অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আশুলিয়া ও গাজীপুরের ৭০ কারখানা

বিগ বসের কারখানায় আগুন, সাধারণ ছুটি অন্তত ৭০টিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক

গাজীপুরে বিগ বস নামে একটি কারখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয় ছবি: সংগৃহীত

দফায় দফায় বৈঠকের পরও শিল্পাঞ্চলে থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ। আন্দোলনের মুখে অনির্দিষ্টিকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আশুলিয়া এলাকার ৫৮টি কারখানা। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে ৩২টি কারখানা গতকাল বন্ধ রাখতে হয়েছে। গাজীপুরে বিগ বস নামে একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৪০-৫০টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ১২টি কারখানা। এ হিসেবে দুই শিল্প এলাকার ৭০টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর সাধারণ ছুটি দিয়ে গতকাল বন্ধ রাখা হয় অন্তত ৭০টি কারখানা। শিল্প পুলিশ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার মুখে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, দিনকে দিন যা বেড়েই চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্প সুরক্ষায় ওই এলাকার অন্তত ৫৮টি পোশাক কারখানা শ্রম আইন ২০০৬ সালের ১৩ (ক) ধারায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে গতকাল সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় ৩২টি কারখানায়। এর মধ্যে রয়েছে পোশাক খাতের কারখানাও।

শিল্প পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবির মুখে মালিকপক্ষ আলোচনা করলেও কোনো ধরনের সিদ্ধান্তে যেতে পারেনি। ফলে গতকাল ১৩ (ক) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অনেকগুলো কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে অনন্ত, মেডলার, শারমিন গ্রুপ, ডেকো, এস টোয়েন্টিওয়ান, মন্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড, ম্যাংঙ্গো টেক্স, এআর জিন্স, এনভয়, স্টাইলিং গ্রুপ, ভিনটেক্স, ইয়াগী বাংলাদেশ, ক্রস ওয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, অরোনিমা, ডেবনিয়ার, দ্য রোজ, জেনারেশন নেক্সট, সিনসিন, ডিসান সোয়েটার, সিগমা ফ্যাশনসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কারখানা। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে অনেকগুলো কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এগুলোর ছাড়া অবশ্য বাকিগুলোয় উৎপাদন চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে নজরদারি।

জানতে চাইলে শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম গতকাল রাত ১০টার দিকে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আশুলিয়া এলাকায় ৫৮টি কারখানা ১৩(ক) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আরো ৩২টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তবে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে যৌথ বাহিনী।’

গাজীপুরেও বিভিন্ন দাবিতে গতকাল আন্দোলন করেন বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিক। এ সময় মহাসড়ক অবরোধ ও কারখানায় আগুন দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে দুপুর ১২টার দিকে কাশিমপুরের ভবানীপুর এলাকায় বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের তাড়িয়ে দেন। 

জেলার শিল্প পুলিশ ও শ্রমিকদের সূত্রে জানা গেছে, কাশিমপুরের সারাবো এলাকায় সালমান এফ রহমানের মালিকাধীন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেখানকার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই আগস্টের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। এ বিষয়ে কয়েক দিন ধরেই কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছিলেন শ্রমিকরা। এরই ধারাবাহিকতায় বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা গতকাল সকালে আন্দোলন শুরু করেন। তারা কালিয়াকৈরের চন্দ্রা-নবীনগর সড়কও অবরোধ করেন। পরে দুপুর ১২টার দিকে একদল বিক্ষুব্ধ শ্রমিক বিগ বস কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কোনাবাড়ী থানার ওসিসহ বেশকিছু পুলিশকে কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরে বিকালের দিকে সেনাবাহিনী গিয়ে অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে।

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, ‘বিগ বস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে আমাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের দিকে যায়। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আমাদের একটি গাড়ি ভাংচুর করলে কর্মীরা চলে আসেন। ফের কাশিমপুর ও ডিবিএল কায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ শুরু করে। বিকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।’

এদিকে সকাল ৭টা থেকে গাজীপুর লক্ষ্মীপুরা তিনসড়ক এলাকায় অবস্থিত আড়ং ডেইরি ফুড প্রজেক্টের শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ন্যূনতম বেতন ১৮ হাজার টাকা করা, আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে দ্বিগুণ ওভারটাইম, কোনো কর্মীকে ওভারটাইম করতে বাধ্য না করা, নারীদের নাইট ডিউটিতে তাদের সম্মতিপত্র নেয়া, দুর্ঘটনায় আহত কর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, চাকরির বয়স অনুযায়ী বেতন বাড়ানো, বার্ষিক আয়ের ৫ শতাংশ বাধ্যতামূলক কর্মীদের দেয়া, কর্মী নিয়োগের সময় পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ ও ছাঁটায়ের ক্ষেত্রে আইন মানা, খারাপ আচরণ না করা এবং সরকারি সব ছুটি দেয়া তাদের দাবি। 

শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, শ্রমিকদের বুঝিয়ে প্রথমে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে সেনাবাহিনী এসে মালিকপক্ষের সঙ্গে বসে দাবির বিষয়ে সমাধানের আশ্বাস পেয়ে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন।

পোড়াবাড়ী মাস্টারবাড়ী এলাকার ভার্গো এমএইচ লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে দুপুরের পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। ২ ঘণ্টা তারা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে ১০ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা। 

শ্রমিক আন্দোলনের জেরে গতকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা কারখানার মধ্যে রয়েছে গাজীপুর গিলারচালা এলাকার ফমকম ফ্যাশন, অ্যাপারেল-২১ লিমিটেড, ফমকম প্রিন্টিং ও এমব্রয়ডারি, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল ও সদর উপজেলার শিরিরচালা এলাকার এসএম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর শিল্প পুলিশের (জোন-২) পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা কারখানা ৪০-৫০টি। এর মধ্যে অধিকাংশই পোশাক খাতের। বেক্সিমকোর আট-নয়টি কারখানা বন্ধ আছে। বিগ বসের গোডাউন পুড়ে গেছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া আছে ১২টি কারখানা।’

শিল্প অধ্যুষিত আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকায় দুই হাজারেরও বেশি কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই পোশাক ও বস্ত্র খাতের। তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, জিরানী, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা মেট্রোপলিটন ও চট্টগ্রামে মোট পোশাক কারখানা সংখ্যা ২ হাজার ১৪৪। এর মধ্যে খোলা কারখানা ২ হাজার ৩০টি। সাময়িক বন্ধ ও ছুটি থাকা কারখানা ১১৪টি। এসব কারখানার মধ্যে আগস্টের বেতন পরিশোধ করেছে ১ হাজার ৩০৯টি। বেতন পরিশোধ করেনি ৮৩৫টি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন