতি বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালকে দেয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং কিডনি রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. মো. শহীদুল ইসলাম সেলিম বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু কিডনি রোগী নয়,
এখন বিভিন্ন রোগে স্টেম
সেল পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। এই চিকিৎসা দিতে হলে অবশ্যই ঔষধ প্রশাসন থেকে
অনুমোদন নিতে হয়। তবে যারা চিকিৎসা দিচ্ছে তারা নিয়েছে কি না আমার জানা নেই।
বিভিন্ন দেশে এই চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা চলছে।