২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল

ছয় বছরে শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন ১০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা

আরফিন শরিয়ত

ছবি : বণিক বার্তা

দেশের সরকারি দপ্তরগুলোয় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল প্রবর্তন হয় ২০১৮ সালে। সে সময় এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা, সততা, নৈতিকতা ও কর্মক্ষেত্রে কাজের মান বৃদ্ধি করতে এ কৌশলের প্রবর্তন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তখন থেকেই সরকারের প্রতিটি দপ্তরের তিনজন কর্মকর্তাকে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে এ পুরস্কার পেয়েছেন ১০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এ পুরস্কারের জন্য ক্ষমতাঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে এমন অনেকেই এ পুরস্কার পেয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় দুর্নীতি, অসততা ও নৈতিকতাহীনতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। তৎকালীন সরকারের ক্ষমতাঘনিষ্ঠ যেসব কর্মকর্তা এ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ আছেন। আছেন চারিত্রিক পদস্খলনের দায়ে ওএসডি হওয়া মাদারীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরও। এছাড়া গত কয়েক বছরে আলোচিত যেসব সরকারি কর্মকর্তা এ পুরস্কার পেয়েছেন, সে তালিকায় নাম রয়েছে পুলিশের সদ্যসাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের এমডি মো. আফজাল করিম, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম প্রমুখ। 

চালুর পর থেকে এ পর্যন্ত কতজন সরকারি কর্মকর্তা শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন তা জানতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও অধিদপ্তরে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন অন্তত ১০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা ব্যক্তিরাও এ সংখ্যা নিশ্চিত করেছেন।

এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার নির্দিষ্ট নাম্বারিংয়ের ওপর নির্ভর করে কর্মকর্তাদের দেয়া হয়। এ নাম্বারিং পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভর করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে খুশি করতে পারলে সর্বোচ্চ নাম্বারিং এবং শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়া সম্ভব। পুরস্কার প্রবর্তনের পর কিছুদিন ভালোভাবে চললেও পরবর্তী সময়ে এটি পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক পুরস্কার হয়ে দাঁড়ায়। সৎ কর্মকর্তারা এখন আর শুদ্ধাচারের প্রত্যাশাও করেন না।’ শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য ১৮টি গুণাবলিকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে পেশাদারত্বের পাশাপাশি আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মতো বিষয়ও স্থান পেয়েছে। পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সহকর্মী ও সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পারদর্শিতা, কম ছুটিগ্রহণের প্রবণতা এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য ৫ নম্বর করে নির্ধারিত। এতে মোট নম্বর ৯০। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ধার্য করা অন্যান্য কার্যক্রম পালনের ওপর রাখা হয়েছে ১০ নম্বর। সব মিলিয়ে মোট ১০০ নম্বর। 

শুদ্ধাচার পুরস্কার সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের শুদ্ধাচার অধিশাখার ‍উপসচিব মুহাম্মদ নাজমুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী, ৮০ শতাংশের বেশি মার্কস কেউ যদি না পায়, তাহলে শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্তির কোনো সুযোগ নেই। সে হিসেবে সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয় সব সময় শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নাও করতে পারে।’ 

সরকারের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘কতগুলো শুদ্ধাচার পুরস্কার দেয়া হয়েছে তার সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কোনো দপ্তরে সংরক্ষিত নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের এ বিষয়ে স্বাধীনতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কাছে এ সম্পর্কিত তথ্য থাকবে।’ 

কোনো দেশে দুর্নীতির মাত্রা কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। বিদায়ী ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। সে প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এর আগে ২০২২ সালে এ অবস্থান ছিল ১২তম। গণতন্ত্রহীন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে থাকা দেশগুলোয় সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেশি দেখা যায় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার ঘোষণা হওয়ার পর থেকে আমরা এ নিয়ে সমালোচনা করে আসছি। এ আইডিয়াটা ভালো ছিল। কিন্তু যে মানদণ্ড বিবেচনায় এ পুরস্কার দেয়া হতো, তা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এর মাধ্যমে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হতো। ফলে এটাই একটি দুর্নীতির মাধ্যম হয়ে পড়েছে। অনেকেই এর মাধ্যমে নিজেদের জবাবদিহিতার বাইরে রাখতেন। দলীয়করণ, পেশাগত দেউলিয়াপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় এ পুরস্কার দেয়া হতো। এতে অনেক কর্মকর্তা ভালো কাজ করে ঝুঁকিতে পড়েছেন।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বলব না মাথা ব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে পুরস্কারের প্রক্রিয়া সংস্কার করে যোগ্য, নৈতিকতাসম্পন্ন, আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে সম্পৃক্ত না, এমন কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করতে হবে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবক্ষয়যুক্ত হয়ে পড়লে এ ধরনের পুরস্কারের ক্ষেত্রে সততার চেয়ে পরিচিতি ও ব্যক্তিগত সম্পর্কই প্রাধান্য পায় বেশি। ক্ষমতাঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রাপ্তি মাঠ পর্যায়ে অন্যান্য কর্মকর্তাকেও একই পথ অনুসরণে উৎসাহিত করে তোলে। এ অবস্থায় শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা সরকারি কর্মকর্তাদের সত্যিকার অর্থেই কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধাচার বজায় রাখার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজনীন ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একটি পুরস্কার পেতে হলে তার ক্রাইটেরিয়াগুলোও পূরণ করতে হয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, যারা সৎ এবং দুর্নীতিপরায়ণ না; তারা চুপচাপ থাকেন। সবাইকে এড়িয়ে চলেন। তাদের ভাগ্যে পুরস্কার জোটে না। যারা খুবই পরিচিত, প্রচার-প্রসার করতে পারে তাদেরকেই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এ সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। দিনে দিনে এটি বেড়ে চলছে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে এসব ঘটনা বেশি হচ্ছে। আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আশা করছি, আগামীতে এ ধরনের দুর্নীতি থেকে আমরা মুক্তি পাব।’ 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো পুরস্কার নিয়ে যখন কথা হয়, তখন সে পুরস্কার কেউ না কেউ প্রস্তাব করে। সেটা যদি জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার হয় তাহলেও তার প্রস্তাব আসে। যিনি প্রস্তাব করেন তিনি তো সবকিছু জানেন না। শুদ্ধাচার পুরস্কার যারা দেন, তাদের কাছে মাঠ পর্যায়, দপ্তর, অধিদপ্তর থেকে তথ্য আসে। এ কারণে পরে দেখা যায়, যিনি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি কোনো না কোনো ত্রুটিতে সম্পৃক্ত অথবা পুরস্কার প্রাপ্তির পর কোনো না কোনো দুর্নীতিতে জড়িয়ে যান। এ সম্পৃক্ততা যত কম হয় ততই ভালো।’ 

তিনি বলেন, ‘পুরস্কার একটা প্রণোদনা। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেক সম্মাননীয় ব্যক্তিকেও পরে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত বলে দেখতে পাই। এজন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তির জন্য পুরো সিস্টেমকে আমরা দায়ী করতে পারি না।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন