বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের মা

‘‌আমি কি ছেলের লাশটাও পাব না?’

শফিকুল ইসলাম

নিহত সোহেলের ছবি হাতে মা রাশেদা বেগম (ডানে) ও খালা জায়দা বেগম ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিহত সন্তানের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাশেদা বেগম। হাউমাউ করে কান্না করছেন, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে তার। হৃদয়ের সব ব্যাকুলতা যেন ফুটে উঠেছে চোখ, ঠোঁট, মুখে। নিহত সন্তানের মরদেহ একবার ছুঁয়ে দেখতে চান তিনি। বললেন, ‌‘আমি কি ছেলের লাশটাও পাব না? আমার ছেলে তো বেওয়ারিশ না। তাকে কেন বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হলো?’

রাশেদা বেগম বৃহস্পতিবার বিকালে যখন এসব কথা বলছিলেন সেই সময় ‘শহীদি মার্চ’ পদযাত্রা চলছিল। পদযাত্রাটা তখনো শহীদ মিনারে এসে পৌঁছেনি। আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সোহেল রানা (৩৭)। পরিবারের কেউই জানতেন না তিনি মারা গেছেন। সবাই অনুমান করেছিলেন সোহেল হয়তো জেলহাজতে কিংবা কারো বাসায় নিরাপদে আছেন। কিন্তু পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে সোহেলকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হবে, তা মানতে পারছেন না স্বজনরা। নিহতের পাঁচদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে সোহেলকে দাফন করা হয় রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। এত কবরের মধ্যে কোনটি সোহেলের, তা শনাক্তের জন্য কখনো ছুটে বেড়াচ্ছেন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, কখনো থানা, কখনো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের কাছে। নিহতের মরদেহ ফিরে পেতে চান স্বজনরা।

গত ১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হন সোহেল রানা। তারপর আর কোনো খবর পাননি স্বজনরা। নিহত সোহেল যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগের শ্যামপুরের লাল মিয়ার ছেলে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সোহেলই সবার বড়। এক্সপোর্টের জামা-কাপড়ের ব্যবসা করতেন তিনি। ছয় মাস আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয় স্ত্রীর সঙ্গে। আছে ১১ বছরের এক ছেলেসন্তান।

‘‌তরতাজা ভাইটা আমার সন্ধ্যার পর যে বাসা থেকে বের হলো, কেউ দেখলও না, এই যে বের হলো আর ফিরে এল না। শুধু শুনলাম আর ছবিটা দেখলাম, আমার ভাইটার লাশটাও কবর দিতে পারলাম না, দেখতে পারলাম না, ছুঁইতে পারলাম না, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হলো। আমার ভাইটা তো বেওয়ারিশ না। ফ্যামিলি আছে, আমি চিল্লাইয়া বলতে চাই, আমার ভাই বেওয়ারিশ না, আমার ভাই অজ্ঞাত না, তার মা-বাবা, ভাই-বোন সব আছে। আমার বাবা-মা ও ভাই-বোন সবাই পাগলের মতো হয়ে গেছে, আমি তাদের হাহাকার কীভাবে বন্ধ করব, কীভাবে সামলাব, আমি তো নিজেকে সামলাতে পারছি না, জানি না এভাবে কতদিন চলবে। আমি আমার ভাইয়ের বিচার পাব কিনা এই দুনিয়ায়, তাও জানি না।’ এভাবে নিজের আক্ষেপের কথা বলছিলেন নিহতের ছোট ভাই মো. নাবিল।

জিডি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা থেকে গুলিবিদ্ধ ও বুক ঝাঁজরা অবস্থায় পাওয়া যায় নিহত সোহেলকে। ওই রাতে শিক্ষার্থীরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) নিয়ে আসেন। লাশের অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ায় ঢামেক মর্গ থেকে ২৩ জুলাই মরদেহটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করা হয়। ২৪ জুলাই রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় তার মরদেহ।

নিহতের ছোট ভাই মো. নাবিল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর কোনো খবর পাইনি। ফেসবুকে অনেক পোস্টও করেছি বিভিন্ন জায়গায়। ২১ আগস্ট হঠাৎ সন্ধ্যায় আমাদের মোবাইলে একটা কল আসে যে ভাইয়া আপনাদের ভাইকে কি পেয়েছেন? সে বলল, আমারো ভাই হারিয়েছে আমিও তাকে খুঁজতে মর্গে গিয়েছিলাম, তখন আমি মর্গে কিছু বেওয়ারিশ লাশের ছবি দেখেছি, ওখানে একটা লাশের ছবির সঙ্গে আপনার ভাইয়ের অনেকটা মিল আছে। জরুরি মর্গে যান। তখন আমার মেজো ভাই জুয়েল মর্গ থেকে ছবি সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে আসে। কাউকে কিছু না বলে ছবিটি শুধু আমাকে দেখায়। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলেছি যে এটা আমার ভাই। এটাই আমার সোহেল ভাই।’

পরদিন ২২ আগস্ট নিহতের মেজো ভাই জুয়েল ও ছোট ভাই নাবিল ছুটে যান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, মর্গে যে ছবিটা পাওয়া যায় তার ওপর লেখা ‘‌অজ্ঞাত ২৮ জিডি নাম্বার ১৩৫৯’-এর সন্ধান করা। সেখানে ফাইলগুলো ওলটপালট করে দেখার সময় চোখে পড়ল ‘‌অজ্ঞাত ২৮ জিডি নাম্বার ১৩৫৯’। জানতে চাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে জানানো হয় মরদেহটি তাদের কাছে আসে ২৩ জুলাই এবং এর পরদিন তারা দাফন সম্পন্ন করেন রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। বিস্তারিত জানতে চাইলে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয় নিহতের দুই ভাইকে। এরপর থানায় গেলে জিডি পড়ে শোনান এক পুলিশ কর্মকর্তা। প্রথমেই জানান ১৮ জুলাই রাতে যাত্রাবাড়ী কাজলা থেকে মরদেহটি পাওয়া গেছে। কীভাবে এমন হলো? জানতে চাইলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গুলি লেগেছে মাথায়। পরে ছররা গুলিও লেগেছে অনেকগুলো। পুরো শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে। জিডিতে উল্লেখ করা আছে, নিহত সোহেলকে শনাক্তের জন্য ফিঙ্গার করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ভোটার আইডি কার্ড বা জন্মনিবন্ধন নম্বর না পাওয়ায় ২৩ জুলাই পর্যন্ত মর্গে রাখা হয়েছিল। পরে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নিহতের মেজো ভাই জুয়েল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার যদি এ দুনিয়ায়ও না হয় ওই যে আরেকটা দুনিয়া আছে সেখানে অবশ্যই বিচার হবে। আমার ভাইয়ের লাশটাও দেখতে পারিনি। কবরও দিতে পারিনি। রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে আমার ভাইয়ের কবর কোনটা সেটাও জানি না। আমরা আমাদের ভাইয়ের দেহাবশেষ ফিরে পেতে চাই।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন