লিয়াজোঁ কমিটির ওরা ছয়জন

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া ও আনিসুর রহমান

ছবি : বণিক বার্তা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর রাষ্ট্র পরিচালনায় গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য নবগঠিত সরকারকে পরামর্শ দিতে লিয়াজোঁ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গত ৮ আগস্ট ঘোষিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান মাহফুজ আলম (আব্দুল্লাহ)। অন্য সদস্যরা হলেন নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী (নাসির আব্দুল্লাহ), আকরাম হুসাইন, ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান, মামুন আব্দুল্লাহিল ও আরিফুল ইসলাম আদীব। সরকার, অংশীজন ও ছাত্র-জনতার সঙ্গে সমন্বয় করাই মূলত তাদের দায়িত্ব।

নবীনদের দিয়ে গঠিত এ কমিটির সদস্যদের নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। চলছে নানা আলোচনা। ছাত্র-জনতা এবং সরকারের মাঝে সেতু হিসেবে কাজ করা এ যুবকদের নাম-পরিচয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে আগ্রহী সারা দেশের মানুষ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রূপরেখা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান মাহফুজ আলম (আব্দুল্লাহ)। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, পাঠচক্রের সঙ্গে যুক্ত। সাংবাদিকতাও করেছেন বেশ কিছুদিন। মাহফুজ আলম বর্তমানে বেশ কয়েকটি পাঠচক্র এবং পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিনেযোগ, গুরুবার আড্ডা, পূর্বপক্ষ, রণপা, দ্য কুইল্ট।

কমিটির পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্বে আছেন নাসির আব্দুল্লাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ওই সেশনে ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১১তম স্থান লাভ করে মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন দারুননাজাত আলিম মাদ্রাসা থেকে। 

নাসির আব্দুল্লাহর সহপাঠীরা জানান, এর আগে তিনি ছাত্র ফেডারেশন এবং এবি পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালে সীমান্ত হত্যা বন্ধে একাই রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

লিয়াজোঁ কমিটির এডুকেশন অ্যান্ড আদার অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক সদস্য আকরাম হুসাইন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। পরে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্যানেল থেকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করেন। 

আকরাম হুসাইন সাহিত্য পত্রিকা ‘সমাজচিন্তা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রকাশনা ‘মুক্তি’র সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সদস্য। তার বাবা হাফেজ আলমগীর ধানমন্ডির একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। কুমিল্লার লাঙ্গলকোট উপজেলার কান্দাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আকরাম হুসাইন বাবার কর্মস্থল রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় বেড়ে ওঠেন। স্নাতক সম্পন্ন করে ক্রিয়েটিভ আইটি থেকে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করেন। বর্তমানে একটি ডিজিটাল মার্কেটিং চালান, যেখানে কাজ করেন ২০ জনের মতো তরুণ-তরুণী। এ বছরের শুরুতে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের আইভিএলপি ইয়াং লিডার হিসেবেও মনোনীত হন আকরাম হুসাইন।

লিয়াজোঁ কমিটির পলিসি অ্যাফেয়ার্স বিষয়াবলি দেখছেন ভূঁইয়া আসাদুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করেছেন গ্রিন লাইফ নার্সারি কেজি স্কুল এবং ওয়ারুক আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। 

আসাদুজ্জামানের সহপাঠীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে তিনি বিভিন্ন সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড এবং পাঠচক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আন্দোলনেও শুরু থেকে অংশ নিতেন। বর্তমানে আসাদুজ্জামান অর্থনীতিবিষয়ক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ‘রণপা’ নামে শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মামুন আব্দুল্লাহিল দায়িত্ব পালন করছেন লিয়াজোঁ কমিটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স বিষয় নিয়ে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণে ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণ থেকে শুরু করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিলেন সক্রিয়। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যুতে সরব থাকতেন। ঢাবি শিক্ষার্থীদের পরিচালিত পাঠচক্র ‘আড্ডা’র নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। আড্ডার পাঠচক্র ও সেমিনার মূলত রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে বিরাজনীতিকীকরণের সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের উপায়গুলোকে চিহ্নিত করে সংঘটিত হতো। সেসব নিছক জ্ঞান আহরণের অরাজনৈতিক পাঠচক্র ছিল না। 

মামুন আব্দুল্লাহিল ২০১১ সালে ঝিনাইদহের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন ঢাকার ইম্পিরিয়াল কলেজে। ২০১৩ সালে এইচএসসি সম্পন্নের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন। তার পৈত্রিক নিবাস লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নে। বাবা স্কুল শিক্ষক, মা গৃহিণী।

মিডিয়া ও তথ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পালন করছেন আরিফুল ইসলাম আদিব। ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। এর আগে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আদিব বর্তমানে রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। পেশাগত জীবনে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২০ সালের পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ও মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন।

বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে জন্ম নেয়া আদিবের বাবা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক, মা গৃহিণী। ২০১১ সালে বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসা থেকে মাধ্যমিক সম্পন্নের পর আদিব ভর্তি হন ঝালকাঠি এনএস কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ২০১৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনে ভর্তি হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, দেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিকড় প্রোথিত রয়েছে ‘গুরুবার আড্ডা’ নামে একটি পাঠচক্রে। ২০২১ সালে এটি শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম। গুরুবার আড্ডার ধারণা ছিল ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক পাঠচক্রের মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে বোঝাপড়া নিশ্চিত করা।

তারা আরো জানান, ২০২৩ সালে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ছাত্র অধিকার পরিষদের আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠলে দলটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা একযোগে দল থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করা কর্মী ও ‘গুরুবার আড্ডা’র পাঠচক্রের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি’। এতে যোগ দেয়া নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পান খুব দ্রুতই। আন্দোলনের সমন্বয়ক ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যদের অনেকে এ গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি এবং পাঠচক্র আড্ডার সদস্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন